ফিচার আর্টিকেল

বেনিতো মুসোলিনিকে জেল থেকে মুক্ত করতে জার্মান কম্যান্ডোদের কি নির্দেশ দিয়েছিলেন হিটলার?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে স্বৈরাচারী শাসক বেনিটো মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট সরকার গঠন করেছিল। ১৯২২ সালে মুসোলিনি ক্ষমতায় আসার পর ইতালির রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান হয়েছিল তার। ১৯৩৯ সাল আসতে আসতে মুসোলিনি প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ইতালিতে। বলা হয় স্বয়ং অ্যাডলফ হিটলার মেন্টর হিসাবে মানতো বেনিটো মুসোলিনিকে এবং হিটলারও ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারের  মতোই জার্মানিতে নাজি সরকার তৈরি করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ইতালি এক জোটেই ছিল যাকে অক্ষশক্তি বলা হত। এই অক্ষশক্তিতে জার্মানি, ইতালি ছাড়া জাপানও ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যত এগোয় ততই ইতালিতে জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে বেনিটো মুসোলিনির। ১০ জুলাই, ১৯৪৩ সালে মিত্র শক্তি অপারেশন হাসকিতে সিসিলিতে পৌঁছে যায়। ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল তৃতীয় বেনিটো মুসোলিনির কিছুটা বিরোধী ছিল, ভিক্টর ইমানুয়েল সিসিলিতে মিত্র শক্তির সাথে গোপন সন্ধি করে বেনিটো মুসোলিনিকে গ্রেফতার করায়৷ বেনিটো মুসোলিনিকে গ্রেফতার করে গোপন জেলে রাখা হয় যা মিত্র শক্তির অধিকাংশ সেনাও জানতোনা। অ্যাডলফ হিটলার যখন খবর পায় মুসোলিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে তখন হিটলার নাজি সেনাকে নির্দেশ দেয় যে করেই হোক মুসোলিনিকে খুঁজে বের করে মুক্ত করতে হবে। হিটলার জানতো মুসোলিনি না থাকলে ইতালি মিত্র শক্তির পক্ষে যোগ দেবে তাহলে দক্ষিন জার্মানি হয়ে মিত্র শক্তি খুব সহজেই জার্মানিতে প্রবেশ করবে। মুসোলিনিকে খুঁজে বার করার জন্য এবং জেল থেকে মুক্ত করার জন্য নাজি সেনা এইসময় একটি অসাধারন অপারেশন করে। 

২৪ জুলাই, ১৯৪৩ সালে ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল তৃতীয় একটি বৈঠকের জন্য বেনিটো মুসোলিনিকে ডাকে। বৈঠকে মুসোলিনিকে বলা হয় মিত্র শক্তি ইতালি পৌঁছে গেছে এবং ইতালির মানুষ চাইছে মিত্র শক্তির পক্ষে যোগ দিতে। বৈঠকে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মুসোলিনিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং কোন এক গোপন জায়গায় তাকে বন্দি করে রাখা হয়। ওই বৈঠকে ফ্যাসিজিমের গ্রান্ড কাউন্সিলও মুসোলিনির উপর অনাস্থা প্রস্তাব আনে। মুসোলিনিকে গ্রেফতারের পর ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রী করা হয় পিয়েত্রো বাডোগ্লিওকে। 

