অ্যামেরিকা

ইউরোপ কে আমেরিকার কলোনী বলার পেছনে কি কারন রয়েছে?

রাজেশ রায়:– একটা সময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোনওদিন সূর্য অস্ত যায় না। আসলে আঠারো শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত আন্টাকটিকাকে বাদ দিয়ে গোটা বিশ্বেই প্রায় ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য ছিল। যদি ইউরোপীয় বাকী শক্তি গুলোর ধরা যায় তাহলে আঠারো থেকে বিংশ শতকে গোটা বিশ্বেই প্রায় ইউরোপীয় শক্তি গুলোর আধিপত্য ছিল কিন্তু একটি ব্যাতিক্রম ছিল তা হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ পর্যন্ত আমেরিকা ইউরোপীয় শক্তি গুলোকে পরাস্ত করে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করে নেয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইউরোপীয়ান শক্তি গুলোই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল যার প্রধান কারন হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ শতকে যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ নতুন দেশ আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হয় তখন আমেরিকার আসল অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের গনহত্যা করে ইউরোপীয়ানরা আমেরিকাকে তাদের কলোনী তৈরি করে। বর্তমান আমেরিকানরা সেই ইউরোপীয়ানদেরই বংশ যারা পরে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিকে পরাস্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করে। অর্থাৎ আমেরিকাকে বাদ দিয়ে ২০ শতকে গোটা বিশ্বে ইউরোপীয়ানদেরই শাসন ছিল কিন্তু বর্তমানে ইউরোপীয়ান কোন দেশ এমনকী ইউরোপের সমস্ত দেশ একসাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নও সুপার পাওয়ার নয়। বরং বর্তমানে ইউরোপ অভিভাবক হিসাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল, ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের জন্য এটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। আজ আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইউরোপ কী ভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ইউরোপ কী সত্যি আমেরিকার কলোনী! এছাড়া আরও জানব নতুন বিশ্বযুদ্ধ কেমন হতে চলেছে।

বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র এবং লিবারেল ওয়াল্ড অর্ডার। যার মূল ভিত্তি হচ্ছে মুক্ত বানিজ্য ও গনতন্ত্র। এইসব কীছুই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হয় এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর এর বিস্তার ঘটে। এইসব নীতিই আমেরিকা তৈরি করেছিল যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ কে ঐক্যবদ্ধ রেখে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু করে রাখা। কারন দুটো বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপীয়ান শক্তি গুলোই নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এই নীতির সবচেয়ে বড় সাফল্য হল আজ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হওয়া। বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকার নীতি ছিল একাকী এবং আমেরিকা ফাস্ট কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় চার লাখ আমেরিকানের মৃত্যু হয়। কিন্তু সেই তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোরীয়ান যুদ্ধ বা আরবে কোথাও আমেরিকার এত বড় ক্ষতি হয় নি। এরপরই আমেরিকা তাদের পূর্বের নীতি থেকে সরে এসে নতুন নীতি তৈরি করে। আজ বিশ্বে উন্নত, শক্তিশালী দেশ, সভ্যতা, টেকনোলজির কথা বলতে হলে প্রথমেই ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর কথাই মাথায় আসে। এমনকী মানুষের উন্নত জীবনযাপনের মান, বিশ্বের সুখী দেশ গুলোর তালিকায় ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডের মতন ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর নাম আসে। কিন্তু একদম প্রথমে ইউরোপ কিন্তু এমন ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল, বেলজিয়াম সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ করেছে। বিশ্বযুদ্ধের আগে গোটা বিশ্বে হিংসার আঁতুড় ঘর বলা হত ইউরোপীয়ান দেশ গুলোকেই। বেলজিয়ামের রাজা লিওপোড ২ এর সময়ে আফ্রিকার একটি দেশ কঙ্গোতেই শুধু এক কোটি মানুষ মারা গেছিল। এটা তো শুধু ছোট একটা উদাহরন। এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা জুড়ে ইউরোপীয়ানদের নৃশংসতার এমন প্রচুর উদাহরন আছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা ইউরোপ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সুপার পাওয়ার হিসাবে রয়ে যায়। তখন ইউরোপীয়ান দেশ গুলো নিজেরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নতুন ওয়াল্ড অর্ডার জানতে হলে প্রথমে এটি তৈরি হবার অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সামরিক কারন গুলো সম্পর্কে জানা দরকার। প্রথমে আলোচনা করা যাক রাজনৈতিক কারন ও বিদেশ নীতি সম্পর্কে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্বে ছয়টি সুপার পাওয়ার ছিল আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে আমেরিকাই একমাত্র শক্তিশালী দেশ হিসাবে থেকে যায় কারন যুদ্ধে বাকী দেশ গুলো সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে প্রায় পুরো শেষ হয়ে গেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় ২.৫ কোটি সেনা ও সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধ থেকেই আমেরিকা নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি আমেরিকার অর্থনীতির চারভাগের এক ভাগ হয়ে যায়। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় ভবিষ্যতে আমেরিকাই ইউরোপকে নেতৃত্ব দেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ট্রুম্যান ডকট্রিন তৈরি হয় যাতে বলা হয় আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে থাকা সমস্ত দেশকে সমর্থন করবে, তাছাড়া সমস্ত দেশকে তাদের উপনিবেশিক দেশ গুলোকে স্বাধীনতা দেবার কথাও বলা হয় এতে। এরপর আসে আর্থিক কারন। আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি মার্শাল প্ল্যান তৈরি করে যাতে নতুন করে পুনর্গঠনের জন্য ইউরোপকে ১৩ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া হয় যার আজকের বাজার মূল্য প্রায় ১১৩ বিলিয়ন ডলার, সোভিয়েত ইউনিয়ন কে কাউন্টার করতেই আমেরিকা এটা করেছিল। এছাড়া এই সময় জাতিসংঘ, ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড,  বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক আদালতের মতন সংস্থা তৈরিতে করা হয়।

আমেরিকা ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের মতন সামরিক জোট তৈরি করে যার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে আটকানো। ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ নামে একটি নীতি আছে যাতে বলা হয়েছে ন্যাটোর কোন একটি সদস্য দেশের উপর আক্রমন পুরো ন্যাটের উপর আক্রমন বলে ধরে নেওয়া হবে। এই ঘটনা ইউরোপকে আরও বেশী আমেরিকা নির্ভর করে তোলে। আমেরিকা ইউরোপে একটি ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইউরোপ তৈরি করতে চাইছিল যাতে ভবিষ্যতে ইউরোপে কোন যুদ্ধ না হয়। ব্রিটেনের গ্লোবাল সুপার পাওয়ার হবার স্বপ্ন শেষ হয় ১৯৪৭ সালে যখন গ্রীসে হওয়া কমিউনিজমের প্রভাব কমানোর দায়িত্ব ব্রিটেনকে দেওয়া হয় কিন্তু ব্রিটেন আমেরিকার সাহায্য চেয়ে বসে। ১৯৫৬ এ সুইস ক্রাইসিস ব্রিটেন ও ইউরোপের সুপার পাওয়ার হবার কফিনে শেষ পেড়েকটা দেয়। কোরিয়ান যুদ্ধ ও কিউবান মিসাইল সংকটের পর বিশ্বে আমেরিকা সুপার পাওয়ার হিসাবে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করে। ২০১১ সালে লিবিয়ায় গদ্দাফির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ইউরোপ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এয়ারফোর্স, এয়ার রিফিউলার বিমান, ইনটেলিজেন্সের ব্যাপারে ইউরোপ আমেরিকার সাহায্য চায়। ব্রিটেন সম্প্রতি ব্টেক্সিটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেড়িয়ে যায় ফলে ইউরোপ আরও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমেরিকার উপর আরও নির্ভর হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ভাবেও ইউরোপ আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ আমেরিকার সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। ইউরোপ আমেরিকাতে প্রতি বছর ৩৫৩ বিলিয়ন ইউরো রপ্তানি করে। আমেরিকা এশিয়ার তুলনায় তিনগুন বেশী বিনিয়োগ ইউরোপে করে যেখানে ইউরোপ চীন ও ভারতের চাইতে আটগুন বেশী বিনিয়োগ আমেরিকাতে করে। বিশ্বের মোট জিডিপির ৪০ শতাংশ ইউরোপ ও আমেরিকা নিয়ন্ত্রন করে।

