ফিচার আর্টিকেল

ভারতের প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল চোল সম্রাট। স্ট্রাইক করতে তিনি কিভাবে প্ল্যান করতেন?

২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআইের সাহায্যে জইশ ই মহম্মদ এলওসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল অতিক্রম করে কাশ্মীরের উরিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেসে সন্ত্রাসী হামলা করে যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন। এরপরে ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষিত জঙ্গী শিবির গুলোতে অভিযান চালায় যাকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বলা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পিওকেতে সমস্ত জঙ্গী শিবির গুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তবে এই অভিযানের বহু আগেই ১,০২৫ সিইতে ভারতের প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে চোল সাম্রাজ্যের শাসক রাজেন্দ্র প্রথম। চোল শাসক রাজেন্দ্র প্রথমের নৌবাহিনী দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম কোন বিদেশী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান ছিল। রাজেন্দ্র প্রথমের নৌবাহিনী শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের চোদ্দটি বন্দরে অভিযান চালায়। বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রাতেই অতীতের শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য ছিল। চোল নৌবাহিনীর এই অভিযানে হতচকিত হয়ে পড়েছিল শ্রীবিজয়। মৌসুমী বায়ুর অভিমুখে বিশাল চোল নৌসেনা তাদের জাহাজে করে হাতি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল শ্রীবিজয় অভিযানে। চোল নৌবাহিনী সর্বপ্রথম শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের রাজধানী পালেমবাং আক্রমন করে তারপর বাকী বন্দর অভিমুখে অভিযান শুরু হয়।

চোল সাম্রাজ্য ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি। তৃতীয় শতক বিসিইতে অশোকের শিলালিপি থেকে চোল সাম্রাজ্যের বিষয়ে জানা যায়। ওই শিলালিপিতে চোলদের মৌর্য সাম্রাজ্যের বন্ধু বলা হয়েছে। কোইন গ্রীকের লেখা পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রেয়ান সী বইতেও চোলদের কথা লেখা আছে। টলেমির লেখাতেও চোলদের নাম উল্লেখ আছে। ভারতের করমন্ডল এলাকার নামও এসেছে চোলদের থেকেই৷ চোলমন্ডলা নাম থেকেই করমন্ডল নাম এসেছে যার অর্থ চোলদের রজত্ব। শিল্পকলা ও পরিকাঠামো নির্মানে অত্যন্ত দক্ষ ছিল চোলরা, তারা ভারতের পূর্ব উপকূলে প্রচুর মন্দির নির্মান করেছিলেন। 

ভগবান শিবের বিখ্যাত নটরাজ মূর্তিও চোলরাই তৈরি করেছিলেন। চোলদের শিল্পকলায় পশ্চিমা দেশগুলোও আকৃষ্ট হয়েছিল। চোল শাসকরাই প্রথম ভারতীয় শাসক যারা বিদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। শক্তিশালী নৌবাহিনীর পাশপাশি চোল সেনাবাহিনীতে একটি বিশেষ প্রশিক্ষিত বাহিনী ছিল যাদের অট্রু বলা হত, এই অট্রু বাহিনী বিদেশী জাহাজদের উপর নজর রাখতো এবং জলদস্যুদের আক্রমনকে প্রতিহত করতো। চোল সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীর পাশাপাশি আধুনিক যুগের মতোন উপকূল রক্ষা বাহিনীও ছিল। কিংবদন্তী চোল শাসক রাজেন্দ্র প্রথমের পর তার পুত্র রাজেন্দ্র চোল পরবর্তী চোল শাসক হন। তবে রাজেন্দ্র চোলের সিংহাসনে বসার আগেই তার বাবা রাজেন্দ্র প্রথমের সময়েই চোল সাম্রাজ্য তার খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। রাজেন্দ্র প্রথমের সময়ে পুরো দক্ষিন ভারত সহ কলিঙ্গ বা আজকের ওড়িশা চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজেন্দ প্রথম মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাতেও সেনা অভিযান করেছিলেন এবং মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার উত্তর অংশ চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। রাজেন্দ্র প্রথম বানিজ্যের জন্য চীনেও দূত পাঠিয়েছিলেন। বাবার মতই শক্তিশালী শাসক ছিল রাজেন্দ্র চোল, তিনি রাষ্ট্রকূট এবং পশ্চিম চালুক্যদের যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন যাতে ডেকানে চোলদের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। 

১,০১৭ সিইতে রাজেন্দ্র চোল শ্রীলঙ্কা অভিযান করেন এবং শ্রীলঙ্কার দক্ষিন প্রান্ত পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। এর একবছর পর তিনি উত্তরে গঙ্গা নদীর দিকে সেনা অভিযান শুরু করেন এবং পাল বংশ, কম্বোজাস ও চন্দ্রা রাজবংশকে পরাজিত করেন। এরপরেই রাজেন্দ্র চোল গঙ্গাইকোন্ডা চোল উপাধি ধারন করেন। সেসময় দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য। চোলদের মতোন শ্রীবিজয়দেরও শক্তিশালী নৌবহর ছিল। মালাক্কা প্রনালী ও সুন্দা প্রনালী তাদের নিয়ন্ত্রনে ছিল যার কারনে সমুদ্র বানিজ্যের উপর সম্পূর্ন প্রভাব ছিল তাদের। বারো শতকে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য তাদের খ্যাতির শীর্ষে ছিল, সেসময় সুমাত্রা থেকে শুরু করে জাভা হয়ে ফিলিপিন্স পর্যন্ত তাদের প্রভাব ছিল। শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের রাজধানী পালেমবাং এর প্রবেশ পথে অসাধারন যুদ্ধ দরজা বিধ্যাদরা তোরনা সবাইকে আকৃষ্ট করতো। চোল সম্রাট রাজেন্দ্র প্রথম এবং রাজেন্দ্র চোলের সময়ে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের শাসক ছিল শৈলেন্দ্র রাজবংশ। নবম ও দশম শতকে বাংলার পাল বংশের সাথে সুসম্পর্ক ছিল শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের। 

