পৃথিবী

কেন এতো সমর্থন রয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের?

নিজস্ব সংবাদাতা:পূর্বে সামরিক ড্রোনের সাফল্যের পর ইউরোপীয় সামরিক জোট ন্যাটো ও পশ্চিমের মিত্র দেশগুলোর অসহযোগিতাকে আর কোনো রকম আমল না দিয়ে সবাইকে অবাক করে এবার মনুষ্যবিহীন এক এ্যাসল্ট সমুদ্রযান তৈরীর চমকপ্রদ খবর দিয়েছে তুরস্ক। ইউরোপে এই মুহূর্তে তুরস্ক ও গ্রীস, ফ্রান্স জোটের মধ্যে পূর্ব ভুমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগরে খনিজ অনুসন্ধান নিয়ে বিরোধ পৌঁছেছে তুঙ্গে। অস্থিতিশীল এই পরিস্থিতির মধ্যে তুরস্কের আবিষ্কৃত মনুষ্যবিহীন যুদ্ধযান যে এবার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনবে তাতে নেই কোনো সন্দেহ। তুরস্কের এক দৈনিক পত্রিকার খবর অনুযায়ী গত বছরের ২৮ অক্টোবর  ‘উলাক’ নামক এই যুদ্ধযানটিকে এরেস শীপইয়ার্ডে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য জলে ভাসানো হয়েছিলো। 

তুরস্কের সামরিক বিজ্ঞানীরা আত্মবিশ্বাসী ‘উলাক’ (আর্মড আনমেনড সারফেস ভেহিকল) অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্র পথে যুদ্ধে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চলেছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইলেকট্রনিক জ্যামিং সিসেস্টমস, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত অত্যাধুনিক এই যুদ্ধজাহাজ ঘন্টায় ৬৫ কিলোমিটার বেগে চলতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধযানে থাকা সাবমেরিন ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নিশানায় আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে। এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী তুরস্কের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আন্দালু’র সহকারী যান হিসেবে ভবিষ্যতে এই উলাক বিশেষ ভুমিকা পালন করতে চলছে। প্রসঙ্গত, ন্যাটো জোটের অন্যতম সদস্য হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত বাকি দেশগুলো বরাবরই  তুরস্ককে কৌশলগত সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। সমস্যার সূচনা এটিকে কেন্দ্র করেই।

আজ থেকে ১৮ বছর আগে রেজিপ তাইয়েপ এরদোয়ান ক্ষমতায় এসে থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় সমস্ত শর্ত হটিয়ে নিজ দেশের স্বাধীন সার্বভৌম নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়ে উঠলে তুরস্কের সাথে মতবিরোধ শুরু হয় ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত বাকি দেশগুলোর। পশ্চিমী দেশগুলোর ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে তিনি দেশের অভ্যন্তরেই সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। যার ফলশ্রুতি বর্তমানে তুরস্ক নিজেই দেশের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয় অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের যোগান দেয়। আর তুরস্ক যে শুধু অস্ত্র নিজের প্রয়োজনীয় অস্ত্র নির্মাণ করছে তাই নয়। নিত্য নতুন অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র রফতানিতেও ইতোমধ্যে ইসরাইল ও রাশিয়ার মত দেশকে পাল্লা দিতে আরম্ভ করেছে তুরস্ক। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর তার বিভিন্ন যুগান্তকারী নীতির সাহায্যে তুরস্কের অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি আসেলসান এবং  টিএআই (টার্কি এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি) বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ১০০টি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানীর মধ্যে যথাক্রমে ৫৪ এবং ৮৪ নম্বরে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া তুরস্কের অন্যান্য  কোম্পানিগুলির মধ্যে জাহাজ নির্মাণে এসটিএম, সাঁজোয়া যান নির্মাণে এফএনএসএস, ড্রোন নির্মাণে বেয়ারআকতার,  রকেটসান, হাভেলসান, বিএমসি প্রভৃতি বিশেষ প্রসিদ্ধ।  

সেদেশের কাসিমপাশা অঞ্চলের এক কালের বিখ্যাত ফুটবলার এরদোয়ান দৃঢ়চেতা রাজনীতিবিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ২০০৩ সালে। সেই বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এবং পরবর্তীতে ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে তুরস্কের পরিচালনা কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি। সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখা থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থাসহ  নানা ক্ষেত্রে একের পর এক বিভিন্ন যুগান্তকারী সংস্কার এনেছেন তিনি। তুরস্কের জনগন বারবার এরদোয়ানের ওপর আস্থা রাখলেও, ২০১৬ সালের ১৬ই জুলাই হঠাৎ সেনা অভ্যুত্থানে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে তুরস্ক। রাস্তায় রাস্তায় নামে ট্যাংক। সৈন্যবাহিনীর কিছু কুচক্রী সেই সময় এরদোয়ানকে হত‌্যার বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালালেও  সফল হয়নি তারা। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নানা উন্নতিসাধনের মধ্যে দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মন জিতে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন এরদোয়ান। তার সমর্থনে ট্যাংকের সামনে শুয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে দেখা যায় বহু নাগরিককে।  রক্তার্ত এই অভ্যুত্থানে নিহত হন প্রায় ৩০০ নাগরিক,  আহত হন ২ হাজারেরও বেশী। তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে বেসামরিক অসংখ্য মানুষদের হত্যা করে কুর্দ সন্ত্রাসবাদীরা। সেই সময় রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা হলে এই সেনাঅভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়ার অভিযোগে আঙ্গুল ওঠে আমেরিকা সহ ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর দিকেই। তুরস্ক দাবি করে, তুরস্কের দ্রুত উন্নতি এবং ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর ছত্রছায়া থেকে সে দেশের বেরিয়ে আসা রুখতেই আমেরিকা চেয়েছিলএরদোয়ানকে গদি ছাড়া করতে। আমেরিকা এই দাবি স্বীকার না করলেও সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক তুরস্কের সুফিবাদের নেতা ফতেউল্লা গুলেনকে আমেরিকা তুরস্কের হাতে হস্তান্তরে রাজি না হওয়ায় তুরস্কের অভিযোগই উল্টে আরও দৃঢ় হয়েছে। শুধু আমেরিকাই নয় তুরস্কের পার্লামেন্ট ভবনে এফ-১৬ বিমান থেকে বোমা বর্ষনের সঙ্গে জড়িত থাকা বিভিন্ন সেনা অফিসারদের আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলো ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশ গ্রীস ও জার্মানী। 

