পৃথিবী

পাইরেটস অফ ক্যারবিয়ানস কোন দেশের মানুষদের বলা হয় জানেন? কেন এরা জলদস্যু হওয়ার পথ বেছে নেয়?

রাজেশ রায়:— হর্ন অফ আফ্রিকার একটি ছোট দেশ হচ্ছে সোমালিয়া। আফ্রিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটির ইতিহাস অত্যন্ত করুন। একের পর এক গৃহযুদ্ধের কারনে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়। সোমালিয়ার কথা বলা হলেই প্রথমেই মাথায় আসে এখানকার কুখ্যাত জলদস্যুদের কথা। জলদস্যু বা পাইরেটস শব্দটা শুনলেই প্রথমেই মাথায় আসে হলিউডের বিখ্যাত শিল্পী জনি ডেপ এবং তার পাইরেটস অফ ক্যারবিয়ানস সিনেমার কথা। কিন্তু এখানে কোন কল্প কাহিনী বলা হচ্ছে না বরং দুর্ধর্ষ সোমালিয়ান জলদস্যুদের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দেশটি এমন ছিলনা মোটেও। এখানকার সরকার কীভাবে চলে কিংবা কেনইবা মানুষ এখানে জলদস্যু হবার পথ বেছে নেয় তা জানলে রীতিমতো অবাক হতে হয়।

ভারতের পশ্চিমে রয়েছে আরব সাগর যার পরেই আসে এডেন উপসাগর। ইয়ামেন ও সোমালিয়া এডেন উপসাগরের দুই ধারে অবস্থিত। সোমালিয়ার রাজধানী হচ্ছে মোগাদিশু। তিনটি দেশের সাথে সোমালিয়ার সীমানা রয়েছে। জীবুতি, কেনিয়া ও ইথিওপিয়া। তবে সীমান্ত নিয়ে ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। সোমালিয়ার লোকেদের বিশ্বাস তাদের দেশের আয়তন অনেকটাই ছোট সেজন্য তারা গ্রেটার সোমালিয়ার স্বপ্ন দেখে। দীর্ঘদিন ধরে সোমালিয়া ইউরোপীয়ানদের অধীনে ছিল। অর্ধেক সোমালিয়া ছিল ব্রিটিশদের দখলে এবং অর্ধেক সোমালিয়া ছিল ইটালির অধীনে। সোমালিয়ার মুদ্রা হচ্ছে সোমালি সিলিং। আফ্রিকান দেশ গুলোর মধ্যে সোমালিয়ার উপকূলভাগ বিশাল বড়। সোমালিয়ার পাশে রয়েছে জীবুতি যেখানে আমেরিকা, ফ্রান্স, চীন অনেক দেশের বেস রয়েছে। এই কারনে সোমালিয়া স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যার কারনে অতীতে অনেক সোমালিয়ান সাম্রাজ্য যেমন আজুরান সাম্রাজ্য, আদাই সাম্রাজ্য এবং গিলেডি সাম্রাজ্য এখানে বানিজ্য নিয়ন্ত্রন করত।

১৯৬০ সালের ১ জুলাই সোমালিয়া স্বাধীনতা পায়। কিন্তু মাত্র নয় বছরের মধ্যে ১৯৬৯ সালে সোমালিয়ায় সরকার পরিবর্তন হয়। মোহম্মদ সিয়াদ বারে সোমালিয়ার ক্ষমতা দখল করে। এই সময় বিশ্বে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ হচ্ছিল। যার জন্য একপক্ষ যে দেশকে সমর্থন করত আবার অন্যপক্ষ সেই দেশের সরকার ভেঙে দিতে চাইত। সোমালিয়াতেও সরকার পরিবর্তনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন দায়ী করা হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে সোমালিয়া ইথিওপিয়াকে আক্রমন করে, এই যুদ্ধের নাম অরডিগান যুদ্ধ। সেসময় ইথিওপিয়ার থেকে সোমালিয়ার মিলিটারি ক্ষমতা বেশী ছিল যার জন্য সোমালিয়ার ধারনা ছিল খুব সহজেই ইথিওপিয়ার বেশ কীছু অংশ দখল করে নেওয়া যাবে। কিন্তু ইথিওপিয়ার সাধারন মানুষই যুদ্ধ করে যাতে সোমালিয়ার প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়। উপরন্তু উত্তর সোমালিয়াতে ইথিওপিয়ান বিপ্লবীরা এসে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলে। ১৯৮০ এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মোহম্মদ সিয়াদ বারের ঝামেলা তৈরি হয় যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইথিওপিয়াকে সমর্থন করতে থাকে। এর ফলে ১৯৮৮ সালে সোমালিয়া ইথিওপিয়ার সাথে শান্তি চুক্তি করতে বাধ্য হয়।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস দল সোমালিয়াতে রাষ্ট্রপতি বারেকে জোর করে বের করে দিয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু ততদিনে সোমালিয়া একটি ব্যার্থ দেশে পরিনত হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে একনায়কতন্ত্রের কারনে সোমালিয়াতে ততদিনে অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সোমালিয়ার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। সোমালিয়ান সরকারের দেশের উপর পুরো নিয়ন্ত্রন ছিলনা। সোমালিয়ান সরকারের হাতে প্রধানত দক্ষিন সোমালিয়ার নিয়ন্ত্রন ছিল। সোমালিয়াতে রীতিমতো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। উত্তর সোমালিয়ার একটি জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্বে সোমালিল্যান্ড বলে একটি জায়গা সোমালিয়া থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষনা করে। এই জায়গা সোমালিয়ার ২৭ শতাংশ, এই অঞ্চল আজও সোমালিয়ার থেকে আলাদা। তবে সোমালিয়ার অবস্থার জন্য পুরো দোষ মোহম্মদ সিয়াদ বারেকে দেওয়া যাবে না কারন আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে প্রায়ই সেনা শাসন জারি হয়। 