নতুন ইতালিয়ান সরকার প্রথমে অক্ষ শক্তির পক্ষেই ছিল কিন্তু ১৭ আগস্ট সিসিলিতে মিত্র শক্তির বিজয়ের পর ইতালি সরকার গোপনে মিত্র শক্তির সাথে একটি সন্ধি করে। ইতালি জানতো যদি জার্মানি জানতে পারে ইতালি মিত্র শক্তির সাথে সন্ধি করেছে তাহলে হিটলার ইতালি আক্রমন করবে। তাই ইতালি চাইছিলো মিত্র শক্তির পক্ষে যোগ দেওয়ার ঘটনা ৮ সেপ্টেম্বর ঘোষনা করতে, ততদিনে মিত্র শক্তি ইতালির মূল ভূমিতে এসে পড়বে এবং মিত্র শক্তি জার্মান আক্রমন প্রতিরোধ করবে বিশেষ করে রোমকে রক্ষা করবে। তবে তার আগেই মুসোলিনির গ্রেফতারের খবর পেয়ে যায় অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার এই খবর শুনে দ্রুত মুসোলিনিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেয়, কারন হিটলার জানতো বেনিটো মুসোলিনির কারনেই ইতালি অক্ষ শক্তি অর্থাৎ জাপান, জার্মান জোটে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং মুসোলিনির কারনেই ইতালির সেনা জার্মান জেনারেলদের আদেশে কাজ করে। নাজি সেনা মুসোলিনিকে খুঁজে বের করার জন্য মেজর হ্যারল্ড মোর্সের নেতৃত্বে অপারেশন ইচ বা অপারেশন ওকের পরিকল্পনা করে। হিটলার তার প্যারা মিলিটারি এসএসের প্রধান হেইনরিখ হিমলারকেও এই অপারেশনে যুক্ত করে। এই অপারেশনে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল মুসোলিনিকে খুঁজে বের করা। ইতালিও জানতো জার্মানি মুসোলিনিকে মুক্ত করবার চেষ্টা করবেই যার কারনে ইতালি মুসোলিনিকে কোন এক জায়গায় রাখছিলো না, নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মুসোলিনিকে। পুরো আগস্ট মাস ধরে অনুসন্ধান করেও এসএস খুঁজে পায়নি মুসোলিনিকে। অবশেষে ১ সেপ্টেম্বর এসএস খবর পায় ইতালির গ্রান স্যাসো পার্বত্য অঞ্চলে হোটেল ক্যাম্পে ইম্পেরেটোরে রাখা হয়েছে মুসোলিনিকে। ডি অক্ষরের মতোন দেখতে এই হোটেল একদম উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। জার্মান বায়ুসেনার বিমান বেশ কয়েকবার এই হোটেলের উপর দিয়ে গিয়ে হোটেলের অবস্থান ও চারপাশের ছবি তোলে। বেনিটো মুসোলিনিকে কোথায় রাখা হয়েছে তা জানার জন্য এসএস এক লাখ ইউরো খরচ করেছিল। হোটেল ক্যাম্প ইম্পেরটোরে যেতে হলে হোটেল থেকে পাহাড়ের নীচে অবধি কেবলকার ছিল তাতে করে যেতে হত। জার্মানি দুভাগে এই হোটেলে অপারেশনের পরিকল্পনা করে। ঠিক হয় প্রথমে জার্মান বায়ুসেনার গ্লাইডাররা হোটেলের কিছুটা পাশে একটি সমতল জায়গায় নামবে এবং অন্যদিকে একটি বিশেষ দল কেবলকার স্টেশন দখল করবে যাতে হোটেলে বাইরে থেকে কেউ আসতে না পারে এবং সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হবে। 

