লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার ছবি নিয়ে এতো রহস্যময় হওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে জানেন?
রাজেশ রায়:- পৃথিবীর সেরা চিত্রকারদের কথা যখন উচ্চারিত হবে ইটালির কিংবদন্তি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সবসময় প্রথম সারিতে থাকবে। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসা নামে এক অসাধারন ছবি একেছিলেন যা নিয়ে আজও গবেষনা চলছে। বলা হয় এই ছবি খুবই রহস্যময়, যার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা নিয়ে গবেষনা চলছে। ফ্রান্সের লুভ্যের মিউজিয়ামে সম্পূর্ণ একটি আলাদা ঘরে এই ছবি রাখা আছে। ঘরের তাপমাত্রা সবসময় ১৮-২১ ডিগ্রির মধ্যে রাখা আছে এবং ঘরের আদ্রতাও নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। একটি বুলেট প্রুফ কাঁচের মধ্যে এটি রাখা হয়েছে। কেন মোনালিসা ছবি এত রহস্যময় সে ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মোনালিসার ব্যাপারে বলতে গেলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সম্পর্কে বলতেই হবে। ১৪৫২ সালে ইটালিতে জন্মগ্রহন করেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। ওনার টাইটেল কিন্তু ভিঞ্চি ছিলনা, আসলে ওনার বাবার পরিচয় জানা যায়নি সেজন্য উনি যে ভিঞ্চি শহরে জন্মেছিলেন সেই শহরের নামেই ওনার টাইটেল ভিঞ্চি রাখা হয়েছে। ১৪ বছর বয়সে ইটালির এক স্টুডিও থেকে তার যাত্রা শুরু। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি শুধু কিংবদন্তি চিত্রকারই ছিলেন না তিনি ইন্জিনিয়ার ও মিউজিসিয়ানও ছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ও শিল্পকে একসাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন বিজ্ঞান ও শিল্প একে উপরের পরিপূরক। তিনি তাঁর আঁকার মাধ্যমে শিল্পকে ব্যাখা করতেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যেসময় ছিলেন সেটা ইউরোপের ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষন সময়। কারন সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের পতন হচ্ছিল অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের উদয় হচ্ছিল, একে রেনেসাঁ সময়ও বলা হয়। ভাসারি নামে এক চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যক ১৫৫০ সালে তার বই লাইফ অফ মোস্ট এক্সিলেন্ট পেন্টার প্রকাশ করেন সেখান থেকেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও মোনালিসার সম্পর্কে জানা গেছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিভিন্ন রাজার কাছে তাদের ছবি এঁকেছেন। ১৪৮২ সালে তিনি মিলান যান, সেখান ডিউকের কাছে অনেক ছবি আঁকেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দি লাস্ট সপার। ১৪৯৯ সালে ফ্রান্স ইটালির যুদ্ধ হয়। ফ্রান্সের রাজা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে তার সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। অবশেষে ১৫১৯ সালে এই কিংবদন্তি শিল্পির মৃত্যু হয়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার অমর সৃষ্টি মোনালিসা ছবি আঁকা শুরু করেন ১৫০৩ সালে এবং ওনার মৃত্যু অবধি অর্থাৎ ১৫১৯ অবধি ১৬ বছর ধরে এই ছবি এঁকেও তিনি পুরো ছবি শেষ করতে পারেননি। অর্থাৎ মোনালিসা ছবি এখনও অসম্পূর্ন। মোনালিসা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মহিলা হালকা হাসছেন। এই ছবিতে মহিলাটি কে সেটা নিয়ে প্রথমদিকে অনেক কথা ওঠে। অনেকে বলেন এটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নিজেই নিজেকে একজন মেয়ের রূপে কল্পনা করে বানিয়েছেন আবার অনেকে বলেন এটি ওনার মায়ের বা প্রেমিকার। তবে শেষ পর্যন্ত অনেক গবেষনার পর একটি চিঠি উদ্ধার হয় যাতে লেখা আছে ১৫০৩ সালে ফ্রান্সের এক নামী রেশম ব্যাবসায়ী ফ্রান্সিসকো ডেল জিওকন্ডো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে তাঁর স্ত্রী লিসার একটি ছবি আঁকতে অনুরোধ করেন, এটি সেই ছবি।
ইটালিয়ান ভাষায় মোনালিসা শব্দের অর্থ মাই লেডি। ১৭৯৭ সাল থেকে এই ছবি ফ্রান্সের লুভ্যের মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্টের এই ছবি এতটাই পচ্ছন্দ হয়েছিল যে তিনি তার বেডরুমে এই ছবি রেখে দিয়েছিলেন। ১৯১১ সালে এই ছবি চুরি হয়েও গেছিল পরে তা উদ্ধার করা হয়েছিল। এই ছবি চুরি করার জন্য সন্দেহ করা হয়েছিল তৎকালীন সময় কালের আরও এক বড় শিল্পী পাবলো পিকাসোর উপর। পরে জানা যায় লুভের মিউজিয়ামেরই একজন কর্মচারী এটি চুরি করেছিল, সে ইটালির বাসিন্দা ছিল। তার মনে হয়েছিল এই ছবি ইটালির সম্পদ সেজন্য সে এটা ফ্লোরেন্স শহরের মিউজিয়ামে এটা নিয়ে যায় দুই বছর পর। তখনই তাকে গ্রেফতার করা হয়। ছয় মাস জেল হয় তার, তবে ইটালির সরকার তার দেশ ভক্তির জন্য ইটালির সরকার তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। অবশেষে ১৯১৪ সালে এই ছবি আবার লুভের মিউজিয়ামে ফিরিয়ে আনা হয়।