দারিদ্রতা চিরকালই আফ্রিকার সঙ্গী। ভৌগলিক ভাবে সোমালিয়ার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রাকৃতিক সম্পদ এমন কীছু বেশী নেই এই দেশে। যার জন্য এখানে খাদ্য সংকট তীব্র সবসময়ই এবং লোক অনাহারের শিকার এখানে। ১৯৯২ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী সোমালিয়াতে অপারেশন রিস্টোর হোপ শুরু করে যাতে এখানের মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই মিশন পুরোপুরি ব্যার্থ হয় কারন খাবারের বেশীরভাগ জঙ্গি সংগঠনের হাতে চলে যায়। ১৫ মাস এই মিশন চলার পর জাতিসংঘ ও আমেরিকা তাদের সেনা এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তবে এই অভিযান চলাকালীন জঙ্গিদের সাথে সংঘর্ষে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর ২৪ জন সেনা মারা যায় এবং এরা সকলেই পাকিস্তানি ছিল। এরপর থেকে সোমালিয়াতে কখনও কোনও স্থায়ী সরকার আসেনি। 

২০০৮ সালে সোমালিয়াতে আল সাবাব নামে জঙ্গি সংগঠনের নাম উঠে আসে যাদের আল কায়েদার সাথে যোগাযোগ আছে। আসলে যখন কোন দেশে বেকারত্ব, অনাহার থাকে তখন জঙ্গি সংগঠন খুব সহজেই মানুষের ব্রেন ওয়াশ করতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় সোমালিয়া সবসময় উপরে থাকে। আসলে এর জন্য দায়ী সোমালিয়ার ৪.৫ সিস্টেম। এটা বড়ই অদ্ভুত একটা সিস্টেম সোমালিয়াতে আছে। আফ্রিকাতে মানুষজন বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত যাদের ট্রাইব বলা হয়। সোমালিয়াতে ৯০ শতাংশ মানুষ সুন্নি মুসলিম ভুক্ত কিন্তু তাও তাদের কাছে নিজেদের জাতি আগে। সোমালিয়াতে অনেক জাতি বা ট্রাইব আছে তবে মূলত হাওয়ি ও দারুদ নামে দুটি ট্রাইব এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রধানত সরকারি দপ্তরের উচ্চপদে চাকরী, এমনকী প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এই দুই ট্রাইব থেকেই নির্বাচিত হয়। সোমালিয়াতে এটা দেখা হয়না কার শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন বরং এটা দেখা হয় কে কোন ট্রাইবের। এই কারনে সোমালিয়ানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ বলতে কীছুই নেই। সবাই নিজ নিজ জাতির কথা ভাবে। ভারতে যেমন আমরা ভারতীয় বলে গর্ববোধ করি কিন্তু সোমালিয়াতে জাতীয়তাবাদ নিয়ে বেশী কেউ বললে তাকে প্রকাশ্যে খুন করে দেওয়া হয়।

