ফিচার আর্টিকেল

প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে অসাধারন রননীতি তৈরি করেছিল। রোম আক্রমণ করেছিল যে জেনারেল

আজ থেকে বহু বছর আগে ২৯ বছর বয়সী এক ব্যাক্তি কোনও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করে তার সামনে সুউচ্চ পর্বতের সারি রয়েছে। সেই ব্যক্তিটিকে ওই পর্বত অতিক্রম করে বিপরীত দিকে যেতেই হত কিন্তু সমস্যা হল ওই ব্যক্তি একা ছিলনা তার পেছনে ছিল ৩৮,০০০ সেনা, ৮০০০ অশ্বারোহী সেনা এবং ৩৭ টি হাতি যুক্ত একটি বড় সেনাবাহিনী। ওই ব্যক্তির উদ্দেশ্য ছিল এই বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ওই সুউচ্চ পর্বতমালা অতিক্রম করা কারন পর্বতের অপর প্রান্তে ছিল রোম। ওই ব্যক্তি রোমে আক্রমন করতেই যাচ্ছিল। কিন্তু আরও একটি বড় সমস্যা ছিল তার সেনারা পর্বত আরোহনে দক্ষ ছিলনা, সবথেকে বড় কথা যদি সেনারা কোনওরকমে পাহাড়ে উঠেও পড়ে তাহলে বড় সংখ্যায় ঘোড়া ও হাতিকে কী করে পাহাড়ে তোলা হবে সেটাও একটা বড় সমস্যা। যে ব্যক্তিটির কথা বলা হচ্ছে তার নাম হ্যানিবেল বার্কা যে কার্থাজিনিয়ার একজন শাসক ও দক্ষ সামরিক জেনারেল ছিল। হ্যানিবেলের সামনে ছিল সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা। এই আল্পস পর্বত অতিক্রম করে রোমে আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করে হ্যানিবেল। 

সময়টা তখন ২১৮ বিসি অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছরের বেশী সময় আগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শাসন করতো দুটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য যার মধ্যে একটি হচ্ছে কার্থাজিনিয়ান সাম্রাজ্য। বর্তমান স্পেনের অধিকাংশ এলাকা এবং উত্তর আফ্রিকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই কার্থাজিনিয়ান সাম্রাজ্য যার শাসক ছিল হ্যানিবেল। আর একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল রোমান সাম্রাজ্য যাদের অধীনে প্রায় পুরো দক্ষিন ইউরোপ ছিল। ইতিহাসে দেখা যায় দুটি বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে কখনও বন্ধুত্ব হয়না কারন উভয়েই নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমানের চেষ্টা করে। ঠিক তেমনই কার্থাজিনিয়ান ও রোমানদের মধ্যেও শত্রুতা ছিল। 

২৬৪- ২৪১ বিসিতে হ্যানিবেলের বাবার সাথে রোমানদের যুদ্ধ হয় যাকে প্রথম পিউনিকের যুদ্ধ বলা হয় যাতে রোমানরা হ্যানিবেলের বাবাকে পরাজিত করে। যার কারনে হ্যানিবেলের বাবার মনে রোমানদের প্রতি ক্ষোভ সবসময় ছিল। মৃত্যুশয্যায় হ্যানিবেলের বাবা তার ছেলেকে জানায় সে যেন রোমানদের উপর বদলা নেয়৷ সেই মতো ২১৮ বিসিতে হ্যানিবেল ঠিক করে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল তারাও জানতো কার্থাজিনিয়ানরা তাদের বিরুদ্ধে আক্রমন করতে পারে যার কারনে রোমান সেনাবাহিনীও যুদ্ধের জন্য প্রস্তত ছিল। হ্যানিবেলেও জানতো সরাসরি রোম আক্রমন করতে গেলে ভয়ানক যুদ্ধ হওয়ার সম্ভবনা বেশী সেই জন্য সে ভাবে এমন জায়গা দিয়ে রোম আক্রমন করবে যা রোমানরাও কল্পনা করতে পারবেনা। আল্পস পর্বতমালা হয়ে আক্রমন করাকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে হ্যানিবেল। ইউরোপের বৃহত্তম ও সর্বোচ্চ পর্বত আল্পস পর্বত আটটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, মোনাকো, স্লোভেনিয়া এবং লিশটেনস্টাইন দেশ জুড়ে প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার লম্বা এই আল্পস পর্বতমালা। রোম জানতো আল্পস পর্বতমালা দ্বারা তারা সুরক্ষিত। সাধারনত কোনও দেশের সীমানায় বিশাল পর্বত বা মহাসাগর থাকলে তা দেশটির জন্য প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে কাজ করে। যেমন ভারতবর্ষ আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত, আবার ভারতের উত্তরে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা যা ভারতের প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে কাজ করে। আজ পর্যন্ত হিমালয় হয়ে ভারতে কোনও আক্রমন হয়নি কারন এত সুউচ্চ পর্বতে কোনও সেনাবাহিনী উঠতে পারবেনা। তেমনই রোমানরাও নিশ্চিত ছিল আল্পস পর্বতমালা হয়ে তাদের উপর কোনও আক্রমন হবেনা। কিন্তু হ্যানিবেল ঠিক করে এই আল্পস পর্বতমালা দিয়েই রোমানদের উপর অতর্কিত আক্রমন করবে।

