ভারত

কয়েকশো বছর ধরে আমেরিকার সাথে যুক্ত রয়েছে ভারতীয়রা

১২ অক্টোবর, ১৪৯২, প্রথমবারের জন্য আমেরিকার মাটিতে পা রাখে ইটালির নাবিক ও অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস। এই কারনে আমেরিকা আবিস্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে। কিন্ত একটা বিষয় অনেকেই জানেনা তা হল ভারতীয়রা আমেরিকার ব্যাপারে আগে থেকেই জানতো, কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের কয়েক হাজার, লাখ বছর আগে থেকেই ভারতীয়দের কাছে আমেরিকার ব্যাপারে তথ্য ছিল। বাল্মিকী রামায়নের কৃষকিন্ধ্যা কান্ডে বর্ননা করা হয়েছে বানর রাজ সুগ্রীব বানর সেনাকে বিনতার নেতৃত্বে মাতা সীতাকে খোঁজার জন্য পূর্ব দিকে যাবার কথা বলেছে। সুগ্রীব বিনতাকে জম্বুদ্বীপের পূর্বদিকের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানান এইসময়। কৃষকিন্ধ্যা কান্ডের ৫৩ তম শ্লোকে সুগ্রীব একটি জায়গার বর্ননা করে বলেছেন পর্বতের চূড়ায় উজ্জ্বল সোনার তোরনের মতো অংশ রয়েছে যা দেখতে তিনটি শাখা বিশিষ্ট পাম গাছের মতোন, এটি সেই মহান আত্মার নিদর্শন যা অনন্ত এবং এর নীচের ভাগ সোনার মতোন যা কারনে এটি উজ্জ্বল দেখাবে। শ্লোক ৫৪ এবং ৫৫ তে সুগ্রীব আরও বলেছেন স্বর্গের দেবতা পাম গাছের মতো তোরন পূর্ব দিককে বোঝানোর জন্য তৈরি করেছেন। এই জায়গা অতিক্রম করার পর একটি সোনালী পর্বত পাওয়া যায় যাকে উদয় পর্বত বলা হয়েছে। 

৫৬ নং শ্লোকে উদয় পর্বতে পাওয়া কিছু গাছের কথা বলা হয়েছে যেগুলো সাধারনত সব পার্বত্য অঞ্চলেই পাওয়া যায়, এই গাছগুলো সূর্যের মতোই চকচকে বলা হয়েছে। বানর রাজ সুগ্রীবের প্রতিটি কথার প্রমান রয়েছে।

দক্ষিন আমেরিকার একটি দেশ পেরুর সমুদ্র তীরে আন্দিজ পর্বতে প্যারাকাস ক্যান্ডেলাবরা নামে একটি জিওগ্লিফ রয়েছে যা দেখতে ত্রিশূলের মতোন। পৃথিবীর কোন কোন জায়গায় বালি বা পাথর সরিয়ে হাতে করে তৈরি করা কোন নিদর্শনকে জিওগ্লিফ বলা হয়। ৫৯৫ ফুট বা ১৮১ মিটার লম্বা এই নিদর্শনকে সমুদ্রের বারো মাইল বা প্রায় ১৯ কিলোমিটার দূর থেকেই থেকে দেখা যায়। এটি দেখতে ত্রিশূলের মতোন হলেও দূর থেকে দেখে একটি গাছের তিনটি শাখার মতোনও মনে হয়। রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে জানা গেছে এই নিদর্শনটি অন্তত ২০০ বিসিই পুরোনো, ১ বিসিই মানে ২,০২২ বছর। এই নিদর্শন কেন তৈরি করা হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি। 