৮৬০ এডিতে নালন্দা শিলালিপি থেকে জানা যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বৌদ্ধ মঠ তৈরি করিয়েছিলেন শ্রীবিজয় শাসক বালাপুত্র। ১০০৬ সিইতে শ্রীবিজয় শাসক তুঙ্গাবর্মন নাগাপাট্টিনামে চুরামনি বিহার তৈরি করিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র প্রথমের সময়কাল থেকেই চোলদের সাথে সমস্যা তৈরি হয় শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের। মালাক্কা ও সুন্দা প্রনালীর মতোন গুরুত্বপূর্ন সামুদ্রিক বানিজ্য পথের সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রন শ্রীবিজয়দের হাতে থাকায় তারা আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বানিজ্যও নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনবার চেষ্টা করে। চাইনিজ ঐতিহাসিক ঝাও রুকুও তার বইয়ে লিখেছেন সেসময় শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য মালাক্কা ও সুন্দা প্রনালী হয়ে যাওয়া প্রতিটি জাহাজকে তাদের বন্দরে থামবার জন্য জোর করতে থাকে যাতে কর আদায় করা যায়। যদি কোনও জাহাজ না থামত তাহলে সেই জাহাজকে ধ্বংস করে দিত শ্রীবিজয় নৌবাহিনী। শ্রীবিজয়দের এই নীতির বিরোধিতা করে চোলরা। কারন পূর্ব এশিয়ার সাথে চোলদেরও বানিজ্যে সমস্যা হয় শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের কারনে। ঐতিহাসিক নীলকান্ত শাস্ত্রীও জানিয়েছেন বানিজ্যে বাধার কারনেই রাজেন্দ্র প্রথম শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যে অভিযান করেন। এগারো শতকে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যকে মালাক্কা প্রনালীতে সমর্থন করে চীনের সং সাম্রাজ্য। রাজেন্দ্র প্রথম এরপরই হঠাৎ বিশাল সেনা অভিযান করেন শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যে। রাজেন্দ্র প্রথমের এই অভিযানে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে পরবর্তী তিন বছর তারা চীনে কোনও দূত পর্যন্ত পাঠায়নি। এছাড়া ঐতিহাসিকদের মতে বানিজ্যে বাধা ছাড়াও ভূরাজনৈতিক কারনেও চোল ও শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হয়। চোল সাম্রাজ্যের সাথে খামের অর্থাৎ আজকের কম্বোডিয়ার শাসক সূর্যবর্মনের একটি চুক্তি ছিল। খামেরের সাথে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের অনেক পুরোনো শত্রুতা ছিল। 

শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের শাসক যখন চীনের সাথে সন্ধি করে তখন খামেরের শাসক চোলদের সাথে চুক্তি করে। এছাড়া সূর্যবর্মন রাজেন্দ্র প্রথমের কাছে তাম্ব্রলিঙ্গ রাজবংশ বা দক্ষিন থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাহায্য চান। এই খবর পেয়েই তাম্ব্রলিঙ্গের শাসক শ্রীবিজয়ের সম্রাট সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মনের সাথে জোট তৈরি করেন। তবুও রাজেন্দ্র প্রথমের চোল নৌসেনাকে হারাতে পারেনি শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য। শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের উপর চোলদের অভিযান একদম নিঃশব্দে হয়। সাধারনত ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া যেতে হলে বঙ্গোপসাগর হয়ে যেতে হয় এবং এই পথে মালাক্কা প্রনালীর কাছে শ্রীবিজয়দের কেদাহ বন্দর ছিল। চোল নৌসেনা এইপথে না এসে পশ্চিম সমুত্রার দিকে রওনা হয়ে সুন্দা প্রনালীতে পৌঁছে যায়। সুন্দা প্রনালীর কাছে বারুস বন্দরে সেসময় তামিল ব্যবসায়ীদের প্রভাব ছিল যার কারনে বিশাল চোল নৌসেনা লজিস্টিক ও দরকারী সহায়তা পায় এখান থেকে। সুন্দা প্রনালী থেকে খুব কাছেই ছিল শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের রাজধানী পালেমবাং। শ্রীবিজয় নৌসেনা মালাক্কা প্রনালীর কাছে কেদাহতে মোতায়েন ছিল তারা জানতেও পারেনি সুন্দা প্রনালীতে পৌঁছে গেছে বিশাল চোল আর্মাডা। এখান থেকেই চোলদের প্রথম অভিযান হয় পালেমবাংএ। পুরো পালেমবাং শহর চোলদের অধীনে চলে আসে, শ্রীবিজয় শাসক সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মনকে বন্দী করা হয়। এরপর একে একে সমস্ত গুরুত্বপূর্ন শ্রীবিজয় শহর চোলদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। 

চোল শাসক রাজেন্দ্র প্রথম সংগ্রাম বিজয়তুঙ্গবর্মনের মেয়ে ওনাং কীকে বিবাহ করেন। রাজেন্দ্র প্রথমের থানজাভুর শিলালিপি থেকে শ্রীবিজয়ে অভিযানের বিষয়ে জানা যায়। রাজেন্দ্র প্রথমের শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান ভারত মহাসাগরে চোলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, এরপর কারও ক্ষমতা হয়নি চোলদের বানিজ্যিক জাহাজকে বাধা দেবার। রাজেন্দ্র প্রথমের এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ভারত মহাসাগরের চোলদের একচ্ছত্র অধিপতি করে দিয়েছিল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.