গ্রীকের এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধার একার ক্ষমতায় রোমান সেনাকে দুবার পরাজিত করেছিল
মানব ইতিহাসে যত শ্রেষ্ঠ রননায়ক এসেছে তাদের প্রত্যেকেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে শুধু তাদের অসাধারন রননীতির মাধ্যমে নয় বরং তারা বিজয়ী হয়েছে যুদ্ধ নির্নয়ের কারনে অর্থাৎ কোন যুদ্ধে তাদের লড়তে হবে সেটা নির্বাচন করে। এই সমস্ত সামরিক জেনারেলরা খুব ভালো ভাবেই জানতো তাদের সেই মহূর্তে যুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজনীয় কীনা। এই জন্য একটি কথা প্রচলিত আছে নিজের সঠিক যুদ্ধ চয়ন করুন। ইতিহাসে এমনই এক প্রসিদ্ধ জেনারেল হল অ্যাপিরাসের রাজা পাইরাস যার অসাধারন বুদ্ধিমত্তায় পরাস্ত হয় রোমানরা।
সময়টা ২৮১ বিসিই অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২,৩০০ বছর আগে, এই সময় রোম এবং ইটালির পূর্ব উপকূলে একটি শহর ছিল ট্যারেন্টাম। সেসময় এই নগরী স্পার্টানদের কলোনি ছিল। দক্ষিন গ্রীসের একটি প্রাচীন শহর হল স্পার্টা, এখানকার অধিবাসীদের স্পার্টান বলা হত। গ্রীসের ইউরোটাস নদীর তীরে অবস্থিত স্পার্টা নগরীর অধিবাসীদের গ্রীসের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বলা হত। এথেনীয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনেকবার জয়লাভ করেছে স্পার্টানরা। তারপর থেকেই স্পার্টানদের গ্রীসের রক্ষক বলা হতে থাকে। ট্যারেন্টাম শহরের লোকেরা নিজেদের সভ্য স্পার্টান দাবী করতো। স্পার্টাদের বেশীরভাগ শহর গুলোতে মানুষ দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল ঠিকই কিন্ত শহর গুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা মজবুত ছিলনা। তবে গ্রীসের আরও একটি শহর এথেন্সে স্পার্টানদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। ট্যারেন্টাম শহর সেসময় আর্থিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ট্যারেন্টাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত ছিল রোম। ২৮১ বিসিইতে তখনও বিশাল রোমান সাম্রাজ্য তৈরি হয়নি, রোম তখন নিজেকে শক্তিশালী তৈরি করছিল। রোম জানতো ট্যারেন্টাম ধনী শহর সেজন্য রোম ট্যারেন্টামের সাথে কোনওরকম বিবাদে জড়ায়নি কিন্তু ট্যারেন্টাম কোনও কারনে রোমের বেশ কিছু বানিজ্যিক জাহাজ ডুবিয়ে দেয় যার কারনে রোম ট্যারেন্টামের কাছে ক্ষতিপূরন চায় কিন্তু ট্যারেন্টাম ক্ষতিপূরন তো দেয়নি উপরন্তু রোমকে রীতিমতো অপমান করে। স্পার্টানরা যেমন যোদ্ধা ছিল তেমন রোমানরাও শক্তিশালী যোদ্ধা ছিল। ট্যারেন্টামের অপমান করার কারনে রোমানরা ট্যারেন্টাম আক্রমন করার পরিকল্পনা করে।
ট্যারেন্টাম স্পার্টানদের কলোনী হলেও ধনী শহর হওয়ার কারনে সেখানকার মানুষদের যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছিল এবং তাদের নিজস্ব কোনও শক্তিশালী সেনাবাহিনীও ছিলনা৷ ট্যারেন্টাম মূলত অন্য স্পার্টান শহরের সেনার উপর নির্ভরশীল ছিল কিন্ত সেসময় স্পার্টান সেনা অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে ব্যস্ত থাকায় ট্যারেন্টাম রোমান আক্রমনের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যায়। ট্যারেন্টাম পাইরাস নামে এক ব্যক্তিকে ভাড়া করে তাদের হয়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব করবার জন্য। পাইরাস নিজেও একজন দুর্ধর্ষ গ্রীক যোদ্ধা ছিল। পাইরাস দক্ষিন গ্রীসের অ্যাপিরাস নামক জায়গার অধিবাসী ছিল। পাইরাস গ্রীসের মোলোসিয়ান নামক জাতির প্রধান ছিল, পরে অ্যাপিরাসের রাজা হয় পাইরাস।
