ফিচার আর্টিকেল

বিগত নয় বছর ধরে অবিশ্বাস্য গতিতে জাতীয় সড়ক তৈরি মোদী সরকারের

মাননীয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রী নিতিন গড়করি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন ভারতের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য যে সড়ক নির্মান করা হচ্ছে তা দেশের সম্পত্তি, সড়ক নির্মানের গুনমান অপরিবর্তিত রেখে খরচ কমানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও জানিয়েছেন সাধারন সড়ক তৈরির পাশপাশি ভারতে উচ্চমানের সড়ক তৈরিও প্রয়োজন। সম্প্রতি সড়ক নির্মানের ক্ষেত্রে ভারত চীনকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সড়ক ব্যাবস্থা রয়েছে ভারতের। স্বাধীনতার আগে যেখানে ভারতে ২১,৩৭৮ কিলোমিটার লম্বা সড়ক ছিল সেখানে বর্তমানে ভারতে ১,৬১,৩৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জাতীয় সড়ক রয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পর থেকে ভারতের সড়ক নির্মানে বিশেষ করে জাতীয় সড়ক তৈরিতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। বিগত নয় বছরে সড়ক নির্মানের ক্ষেত্রে ভারত একের পর এক অনন্য নজির তৈরি করেছে। উন্নত জাতীয় সড়ক ব্যবস্থা ভারতের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখছে।

বলা হয় পরিকাঠামো নির্মানই কোন দেশের উন্নয়নের মেরুদণ্ড। দেখা যায় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ক্রমশ আরও উন্নত হচ্ছে কিংবা কোনও বড় দেশের কোনও এক শহর বাকী অংশের তুলনায় বেশী উন্নত এবং সেই অঞ্চলের ক্রমাগত উন্নয়ন হচ্ছে। এর প্রধান কারন হচ্ছে এইসব এলাকার মানুষদের জীবনযাপনের সুবিধা অনেক বেশী যার কারনে উৎপাদন হারও অনেক বেশী। যদি কোনও নির্দিষ্ট এলাকার মানুষদের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ সঠিক ভাবে না হয়, পরিবহনের জন্য কিংবা নিকটবর্তী রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য উন্নত সড়ক না থাকে তাহলে সেই অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাপনের মান এমনিতেই কমে যায় এবং এর প্রভাব সরাসরি দেশটির অর্থ ব্যবস্থার উপর পড়ে। যদি কোনও দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় আধুনিক পরিকাঠামো নির্মান করা হয় তাহলে সেখানে বিনিয়োগ করার পরিবেশ তৈরি হয় এবং স্থানীয় মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বাড়ে যার কারনে দেশটির অর্থনীতি সচল থাকে ও মজবুত হয়। এই পরিকাঠামো নির্মানের প্রথম ধাপই হচ্ছে সেই অঞ্চলে উন্নত সড়ক ও জাতীয় সড়ক নির্মান করা। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই কোনও দেশের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত উন্নয়ন করা সম্ভব। খারাপ সড়ক ব্যবস্থার কারনে কোনও দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় খরচ অত্যাধিক বেড়ে যায় যা দেশটির মোট জিডিপির ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত হয়। কিন্তু সেই তুলনায় আমেরিকা ও উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর পরিবহন খরচ জিডিপির ৮ শতাংশ হয়। অন্যান্য সব দেশের মতোই জাতীয় সড়ক ও মহা সড়ক ভারতের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ যার ভারতের জিডিপিতে ৩.৬ শতাংশের বেশী যোগদান রয়েছে। যাতায়াতের জন্য ভারতের ৮৫ শতাংশ যাত্রী সড়কই ব্যবহার করে, ভারতের ৬৪.৫ শতাংশ পন্যদ্রব্যও সাধারন সড়ক ও জাতীয় সড়ক দিয়েই পরিবহন হয়। এই কারনে ভারতের মতোন বিশাল দেশে আধুনিক সড়ক ব্যাবস্থা দরকার। বিগত নয়বছরে সড়ক নির্মানে ভারত অনন্য নজির তৈরি করেছে। 

এপ্রিল, ২০১৪ থেকে নভেম্বর, ২০২১ এর মধ্যে ভারতের জাতীয় সড়ক ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে ভারতের ৯১,২৪৮ কিলোমিটার লম্বা জাতীয় সড়ক ছিল সেখানে ২০২১ সালের নভেম্বর আসতে আসতে ভারতের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্ক ১,৪০,৯৩৭ কিলোমিটার হয়ে গেছে। বর্তমানে ভারতের পরিকাঠামো ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য জাতীয় সড়ককে আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ভারতে এই জাতীয় সড়ক বিপ্লবের সূচনা হয় ১৯৯৮ এর দিকে, সেসময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় অটল বিহারি বাজপেয়ী ভারতকে একটি উন্নত দেশ হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। সেসময় চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশকে টেক্কা দেওয়ার জন্য ভারতে জাতীয় সড়ক নির্মানের প্রজেক্ট শুরু হয়। 

১৯৮৮ সালেই এনএইচএআই বা ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া তৈরি করা হয়েছিল। প্রথমদিকে এনএইচএআই এর দায়িত্ব ভারের জন্য যোগ্য ব্যক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে থেকেই নিয়োগ করা হয় কারন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর বিশ্বাস ছিল জাতীয় সড়ক নির্মানে সেনাবাহিনীর মতোন অনুশাসন ও গতির প্রয়োজন। 