হ্যানিবেল আল্পস পর্বতমালা হয়ে রোমে যাওয়ার জন্য তার বেশ কিছু গুপ্তচরকে সেনাবাহিনীর আগে পাঠিয়ে দেয় যাদের কাজ ছিল আল্পস পর্বতে সেনা অভিযানের জন্য পথ খোঁজা। হ্যানিবেলের গুপ্তচররা রাস্তা খুঁজে পায় যা ছিল খুব সরু ও বিপদজনক কিন্তু সমস্যা ছিল এই রাস্তা পাহাড়া দেয় দি অ্যালোব্রোজেস নামে একটি উপজাতি গোষ্ঠী, তবে এই উপজাতি গোষ্ঠী দিনের বেলা রাস্তা পাহাড়া দিত এবং রাতে তারা খেতে চলে যেত নিজেদের আস্তানায়। হ্যানিবেল তার সেনাবাহিনীকে ছোট ছোট শ্রেনীতে ভাগ করে রাতের বেলায় আল্পস পর্বতের উচ্চতম অংশে পাঠিয়ে দেয় এবং সকালে যখন অ্যালোব্রোজেসরা ফিরে আসে তখন তাদের উপর আক্রমন করে। হ্যানিবেলের সেনাবাহিনী ও 

অ্যালোব্রোজেসের মধ্যে যুদ্ধে হ্যানিবেল জয়ী হয়, তবে তার বেশ কিছু সেনা মারা যায় এই যুদ্ধে। এরপর হ্যানিবেল তার সেনাবাহিনী সহ আল্পস পর্বতে অভিযান শুরু করে। হ্যানিবেল যে সময় যুদ্ধের জন্য রওনা দেয়, সেসময় ইউরোপে শীতকাল শুরু হয়েছিল যার কারনে কয়েকদিনের মধ্যেই আল্পস পর্বতে তুষারপাত শুরু হয়ে যায়। 

হ্যানিবেলের অধিকাংশ সেনা উত্তর আফ্রিকার ছিল, তারা আফ্রিকার গরম আবহাওয়ায় অভ্যস্ত, আল্পসের তুষারপাত সম্পর্কে তাদের কোনও ধারনা ছিলনা। তীব্র তুষারপাতে বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হয়, এছাড়া তুষারপাতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায় যার করনে আরও বেশ কিছু সেনা গড়িয়ে গভীর খাতে পড়ে যায়। সেনারা তবুও কষ্ট করে যাচ্ছিল কিন্ত সমস্যা দেখা যায় সাথে থাকা ঘোড়া ও হাতিকে কীভাবে বরফের পথে নিয়ে যাওয়া হবে। হ্যানিবেল তার সেনাদের আদেশ দেয় আশপাশের গাছ কেটে সেতুর মতো তৈরি করে তার উপর দিয়ে হাতি ও ঘোড়াকে নিয়ে যেত। হ্যানিবেলের এই পরিকল্পনা কাজ করে যায়। বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল পার হওয়ার পর হ্যানিবেলের সামনে পড়ে খাড়াই পাথুরে অঞ্চল যেখানে কোনও পথ নেই। এই পথ দিয়ে মানুষ কোনওরকমে যেতে পারবে কিন্তু পশু যেতে পারবেনা। তখন হ্যানিবেল তার সেনাবাহিনীকে আবারও আদেশ দেয় বড় বড় পাথরের পাশে গাছ কেটে ফেলে রাখতে এবং সেই গাছে আগুন লাগাতে এবং পাথরের উপর তাদের সাথে থাকা মদ ঢেলে দিতে। যার কারনে পাথর নরম হয়ে যায় এবং সেনাবাহিনী হাতুড়ি দিয়ে সহজেই পাথর ভেঙে দেয়। এভাবে পাথুরে অঞ্চল পার হয়ে এসে রোম সীমান্তের কাছে একটি অঞ্চলে উপস্থিত হয় হ্যানিবেলের সেনাবাহিনী। এখান থেকে রোমের দিকে যাওয়ার জন্য একটি কাদায় ভর্তি জলাভূমি অঞ্চল বেছে নেয় হ্যানিবেল। তীব্র তুষারপাত, খাড়া পাথুরে অঞ্চল অতিক্রম করে আসায় হ্যানিবেলের সেনাবাহিনী যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যার কারনে জলাভূমির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় অবসন্ন হয়ে অনেকেরই মৃত্যু হয়। তবুও হ্যানিবেল তার সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয় এগিয়ে যাওয়ার জন্য। 