এই ছবি নষ্ট করতে ছবি লক্ষ করে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়েছিল, পাথর ছোঁড়া হয়েছিল। যার জন্য এই ছবি অত্যন্ত নিরাপত্তায় রাখা হয়।
এবার মেনালিসা সম্পর্কে বিশেষ কীছু ব্যাপার জানা যাক। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসা আঁকতে ৪০ রকমের ব্রাশ ব্যাবহার করেছিল, প্রত্যেকটি ব্রাশের তুলি চুলের থেকেও পাতলা ছিল। সুয়ামোটা পদ্ধতিতে এই ছবি আঁকা হয়েছিল অর্থাৎ এই ছবিতে কোন আউটলাইন ব্যাবহার করা হয়নি। এটাও বলা হয় মোনালিসার চোখে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কীছু কোড এঁকে গেছেন যাকে দি ভিঞ্চি কোডও বলা হয়, এই নিয়ে হলিউডে সিনেমাও তৈরি হয়েছে। মোনালিসা ছবির সবচেয়ে বড় রহস্য তার হাসি। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে মোনালিসার হাসি পাল্টে যায়। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায় মোনালিসা হাসছে কিন্তু একদম কাছে গিয়ে ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায় মোনালিসার ঠোঁট একটু নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ছে যা দেখে মনে হয় মোনালিসা বিষন্ন। নেদারল্যান্ডস একদল গবেষক গবেষনা করে দেখেছেন মোনালিসা ছবিটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এমনভাবে এঁকেছেন যাতে একই সাথে কোন মেয়ের হাসি, দুঃখ, অভিমান, ভয় সবই প্রকাশ পায়। ২০০০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডঃ মার্গারেট জানান মোনালিসার হাসি পাল্টায় না বরং মানুষের মন পরিবর্তন হয়ে যায়।
বলা হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি দুটি মোনালিসা ছবি এঁকেছিলেন কিন্তু তবুও এর কোন প্রমান পাওয়া যায় নি। মোনালিসা ছবিতে মহিলাটির কোন ভ্রু নেই, পাস্কাল কটি নামে একজন গবেষক উচ্চ আলোতে এই ছবিটি রেখে পরীক্ষা করে দেখান লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ভ্রু এঁকেছিলেন ছিলেন কিন্তু পাঁচশো বছর ধরে ধীরে ধীরে এই ভ্রু উঠে গেছে। এই ছবি দেখে অনেকে বলেন অর্ধ নারী, অর্ধ পুরুষ মূর্তি। এখনকার দিনে উন্নত মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপের সাহায্যে ছবিকে কাস্টমাইজ করা হয়। কিন্তু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে ব্রাশের সাহায্যে একটি পরিবেশ মানুষের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে সেটা সম্পূর্ণ দেখিয়েছেন। এই ছবিটি কোথায় আঁকা হয়েছে কেউ জানে না, তবে বেশীরভাগ গবেষকের ধারনা ফ্লোরেন্সে আঁকা হয়েছে। খুব ভালো ভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই ছবিটির চোখ ও আশেপাশে বেশ কিছু লেটার পাওয়া গেছে। পাশাপাশি রেখে দেখা যায় এতে ইটালিয়ান ভাষায় লেখা আছে লা রিসপোস্তা সি ত্রোভা কুই যার অর্থ
এখানেই উত্তর রয়েছে। এই মোনালিসা সম্পর্কে এত কথা বলা হচ্ছে এগুলো কারও মুখের কথা নয়, ইংল্যান্ড, কানাডা, ইটালির বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনা করা তথ্য। ২৩ জুন, ১৮৫২ সালে লুইক মাসপেরো নামে ফ্রান্সের এক যুবক প্যারিসের একটি বহুতল হোটেল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে কারন সে মোনালিসার হাসি দেখে মোনালিসাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। সে একটি চিঠি লিখে মোনালিসার প্রতি তার ভালোবাসা ব্যাক্ত করেছে। মোনালিসার ঠোঁট বানাতেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ১২ বছর সময় লেগেছিল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি একজন বড় সাহিত্যক ছিল কিন্তু তিনি তার কোন বইয়ে মোনালিসার কথা উল্লেখ করেননি এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মোনালিসাকে তার জায়গা থেকে ছয়বার সরানো হয়েছিল কারন যাতে জার্মান নাজি বাহিনীর হাতে এটা না চলে যায়। মোনালিসাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবি বলা হয়। ১৯৬২ সালে এর দাম ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার, বর্তমানে এর দাম প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা, তবে এটি বিক্রির জন্য নয়। প্যারানরমাল ক্রুসিবেল নামে একটি ওয়েবসাইট দাবী করে এই ছবিতে এলিয়েনের ছবি আছে কারন বাঁদিক দিয়ে ছবিটি আয়নায় দেখলে একটি এলিয়েনের আকৃতি তৈরি হয়। মোনালিসা ছবিটি এতটাই আকর্ষনীয় যে আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক তাকে প্রেমপত্র লেখে, ফুল পাঠায়।