৮ সেপ্টেম্বর মিত্র শক্তি ঘোষনা করে দেয় ইতালি অ্যালায়েড ফোর্সে যোগদান করবে। এই খবর শুনে হিটলার আরও ঘাবড়ে যায় কারন হিটলার জানতো এবার যদি অপারেশন শুরু না করা হয় তাহলে মুসোলিনিকে মিত্র শক্তির হাতে তুলে দেওয়া হবে যার ফলে জার্মানিতে খুব শীঘ্রই আক্রমন করা হবে। ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে রোমের কাছে প্যারাসিয়া দি মারে এয়ারবেস থেকে জার্মান বায়ুসেনার হেনসিল এইচএস ১২৬ বিমানে করে একশোর বেশী জার্মান কম্যান্ডো রওনা দেয় গ্রান স্যাসোর উদ্দেশ্যে। হেনসিল এইচএস ১২৬ বিমান গুলি নয়টি ডিএফএস ২৩০ গ্লাইডার বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল ল্যান্ড করার জন্য। এই প্রতিটি গ্লাইডারে নয়জন করে সেনা ও একজন পাইলট ছিল। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে ল্যান্ড করবার সময় সমস্যা দেখা যায়। জার্মান সেনা জানতো হোটেলের পাশে সমতল জায়গা আছে সেখানে তারা ল্যান্ড করবে কারন তারা ছবিতে তাই দেখেছিল কিন্ত ল্যান্ড করবার সময় দেখা যায় সেটা পাথুরে জায়গা যার কারনে অনেক জার্মান কম্যান্ডো ক্রাশ ল্যান্ড করে ও আঘাত পায়। কিন্ত তবুও জার্মান কম্যান্ডোরা হোটেলে যায়। হোটেলে ইতালিয়ান মিলিটারি জার্মান সেনাকে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে যায়, তবে ইতালিয়ান সেনাকে আগে থেকেই নির্দেশ দেওয়া ছিল পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে মুসোলিনিকে হত্যা করে দিতে। 

অন্যদিকে আরও একটি জার্মান প্যারাট্রুপার কম্যান্ডো দল কেবল কার স্টেশন দখল করে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই প্যারাট্রুপার দলে ছিল মেজর হেরাল্ড মোর্স স্বয়ং। ক্যাম্পে ইম্পেরেটোর হোটেলে ২০০ এর অধিক সুসজ্জিত ইতালিয়ান সেনা ছিল তারা জার্মান সেনাকে দেখে ফায়ারিং করতে যাবে এমন সময় এক ইতালিয়ান জেনারেল ইতালির সেনাকে গুলি করতে বারন করে। হিটলার জার্মান কম্যান্ডো দলের সাথে একজন ইতালিয়ান জেনারেলকেও পাঠিয়েছিল যাতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ না হয়। এর পরবর্তী কয়েক মিনিটের মধ্যে মুসোলিনিকে বার করে আনা হয় এবং তাকে ফিসেলার এফআই ১৫৬ নামে একটি বিমানে করে প্যারাসিয়া দি মারে এয়ারবেসে আনা হয়। সেখান থেকে জার্মান বায়ুসেনার হেইনকেই এইচই ১১১ বিমানে করে মুসোলিনিকে ভিয়েনা নিয়ে যাওয়া হয়। ভিয়েনায় হোটেল ইম্পেরিয়ালে সেদিন থাকার পর পরেরদিন সকালে মুসোলিনিকে মিউনিখ নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর রাস্টেনবার্গে উলফ লেয়ারে সাক্ষাৎ হয় হিটলার ও মুসোলিনির। এই পুরো অপারেশনে একজন ফটোগ্রাফারকে পাঠিয়েছিল জার্মানি যাতে এই অপারেশনের প্রমান বাকী বিশ্বকে দেখানো যায়  এবং নাজি সেনার দক্ষতা প্রচার করা যায়। এসএস তাদের এই অপারেশনের খবর পরবর্তী কয়েক মাস ধরে প্রচার করে। মুসোলিনিকে এভাবে নিয়ে চলে যাওয়ার ঘটনায় ইতালির সরকারের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। এই ঘটনার পর উত্তর ইতালিতে হিটলার একটি সরকার গঠন করে যার নাম দেওয়া হয় ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক, এই সরকারের প্রধান নিযুক্ত করা হয় বেনিটো মুসোলিনিকে। হিটলারের কথা অনুযায়ীই চলতো মুসোলিনির এই নতুন সরকার। 

১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে অক্ষ শক্তির পরাজয় নিশ্চিত দেখে মুসোলিনি ও তার স্ত্রী সুইজারল্যান্ড পলিয়ে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু ইতালির কমিউনিস্ট দল তাদের গ্রেফতার করে। ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে লেক কোমোর কাছে ফায়ারিং স্কোয়াড হত্যা করা হয় মুসোলিনিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.