এতক্ষন বললাম কীভাবে ঐতিহাসিক ভাবেই ইউরোপ আমেরিকার উপর অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে নির্ভরশীল হয়। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর মাঝে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। যার অন্যতম কারন আমেরিকার আফগানিস্তান থেকো লজ্জাজনক ভাবে পলায়ন। এছাড়া সম্প্রতি আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে অকাস নামে একটি সংগঠন তৈরি করে যাতে অস্ট্রেলিয়াকে ১২ টি পরমানু ক্ষমতা সম্পন সাবমেরিন দেবার কথা হয়েছে। এরজন্য অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের সাথে তাদের সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করে। যা নিয়ে ফ্রান্সের সাথে আমেরিকার ঝামেলাও হয়। ইরানের সাথে পরমানু চুক্তি হঠাৎই বাতিল করে দেয় আমেরিকা যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে বিতর্ক হয়। বর্তামানে ইউরোপ এনার্জির জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল বেশী। ১৯৬০ এর দশকে ইউরোপ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মাত্র ৬ শতাংশ জ্বলানি আমদানি করত। এরপর রাশিয়া পোল্যান্ড হয়ে জার্মানি পর্যন্ত তাদের অয়েল পাইপলাইন তৈরি করে যার নাম ফ্রেন্ডশিপ লাইন। এরপর ধীরে ধীরে আরও অনেক পাইপ লাইন তৈরি করা হয়। ইউরোপ এখন ৭০ শতাংশ এনার্জির জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। রাশিয়া এর সুযোগ যথেষ্ট ভাবে ওঠাচ্ছে। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে আমেরিকা রাশিয়ার নড স্ট্রিম গ্যাস লাইনে নিষেধাজ্ঞার জন্য জার্মানিকে বলে, জার্মানি না করে দেয় কারন এই পাইপ লাইনের দ্বার জার্মানি ৭৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস পায়। ২০০৪ এ ইউক্রেনে হওয়া অরেন্জ বিপ্লবেও রাশিয়া হঠাৎ ইউক্রেনে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়, যাতে ৭২০ মিলিয়ন ডলারের লোকসান হয় ইউক্রেনের কারন রাশিয়ান সমর্থিত সরকারের বদলে পশ্চিমা সমর্থিত সরকার আসে ক্ষমতায়। তবে এসব সত্বেও গোটা বিশ্বে আমেরিকার ডিপ্লোমেটিক পাওয়ার যথেষ্ট রয়েছে। আমেরিকার হলিউড জগত বিখ্যাত, আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সবচেয়ে বেশী বিদেশী স্টুডেন্ট আসে। আমেরিকার অস্কার পুরস্কারের নাম সবাই শুনেছেন কিন্তু ব্রিটেনের বাফটা পুরস্কারের নাম কতজন জানেন? জিটিএ ৫ অন্যতম শ্রেষ্ঠ গেম, এটি তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে কিন্তু এতে সব শহর রয়েছে আমেরিকার সুতরাং আমেরিকার ক্ষমতাটা বুঝুন। তবে এটা ঠিক যে আমেরিকা গ্লোবাল সুপার পাওয়ার হলেও এনার্জির ব্যাপরে ইউরোপ রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে এশিয়াতে ভারত, চীনের প্রভাব বাড়ছে। তবে এখনও সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপ আমেরিকার উপর নির্ভরশীল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.