হ্যানিবেলের নিজের একটি চোখেও ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল এবং রোম সীমান্তে পোঁছাতে পৌঁছাতে তার সেই চোখ নষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে জলাভূমি পার করে রোম সীমান্তে পোঁছে রোমের ছোট ছোট গ্রামে আক্রমন শুরু করে হ্যানিবেলের সেনাবাহিনী। অল্প কিছু সংখ্যাক রোমান সেনার সাথে লড়াইও হয় হ্যানিবেলের কিন্তু রোমান সেনা পরাজিত হয়। রোমানরা এরপর ফ্লেমিনিয়াসের নেতৃত্বে একটি বড় সেনা পাঠায় হ্যানিবেলকে প্রতিরোধ করতে। হ্যানিবেল ফ্লেমিনিয়াসকে পরাজিত করবার জন্য ভৌগোলিক অঞ্চলকে ব্যবহার করে। হ্যানিবেল পাহাড় ও একটি লেক ত্রাসিমেনের মাঝখানে কিছু সেনা মোতায়ন করে। ফ্লেমিনিয়াস ওই সেনাকে দেখেই ততক্ষনাক আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এটা ফ্লেমিনিয়াসের জন্য একটি বড় ফাঁদ ছিল আসলে হ্যানিবেল তার বেশ কিছু সেনা পাহাড়ের পিছনে লুকিয়ে রেখেছিল যেই ফ্লেমিনিয়াসের সেনা লেকের দিকে এগোয় পাহাড়ের পিছনে থেকে হ্যানিবেলের সেনা আক্রমন শুরু করে ফ্লেমিনিয়াসের দিকে। এই যুদ্ধে প্রায় পনেরো হাজার রোমান সেনার মৃত্যু হয় এবং রোমানদের শোচনীয় পরাজয় হয়। এই যুদ্ধের পর হ্যানিবেল চাইলে সোজা রোম আক্রমন করতে পারতো কিন্তু হ্যানিবেল আক্রমন না করে তার সেনাবাহিনীকে বিশ্রাম দেয় যা তার জন্য ঘাতক সিদ্ধ হয়। 

রোমানরা সময় পেয়ে যায় পরিকল্পনা করার। রোমান সেনাবাহিনী স্পেনের দিক দিয়ে কার্থাজিনিয়ান সাম্রাজ্যে আক্রমন করে। এই খবর যখন হ্যানিবেল পায় সে তখন তার সেনাবাহিনী নিয়ে আবারও পিছনে ফিরে যায়। হ্যানিবেল ও তার ক্লান্ত সেনা যখন রোমান সেনাবাহিনীর সামনে পৌঁছায় কার্থাজিনিয়াতে তখন উভয়পক্ষের মধ্যে জামার যুদ্ধ হয় যাতে হ্যানিবেল পরাজিত হয়। হ্যানিবেলকে যখন রোমান সেনারা ঘিরে ধরে তখন সে আত্মহত্যা করে। এভাবে রোমান সাম্রাজ্যের কাছে শোচনীয় পরাজয় হয় কার্থাজিনিয়ান সাম্রাজ্যের। তবে হ্যানিবেল মানব ইতিহাসে গুটিকয়েক শ্রেষ্ঠ জেনারেলদের মধ্যে একজন ছিল যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে রোমে আক্রমন করার অসাধারন রননীতি তৈরি করেছিলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.