যখন মানুষের কাছে পয়সা উপার্জনের কোন ব্যবস্থা থাকবে না তখন মানুষ বাধ্য হয়ে চুরি করে। সোমালিয়ার অবস্থাটাও তাই। আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত ইংরেজি সাত অক্ষরের মত দেখতে সোমালিয়াতে সবচেয়ে লম্বা উপকূল রয়েছে যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩৩৩ কিলোমিটার। সোমালিয়ার ১৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ৭১ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে অর্থাৎ প্রতি দশজনের মধ্যে সাতজন লোক গরীব এখানে। এখানে বেকারত্ব ৯০ শতাংশ। একজন সোমালিয়ান লোক গড়ে ৫৬ বছর বাঁচে এবং মানুষ এখানে দিনে ১ ডলারেরও কমে জীবনযাপন করে। প্রতি চারজনের মধ্যে একজন ব্যাক্তি অনাহারে থাকে এখানে। পাঁচ বছরের নীচে থাকা অন্তত তিন লাখ শিশু এখানে অনাহারে ভোগে। এই মহূর্তে প্রায় ১০ মিলিয়ন সোমালিয়ান লোকের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় সাহায্য প্রয়োজন। এখনও পর্যন্ত প্রায় ১.৪ মিলিয়ন সোমালিয়ান লোক দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। সোমালিয়ার বিশাল উপকূল ভাগ মাছ ধরার জন্য আদর্শ ছিল। এখানে টুনা, স্কুইড ও সর্ড ফিস প্রচুর পাওয়া যেত তাই দিয়েই কীছু মানুষ জীবনযাপন করত কিন্তু ধীরে ধীরে এখানে অন্যান্য দেশের মাছুড়ে ট্রলার এসে মাছ ধরতে থাকে এবং এই ট্রলার গুলো বছর বছর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ ফেলতে থাকে এখানে সেই কারনে এখানে মাছও কমে যেতে থাকে। 

সোমালিয়ান মানুষদের অভিযোগ শোনার মতন কেউ ছিলনা কারন ১৯৯১ সালে সোমালিয়ান নেভিকে তুলে দেওয়া হয়। তাই সোমালিয়ানরা নিজেরাই এই সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নেয়। যার কারনে জলদস্যু গড়ে ওঠে এখানে। বিশ্বের জলদস্যুদের রাজধানী বলা হয় সোমালিয়াকে এই জন্য। ১৯৯৮ সাল থেকে এখানে প্রথম জাহাজ হাইজ্যাক করা শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে একটি মাছুড়ে ট্রলার হাইজ্যাক করে ৩ লাখ ডলার পায় জলদস্যুরা। এই টাকা দিয়ে তারা স্পিড বোট ও একে-৪৭ ক্রয় করে। মাছ ধরার ট্রলারের পাশাপাশি এবার বানিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক করার কাজও শুরু করে এরা। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ছোট দূরত্ব হচ্ছে এডেন উপসাগর দিয়ে। প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ জাহাজ তেল, গ্যাস সহ অন্যান্য জিনিস নিয়ে এখান দিয়ে যাতায়াত করে। পাইরেটসরা প্রথমে জাহজকে ঘিরে ফেলে তারপর জাহাজের সদস্যদের বন্দি বানিয়ে মুক্তিপন আদায় করে। 

২০০৮ সাল থেকে ২০১১ সাল অবধি এভাবে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করে জলদস্যুরা। এত বিশাল উপার্জন দেখে সোমালিয়ায় জলদস্যু একটি ব্যাপক পেশায় পরিনত হয়। সোমালিয়ায় প্রায় ৩০ টির মতন স্কুলে বাচ্চাদের জলদস্যু হবার প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু হয়। ২০১১ সালে সোমালিয়ান জলদস্যুরা ৩২ টি জাহাজকে আটক করে এবং ৭৩৬ জন জাহজের সদস্যকে হত্যা করে। এডেন উপসাগরের একদিকে ইয়ামেন অবস্থিত। ইয়ামেনে আল-কায়েদা, আই এস আই এসের মতন জঙ্গি সংগঠন গুলোর আখড়া। এরা সোমালিয়ান জলদস্যুদের সাথো যুক্ত আছে কারন জঙ্গি সংগঠনোর অনেক অস্ত্র সাপ্লাই জলপথে হয়। তবে ২০১১ এর পরে জাতিসংঘ আরবসাগরে পাইরেসিকে শেষ করার জন্য অপারেশন অ্যাটলান্টা শুরু করে যাতে আমেরিকা, ন্যাটো, চীন, ভারত, পাকিস্তান সহ ৪০ টি দেশের নেভি এখানে মোতায়েন রয়েছে। এখনও অবধি ৬-৭ হাজার জলদস্যুদের গ্রেফতার করা হয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন জেলে রয়েছে। ২০১৩ সালের পর সোমালিয়ান জলদস্যুদের ঝামেলা অনেকটাই কম করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.