ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও জাপান মিলে কেন জোট হচ্ছে?
রাজেশ রায়:– ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যতদিন যাচ্ছে ইউরোপীয়ান দেশ গুলো তত এখানে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। প্রথমেই জানা দরকার ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল কোনটা। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলিত অংশের আশেপাশের স্থানকে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল বলে। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার উপকূল, পশ্চিম এশিয়ার উপকূল, ভারতীয় উপকূল, দক্ষিন চীন সাগর এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ার উপকূল। এই এলাকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হল কী করে! বিগত পাঁচ বছরে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলর গুরুত্ব বহুগুন বেড়ে গেছে। ভারত মহাসাগরের কারনে ভারত এখানে যুক্ত। বিতর্কিত চীন সাগর নিয়েও এখানে চীনের সাথে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোর ঝামেলা আছে। চীনের সাথে সীমান্ত নিয়ে জাপানেরও ঝামেলা রয়েছে যার কারনে আমেরিকাও রয়েছে এখানে এবং বিগত কয়েক বছর ধরে ইউরোপীয়ান দেশ গুলো এখানে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে। এইজন্য সামরিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য বিশ্বে পরবর্তী রাজনৈতিক ঝামেলা দক্ষিন চীন সাগর নিয়েই হবে। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে কাউন্টার করার জন্য ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও জাপান এই চারদেশ মিলিয়ে একটি জোট তৈরি হয়েছে যাকে কোয়াড বলা হয়। এছাড়া আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেও আকুস নামে একটি জোট গঠন করা হয়েছে যাতে অস্ট্রেলিয়াকে তার সুরক্ষার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন দেওয়া হবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রনালী অবস্থিত যার কারনে বিশ্বের বেশীরভাগ সমুদ্র বানিজ্য এখান দিয়েই হয় তাই ধীরে ধীরে ইউরোপীয়ান দেশগুলোও এখানে আসছে।
আমেরিকা, জাপান, ব্রিটেন তো এখানে আগে থেকেই ছিল তবে এখানে সম্পূর্ণ নতুন সংযোজন ফ্রান্স ও জার্মানির। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের কীছু দ্বীপ আছে যেমন রিইউনিয়ন দ্বীপ, পলিনেশিয়ান দ্বীপ সেজন্য ফ্রান্সের জন্য এই এলাকা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্য ভারত ও ফ্রান্স এখানে যৌথভাবে রয়েছে নিরাপত্তার জন্য। ব্রিটেনের সংসদে ইন্দো প্যাসিফিক নিয়ে বিশেষ প্রস্তাব পাশ হয়েছে। তবে এদের মধ্যে জামানি এই এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন। পীচ ব্ল্যাক এক্সারসাইজ কী এবং ইন্দো প্যাসিফিকে ইউরোপীয়ান দেশগুলো কেনইবা এত আগ্রহী এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
পিচ ব্ল্যাক এক্সারসাইজ বায়ুসেনার এক্সারসাইজ। রয়েল অস্ট্রেলিয়ার বায়ুসেনা এর আয়োজন করে। ১৯৮১ সালের ১৫-১৬ জুন এই অনুশীলন প্রথম শুরু হয়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়ার বায়ুসেনারই বিভিন্ন ভাগ এতে অংশ নিয়েছিল। ১৯৯০ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ভাবে এই অনুশীলন শুরু হয় এবং অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে এই অনুশীলন হয়েছিল। ধীরে ধীরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশ গুলো এতে যুক্ত হয়। মূলত এয়ার টু এয়ার, অ্যাটাক ও ডিফেন্সের অনুশীলন হয় এতে। প্রতি দুই বছর অন্তর এই অনুশীলন হয় তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারনে এটি বন্ধ ছিল। ২০২৩ সালে ১৯ আগস্ট পিচ ব্ল্যাক ২০২২ শুরু হয়েছিল যা ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছে। বিশ্বের ১৭ টি দেশের ২৫০০ বায়ুসেনার সদস্য এবং ১০০ এর বেশী বিমান এই অনুশীলনে যোগ দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও ভারত, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, থাইল্যান্ড ও ব্রিটেন মিলিয়ে নয়টি এশিয়ান, চারটি ইউরোপীয়ান, দুটি উত্তর আমেরিকান ও দুটি ওশিয়ানিয়ান দেশ এতে অংশ নিয়েছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে থেকে জার্মানি ও ফ্রান্স এতে অংশ নিয়েছে। জাপান, জার্মানি ও দক্ষিন কোরিয়া প্রথম বারের জন্য এই অনুশীলনে অংশ নিয়েছে। জার্মানি এই জন্য সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারন সাধারনত ইউরোপের অর্থনৈতিক জায়েন্ট জার্মানির চীনের সাথে খুব ভাল বানিজ্যিক সম্পর্ক আছে। সুতরাং জার্মানির এই অনুশীলনে যোগ দেওয়ার অর্থ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিবর্তন। উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় রয়েল অস্ট্রেলিয়ান বায়ুসেনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বেস