পাইরাস প্রথম জীবনে একজন সাধারন সৈনিক ছিল কিন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারন পরাক্রমের জন্য ধীরে ধীরে অ্যাপিরাসের রাজা হয়ে যায় পাইরাস। যুদ্ধে অশ্বারোহী সেনা এবং স্থল সেনার ব্যবহার খুব ভালোভাবে করতে পারতো পাইরাস এবং অসাধারন সামরিক নীতি তৈরিতে দক্ষ ছিল পাইরাস। মহান গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেটের মতোন বিশাল অ্যাপিরাস সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখতো পাইরাস সেজন্য সে সবসময় শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেত পাইরাস। যখনই পাইরাস ট্যারেন্টামের থেকে যুদ্ধের প্রস্তাব পায় তখন সাথে সাথে সে রাজি হয়ে যায় কারন পাইরাস জানতো রোমানদের পরাস্ত করতে পারলে তার খ্যাতি আরও বেড়ে যাবে। তাছাড়া পাইরাস ঠিক করেছিল রোমানদের পরাস্ত করে ইটালির মূল ভূভাগ সিসিলি পর্যন্ত দখল করে নেবে এবং অ্যাপিরাস সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাবে। কিন্ত অ্যাপিরাস ট্যারেন্টামে পৌঁছে অবাক হয়ে যায় কারন সেখানে কোনও সেনাবাহিনীই ছিল।
ট্যারেন্টাম পাইরাসকে জানিয়েছিল সেনা প্রস্তত আছে তাকে এসে শুধু প্রশিক্ষন দিতে হবে কিন্ত বাস্তবে কোনও সেনাই ছিলনা! এরকম ঘটনায় যে কোনও যোদ্ধা লড়াই না করেই ফিরে যাবে কারন একা কখনও যুদ্ধ করা যায়না কিন্তু পাইরাস ফিরে যায়নি, সে ট্যারেন্টামের কাছে অর্থ নিয়ে নিজেই সেনাবাহিনী গঠন করে প্রশিক্ষন দিতে শুরু করে। এই খবর যখন রোমানদের কাছে পৌঁছায় সাথে সাথে রোমানরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হয়ে যায় কারন রোমানরা জানতো পাইরাসের কাছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত সেনা নেই, এই সুযোগে সহজেই তারা জিতে যাবে। হেরাক্লিয়া নামক জায়গায় রোমান সেনা ও পাইরাসের সেনার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। রোমান সেনা সংখ্যায় অনেক বেশী ছিল যার কারনে প্রথম দিনের যুদ্ধে পাইরাসের সেনাবাহিনী পীছু হটে যায় কিন্তু যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় দ্বিতীয় দিনে।
পাইরাস দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে হাতির ব্যবহার শুরু করে, রোমানরা এর আগে কখনও যুদ্ধে হাতি দেখেনি। পাইরাসের হাতির ব্যবহারে রোমানরা পরাজিত হয়। রোমানদের বিরুদ্ধে এমন অসাধারন বিজয় দেখে ট্যারেন্টাম সহ আশেপাশের রাজ্যে পাইরাসকে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের উত্তরসূরি হিসাবে বলা হতে থাকে। পাইরাসের খ্যাতি কয়েকগুন বেড়ে যায়। কেউ কেউ তো বলতে থাকে আলেকজান্ডারের পুনর্জন্ম হয়েছে। তবে এই যুদ্ধ জয়ে তেমন খুশী ছিলনা পাইরাস স্বয়ং কারন এই যুদ্ধে তার বিশেষ কিছু যোদ্ধার মৃত্যু হয়। পাইরাসের কাছে পর্যাপ্ত সেনা না থাকায় পাইরাস ইটালি দখলের পরিকল্পনা বাদ দেয়, এর বদলে সে রোমানদের শান্তি প্রস্তাব দিয়ে জানায় ইটালি যৌথ ভাবে শাসন করার কথা। কিন্ত পাইরাসের এই প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধীতা করে রোম পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হতে শুরু করে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্বেচ্ছাসেবক এসে যোগ দেয় রোমান সেনায়৷
২৭৯ বিসিইতে এস কালামে আবারও দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এস কালামেও হেরাক্লিয়া যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হয়। এখানেও প্রথমদিনে রোমান সেনার সামনে পর্যুদস্ত হয় পাইরাসের সেনা কিন্ত দ্বিতীয় দিনে আবারও পাইরাস হাতি ব্যবহার শুরু করে যার জন্য আবারও পরাজিত হয় রোমানরা। পর পর দুই বছরে দুবার রোমান সেনাদের পরাজিত করায় পাইরাসের খ্যাতি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। লোক পাইরাসকে অপরাজেয় ভাবতে শুরু করে। কিন্ত দুবার যুদ্ধে জিতেও সবচেয়ে বেশী চিন্তায় ছিল পাইরাস নিজেও কারন তার সেনায় অ্যাপিরাসে তার নিজের সেনারই অনেক সদস্য ছিল যাদের বেশীরভাগই মারা যায় এই যুদ্ধে। পাইরাসের অনেক ঘোড়া ও হাতিও মারা যায়। এদিকে রোমানরা আবারও যুদ্ধের প্রস্ততি শুরু করে। পাইরাস বুঝে যায় আর একবার যদি সে রোমানদের সাথে যুদ্ধ করে এবং যদি জিতেও যায় তাহলে তার অবশিষ্ট সেনা, হাতি ও ঘোড়া সব মারা যাবে। যার কারনে পাইরাস আর কখনও যুদ্ধ করেনি রোমানদের সাথে। ইটালি দখলের স্বপ্নও পূরন হয়নি তার, বাধ্য হয়েই তাকে অ্যাপিরাসে ফিরে যেতে হয়৷ রোমানদের দুবার পরাজিত করেও বিজয় যেন তার কাছে পরাজয়ের সমানই ছিল। পরে এক যুদ্ধে পাইরাসের মৃত্যু হয়।