দক্ষিন আমেরিকান অঞ্চলে ইনকা সভ্যতা বিরাজ করতো একটা সময়। সেই ইনকাদের ধারনা ছিল এটি তাদের দেবতা ভীরাখোচার অস্ত্রের চিহ্ন। ইনকা সভ্যতায় ভীরাখোচাকে স্বর্গের দেবতা বলে বিশ্বাস করা হয় এবং বৃষ্টির জন্য তার উপাসনা করা হত। এটা শুনে অনেকটা হিন্দু ধর্মের দেবতা ইন্দ্রের কথা মনে হয়। হিন্দু ধর্মেও দেবরাজ ইন্দ্রকে স্বর্গের রাজা বলা হয়েছে, দেবরাজ ইন্দ্রকেও বৃষ্টির জন্য পূজো করা হয়। দেবরাজ ইন্দ্রের কাছেও ভীরাখোচার মতো একটি অস্ত্র বজ্র রয়েছে। অর্থাৎ এইদিক দিয়ে দেখতে গেলে ইনকা সভ্যতার সাথে কোথাও যেন হিন্দু ধর্মের একটু মিল পাওয়া যায়। এই প্যারাকাস ক্যান্ডেলাবরার নীচের দিকের ভূমি সোনালী রঙের যার কারনে এর উপরের নিদর্শন দেখতে যথেষ্ট চকচকে। এই প্যারাকাস ক্যান্ডেলাবরার পিছন থেকেই শুরু হয় আন্দিজ পর্বতমালা। এই আন্দিজ পর্বতমালা সোনালী রঙের উজ্জ্বল কারন বলা হয় আন্দিজ পর্বতে প্রচুর সোনার ভান্ডার আছে। এই আন্দিজ পর্বতই রামায়নের উদয় পর্বত। অর্থাৎ কৃষকিন্ধ্যা পর্বে বানর রাজ সুগ্রীবের বলা প্রতিটা কথার প্রমান পাওয়া যায়। কিন্ত বানর রাজ সুগ্রীব পূর্ব দিকের কথা বলেছিলেন কিন্ত দক্ষিন আমেরিকা পশ্চিম দিকে! এর জবাব পাওয়া যায় কৃষকিন্ধ্যা পর্বের ৫৮ এবং ৫৯ তম পর্বে। এখানে বলা হয়েছে ভগবান বিষ্ণু যখন বামন অবতার নিয়ে পৃথিবীতে আসেন তখন তিনি প্রথম পা রেখেছিলেন সৌমানাসা পর্বতে যা উদয় পর্বতের সবচেয়ে উচ্চতম অংশ। এই কারনে হিন্দু ধর্ম মতে পৃথিবীতে সূর্যোদয় প্রথম এখান থেকেই হয়। 

ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে পঞ্চম অবতার এবং ত্রেতা যুগের প্রথম অবতার এই বামন অবতার। দৈত্যরাজ বলির কাছ থেকে বলির কাছ থেকে তিন পদে স্থানের বিনিময়ে তিনি ত্রিলোক পুনরুদ্ধার করেন। ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় পা মেরু পর্বতে পড়ে যাকে জাম্বুদ্বীপে ছিল। হিন্দু পুরানে জম্বুদ্বীপ ভারতীয় উপমহাদেশকেই বলা হয়েছে। কৃষকিন্ধ্যা পর্বে আরও বলা হয়েছে সৌমানাসা পর্বতে যখন সূর্য উদয় হত জম্বুদ্বীপে তখন সূর্য অস্ত চলে যেত। আজকের দিনে হিসাব করলে দেখা যায় ভারত ও দক্ষিন আমেরিকার মধ্যে এগারো ঘন্টা সময়ের ব্যাবধান অর্থাৎ দক্ষিন আমেরিকায় যখন দিন জম্বুদ্বীপে তখন রাত। এটা প্রমান করে রামায়নের যুগে ভারতবাসী আমেরিকা সম্পর্কে জানতো। এছাড়াও রামায়নের আরও একটি ঘটনা পাওয়া যায় যা থেকে দক্ষিন আমেরিকা সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায়। ভগবান শ্রীরামের ভাই লক্ষ্মনজী যখন রাবনের পুত্র ইন্দ্রজিৎকে হত্যা করে তখন রাবন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার ভাই অহিরাবনকে ডাকে। অহিরাবন ভগবান শ্রীরাম ও তার ভাই লক্ষনজীকে অপহরন করে পাতাললোকে নিয়ে যায়। অহিরাবন পাতাললোকের রাজা ছিল। এই খবর পেয়ে হনুমানজী পাতাললোকে গিয়ে অহিরাবনকে হত্যা করে ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষনজীকে মুক্ত করেন। অহিরাবনকে হত্যা করবার আগে পাতাললোকে হনুমানজীর সাথে মকরধ্বজের লড়াই হয়। এই মকরধ্বজের অর্ধেক শরীর ছিল কুমিরের এবং বাকী অর্ধেক শরীর ছিল বাঁদরের। এই মকরধ্বজ হনুমানজীরই পুত্র ছিল। বলা হয় যখন হনুমানজী তার লেজের সাহায্যে লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে দেবার পর যখন সমুদ্রে ডুব দেয় তখন তার ঘামের একাংশ সমুদ্রে একটি কুমিরের মুখে গিয়ে পড়ে সেখান থেকেই মকরধ্বজের জন্ম হয়। অহিরাবনকে হত্যার পর মকরধ্বজকে পাতাল লোকের রাজা করে দেয় হনুমানজী। 