তবে, সেনা অভ্যু্থানের ঘটনাতে ভয়ে থেমে না গিয়ে প্রবল জনসমর্থন নিয়ে লৌহমানব প্রেসিডেন্ট রেজিব তাইয়েপ এরদোয়ান এই ঘটনার পর বরং উল্টে সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্যাপক সংস্করণ করে গোটা বিশ্বে আলোচনায় এসেছেন। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য আগে  ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর চাপিয়ে দেওয়া নীতির কারণে শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশী মুসলিম দেশবাসী সম্পন্ন মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের মানুষের ইসলামী রীতিনীতি পালন ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। দাঁড়ি রাখা থেকে শুরু করে মহিলাদের হিজাব পরা, মসজিদে যাওয়া এই সব কিছুর ওপরেই ছিল নিষেধাজ্ঞা। এমনকি ১৯৯৮ সালে শুধুমাত্র ইসলামি কবিতা পাঠ করার কারণে এরদোয়ানকেও চারমাস কারাবাস করতে হয়েছিল। তুরস্কের সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট বিচার ব্যবস্থা অতীতে ঐতিহাসিক হাগিয়া সোফিয়া মসজিদটিকে পরিবর্তিত করে জাদুঘরে পরিণত করেছিলো। সেকুলারিসমের নামে একপ্রকার ভাবে তুরস্কের জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ব্যার্থ সেনা অভ্যুত্থানের পরে বিচার ব্যবস্থা ও সামরিক বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর মাধ্যমে এরদোয়ান এই সকল ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। তিনি যে শুধু নতুন করে ঐতিহাসিক হাগিয়া সোফিয়া মসজিদটি চালু করেছেন তাই নয় নিজে নামাজ পড়ে পুনরায় এখানে মুসলমানদের নামাজ পড়ার বিধানটি ও চালু করেছেন। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ নামাজ পড়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম ক্যামলিকা নামক মসজিদ নির্মাণ করেন তিনি। এই মসজিদের বিশেষত্ব হলো, এখানে একসঙ্গে ৬৩ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবেন। এমনকি মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্যেও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। 

এরদোয়ান তুরস্কের রাজনীতি এবং বিচার ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ পুরোপুরি বিলোপ করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশকে যথাসম্ভব পশ্চিমী প্রভাব মুক্ত করে তিনি নির্দ্বিধায় ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির বিরুদ্ধে  অসহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন। তুরস্ককে কোনো পশিমি দেশের তল্পীবাহক নয় বরং এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য প্রতিনিয়ত খেটে চলেছেন তিনি। দেশের সুন্নী মুসলিম ঐতিহ্য তুলে ধরার সাথে সাথে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলির সংকটেও পাশে এসে দাঁড়ান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। 

সামরিক অস্ত্র আমদানিকারক দেশ থেকে এরদোগানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তুরস্ক এখন অস্ত্র রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তুরস্কের বছরে প্রায় ২.৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমরাস্ত্র বিভিন্ন দেশে রফতানি করে। শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত নানা অত্যাধুনিক যুদ্ধযানও তৈরি করছে তুরস্ক। বর্তমানে রাশিয়া থেকে আমদানি করা আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র এস-৪০০ এর ওপর পরীক্ষা চালানোর জন্য তুরস্কের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা চেপেছে ঠিকই তবে তাতে বিশেষ আমল দিতে নারাজ তুরস্কের রাষ্ট্রপতি। সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই আমেরিকাকে নিয়ে এক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে তুরস্কে। তাই আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞাকে সেদেশের অনেকেই তুরস্ককে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করার এক উপায় হিসাবেই দেখছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি এর আগে, গ্রীসও রাশিয়ার কাছ থেকে এই একই ধাঁচের ক্ষেপণাস্ত্র এস-৩০০ ক্রয় করেছিলো কিন্তু, তখন আমেরিকা কোনো রকম বাঁধার সৃষ্ঠি করেনি। এমনকি রাশিয়ার ভারতকে বিক্রি করা এই একই সংস্করণের এস-৪০০ এর ক্ষেত্রেও আমেরিকা চুপ থাকবে বলেই তাদের দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.