ডারউইন ও টিন্ডালে সাধারনত এই অনুশীলন হয়। পিচ ব্ল্যাক ২০২২ হয়েছে ডারউইনে। এই অনুশীলনে যোগ দেবার জন্য ফ্রান্সের বায়ুসেনার তিনটি রাফায়েল ১০-১১ আগস্ট ভারতের সুলুর বেসে আসে এবং তারপর ডারউইনের উদ্দেশ্যে উড়ে যায়। ফ্রান্স থেকে ডারউইনের দূরত্ব প্রায় ১৬৬০০ কিলোমিটার। এই দূরত্ব ফ্রান্সের বায়ুসেনা ৭২ ঘন্টায় অতিক্রম করবে ঠিক করে। ফ্রান্স একে পেগাস ২২ নাম দেয়। যার প্রথম ফেজে ফ্রান্সের বিমান ভারতে আসবে এবং পরবর্তী ফেজে ভারত থেকে বিমান অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে চলে যাবে। এর মাধ্যমে ফ্রান্স কত কম সময়ে তাদের মূল ভূভাগ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নিউ ক্যালিডোনিয়াতে যুদ্ধবিমান পাঠাতে পারবে তার একটা নিদর্শন দেখালো। জার্মানি এই অনুশীলনে তাদের বায়ুসেনার তেরোটি বিমান পাঠিয়েছে। যার মধ্যে ছয়টি ইউরো ফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান, তিনটি এ৩৩০ ট্যাঙ্কার বিমান ও চারটি এ৪০০ এম পরিবহন বিমান। জার্মানি শুরু করেছিল রেপিড প্যাসিফিক ২০২২ মোতায়েন যাতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে জার্মানি তাদের বিমান সিঙ্গাপুরে পাঠাবে এবং সেখান থেকে দ্রুত অস্ট্রেলিয়ায় যাবে। এই পুরো অনুশীলনে সমস্ত প্রতিযোগীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয় লাল ও নীল এবং তাদের মধ্যে আকাশ যুদ্ধের অনুশীলন চলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্দো প্যাসিফিকে জার্মানি এই প্রথম এত বড় বিমান বহর পাঠালো। ইন্দো প্যাসিফিক নিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নীতি আছে। কিন্তু কেনইবা অতি চীন ঘনিষ্ঠতা থেকে সরে এসে জার্মানি ইন্দো প্যাসিফিকে যুক্ত হল? ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাক্তন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মর্কেলের নেতৃত্বে ইন্দো প্যাসিফিক নিয়ে তাদের নতুন নীতি তৈরি করে যার নাম ছিল জার্মানি ইউরোপ এশিয়া সেপিং দি ২১ সেঞ্চুরি টুগেদার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অ্যাঞ্জেলা মর্কেলের পর বর্তমান জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ একটি বক্তব্যে বলেন ইন্দো প্যাসিফিকে নিরাপত্তায় তারাও আগ্রহী। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ইন্দো প্যাসিফিক হচ্ছে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ গুলোর ব্যাপার সেখান ইউরোপীয়ান দেশ গুলো আটলান্টিক মহাসাগরের। ইউরোপের রাজনীতি সাধারনত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানি এই তিনটি দেশ কেন্দ্রিকই হয়। সেখানে এত দূর থেকে দেশ গুলো ইন্দো প্যাসিফিকে জড়িয়ে পড়ছে। এর একটা প্রধান কারন চীন। যেভাবে চীন নিজের ক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং দক্ষিন চীন সাগর সম্পূর্ণ নিজের বলে দাবি করছে তাতে ইউরোপীয়ান দেশ গুলো আরও একবার সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন কোন শক্তির জন্মের আশঙ্কা করছে। তাছাড়া সম্প্রতি আমেরিকার স্পীকার ন্যান্সি পেলোসিট তাইওয়ান সফরের পর থেকে যেভাবে চীন তাইওয়ানের বিপক্ষে অনুশীলন শুরু করেছে, তাতে এই অঞ্চলে ইউরোপে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মতন ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। তার জন্যও আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপের শক্তিশালী দেশ গুলো এখানে আসছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারন হচ্ছে ভারত মহাসাগর ও দক্ষিন চীন সাগর আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বানিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ। তবে জার্মানি পরিপূর্ণ ভাবে ইন্দো প্যাসিফিকে যুক্ত হতে পারবে কীনা তা হয়ত সময় বলবে। কারন জার্মান বায়ুসেনার প্রধান জানিয়েছে তারা পিচ ব্ল্যাক এক্সারসাইজে বিমান পাঠাচ্ছে তবে তা চীনকে হুমকী দিতে নয়। আসলে প্রায় ২০ বছরেরও বেশী সময় ধরে জার্মানি ও চীনের ঘনিষ্ঠ বানিজ্যিক সম্পর্ক আছে। ২০২০ সালের পর যদিও বানিজ্য কমে এসেছে তবে ২০১৯ পর্যন্ত দুই দেশের বানিজ্যিক সম্পর্ক অনেক বেশী মজবুত ছিল। ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী জার্মানি চীন থেকে সবচেয়ে বেশী আমদানি করেছে এবং চীনে তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি জার্মানই করে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সমীকরন প্রতিমুহূর্তে বদল হয়। ইন্দো প্যাসিফিকে আমেরিকার পর সবচেয়ে বেশী ভূমিকা আছে ফ্রান্সের। ফ্রান্স ২০১৯ সাল থেকে প্রতিনিয়ত তাদের ফ্রিগেট, নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন দক্ষিন চীন সাগরে পাঠায়। আফ্রিকার উপকূল থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরেও ফ্রান্সের অনেক মিলিটারি ও নেভাল বেস আছে। সেজন্য এই অঞ্চলে জার্মানির থেকে ফ্রান্স সবচেয়ে বেশী বিশ্বাসযোগ্য।