ভারতবর্ষ থেকে মাটির নীচে সোজাসুজি গর্ত খুঁড়লে তা দক্ষিন আমেরিকাতে গিয়ে শেষ হয়। দক্ষিন আমেরিকাতে হনুমানজির উপস্থিতির আরও প্রমান পাওয়া যায় হন্ডুরাস নামক দেশে। হন্ডুরাসের লা মসকুইটিয়া নামক এলাকায় উপজাতিরা বিশ্বাস করে এই অঞ্চলে ঘন জঙ্গলের মাঝে লা সিউদাদ ব্লাঙ্কা নামে একটি প্রাচীন শহর আছে যেখানে মাঙ্কি গডের রাজত্ব ছিল। স্প্যানিশ শব্দ লা সিউদাদ ব্লাঙ্কার অর্থ সাদা শহর। 

১৯২৭ সালে আমেরিকার এক পাইলট চার্লস লিন্ডবার্গ যখন পূর্ব হন্ডুরাসের জঙ্গলের উপর দিয়ে বিমান ওড়াচ্ছিলেন তখন তিনি জঙ্গলের মধ্যে একটি সাদা শহর দেখার দাবি করেন তখন থেকেই সাদা শহর নামটি প্রচলিত হয়। থিওডোরে মোর্দে নামে এক অভিযাত্রী বেশ কয়েকবছর লা মসকুইটিয়া অঞ্চলে অভিযানের পর দাবি করেন তিনি সেই প্রাচীন শহরের দর্শন পেয়েছেন, প্রমান হিসাবে তিনি কিছু প্রাচীন জিনিস নিয়ে আসেন। মোর্দে জানান ওই শহর সাদা চুনাপাথরে তৈরি তাই গোটা শহর সাদা রঙের। লা সিউদাদ ব্লাঙ্কা শহরের চারদিকে অনেক বাঁদরের মূর্তি আছে এবং শহরের মাঝখানে বিশাল মন্দির আছে একটি যেখানে যাওয়ার জন্য অনেক সিঁড়ি রয়েছে  এবং পথের পাশে ব্যাঙ, কুমির সহ অনেক পশুর স্থাপত্য রয়েছে এবং মন্দিরের ভিতর মাঙ্কি গডের বিশাল মূর্তি রয়েছে, এই শহরে কুমিরেরও অনেক মূর্তি আছে। থিওডোরে মোর্দে আরও দাবি করে সেখানে সোনা, রূপো ও প্ল্যাটিনাম রয়েছে। তবে থিওডোরে মোর্দের দাবী প্রত্নতত্ত্ববিদরা মানেনা কারন লা সিউদাদ ব্লাঙ্কার সঠিক অবস্থান কেউ জানতে পারেনি। যদিও স্থানীয় উপজাতি এবং বেশ কিছু অভিযাত্রী এই শহর দেখেছে বলে দাবী করে। হন্ডুরাসেরই পশ্চিম প্রান্তে কোপেন নামে আরও একটি প্রাচীন শহর আছে যাকে মায়া সভ্যতার সময়ের বলে মনে করা হয়। এখানের ১১ নং মন্দিরের বাইরে কুমিড়ের মূর্তি রয়েছে এবং মন্দিরের ভিতরে মাঙ্কি গডের দুটি মূর্তি আছে এবং মূর্তির হাতে গদাও রয়েছে। এসব ঘটনা প্রমান করে হন্ডুরাসই পাতাল লোক। মায়া সভ্যতার লোক ১১ নং মন্দিরকে পৃথিবীর নীচে যাবার পথ বলে বিশ্বাস করতো। 

দক্ষিন আমেরিকার আরও একটি দেশ পেরুর রাজধানী লিমাতে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো একটি মন্দির পাওয়া গেছে যাকে আগুনের মন্দির নাম দেওয়া হয়েছে। এই মন্দিরটির আকৃতি এমন দেখে মনে হবে একটি বড় যজ্ঞ কুন্ড। মায়া সভ্যতার সাথে ভারতের হিন্দু ধর্মের অনেক মিল আছে। হিন্দু ধর্মে যেমন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে ত্রিদেব বলা হয় তেমন মায়া সভ্যতার লোকেদেরও তিনটি প্রধান দেবতা ছিল। হিন্দু ধর্মে দেবতার মতো মায়া সভ্যতার মানুষদেরও মন্দির ছিল। হিন্দু ও মায়া উভয় ধর্মেই সাপকে পূজো করা হয়। অর্থাৎ ভারতের সাথে দক্ষিন আমেরিকার যোগ বহু পূরোনো। হতে পারে আধুনিক ইতিহাসের মতে ক্রিস্টোফার কলম্বাসই প্রথম আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন কিন্ত ভারতীয়রাযে এরও বহু আগে থেকেই আমেরিকার সাথে পরিচিত ছিল তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.