১৯৯৮ সাল থেকে জাতীয় সড়ক নির্মানে গতি আসে কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে জাতীয় সড়ক নির্মানে গতি কমে যায়৷ ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে পুনরায় জাতীয় সড়ক নির্মানে গতি আসে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ভারতে ২০১৩ সাল অবধি প্রতিদিন তিন কিলোমিটার সড়ক তৈরি করা হত কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পর ২০১৪-১৫ সাল থেকে প্রতিদিন বারো কিলোমিটার সড়ক নির্মান শুরু হয় ভারতে অর্থাৎ সড়ক নির্মানে চার গুন গতি বৃদ্ধি হয়। ২০১৫ সালে সম্পূর্ন ভারতে সড়ক ব্যাবস্থা নির্মানের জন্য ভারতমালা নামে একটি প্রজেক্ট ঘোষনা করা হয় যাতে একশোটি নতুন অর্থনৈতিক করিডর তৈরির কথা জানানো হয়। এই পুরো প্রজেক্টে মোট ৭৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করার ঘেষনা করা হয়। 

২০২০- ২১ সালে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৩৪ কিলোমিটার করে সড়ক নির্মান হতে থাকে, খুব শীঘ্রই এই গতি ৪০ কিলোমিটার প্রতিদিনে পৌঁছাবে। ভারত সরকারের লক্ষ্য ভারতে জাতীয় সড়ক নির্মানের গতিকে প্রতিদিন গড়ে একশো কিলোমিটারে করা। ভারতের এই জাতীয় সড়ক নির্মান ২০২৫ সালে ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন জিডিপি তৈরিতে সাহায্য করবে। এনএইচএআই এর মূল লক্ষ্য শুধু রাস্তা নয় একটি দেশ গড়তে হবে, এই লক্ষ্যে চীনকে ছাড়িয়ে আমেরিকার পর ভারত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সড়ক নেটওয়ার্ক যুক্ত দেশে পরিনত হয়েছে।

২০২৩-২৪ এর বাজেটে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রক ২.৭ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সড়ক নির্মানে যা ২০২২-২৩ এর বাজেট ১.৯৯ লাখ কোটির থেকেও বেশী। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সড়ক নির্মানের জন্য এত অর্থ কখনও ব্যায় করা হয়নি। যা প্রমান করে বর্তমান ভারত সরকার ভারতের উন্নয়নে কতটা কাজ করছে। চওড়া জাতীয় সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, গ্রীন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের মাধ্যমে ভারতের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে ভারতের সমস্ত জাতীয় সড়কই এনএইচএআই এর অধীনে আসেনা কিছু জাতীয় সড়ক সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রকের অধীনেও রয়েছে। ২০২৪ এর মধ্যে ভারতের বেশ কিছু মেগা সড়ক নির্মান প্রজেক্ট সম্পন্ন হবে। যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে। বর্তমানে ট্রেনে দিল্লি থেকে মুম্বাই যেতে ২২ ঘন্টা এবং সড়ক পথে ২৫ ঘন্টা সময় লাগে কিন্তু এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হলে ভারতের রাজধানী থেকে ভারতের বানিজ্যিক রাজধানীতে যেতে মাত্র বারো ঘন্টা সময় লাগবে। ভারতমালা প্রজেক্টের অধীনে ১,৩৮৬ কিলোমিটার লম্বা এই এক্সপ্রেসওয়ে ভারতের সবচেয়ে লম্বা এক্সপ্রেসওয়ে বা মটরপথ হবে। এই প্রজেক্টে সর্বমোট এক লাখ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। 

গত ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করেন। আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে মুম্বাই নাগপুর এক্সপ্রেসওয়ের কাজও সম্পন্ন হয়ে যাবে। সাতশো কিলোমিটার লম্বা এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরিতে ৫৫,০০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এখন মুম্বাই থেকে নাগপুর সড়কপথে যেতে সময় লাগে ১৭ ঘন্টা কিন্তু এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে সময় লাগবে ৮ ঘন্টা। ৬৪৮ কিলোমিটার লম্বা দিল্লি অমৃতসর কাটরা এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে যার প্রথম ধাপের খরচ ২৫,০০০ কোটি টাকা। মেরুট ও প্রয়াগরাজের মধ্যে ৫৯৪ কিলোমিটার লম্বা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে যা উত্তরপ্রদেশের বারোটি জেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রজেক্টের মোট খরচ ৪০,০০০ কোটি টাকা। আহমেদাবাদ ও ঢোলেরার মধ্যে ১০৯ কিলোমিটার লম্বা চার লেনের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হচ্ছে যার মোট খরচ ৩,৫০০ কোটি টাকা। এছাড়াও অনেক জাতীয় সড়ক প্রজেক্টেও কাজ চলছে। জাতীয় সড়ক থেকে এক্সপ্রেসওয়ে আলাদা। 

জাতীয় সড়কে চার লেন থাকে কিন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে ছয় থেকে আট লেন থাকে। ভারতের সড়ক ব্যবস্থায় সবচেয়ে আধুনিক সড়ক হচ্ছে এই এক্সপ্রেসওয়ে। জাতীয় সড়কের মাধ্যমে ভারতের বড় শহর, বন্দর ও শিল্পোন্নত অঞ্চল গুলো সংযুক্ত থাকে, এইজন্য জাতীয় সড়ককে ভারতের সড়ক ব্যাবস্থার মেরুদন্ড বলা হয়। উন্নত সড়ক নেটওয়ার্কের কারনে ভবিষ্যতে ভারতে দূষনও কমবে কারন খারাপ রাস্তায় গাড়ির তেল বেশী খরচ হয়। জাতীয় সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের কারনে কর্মসংস্থান বাড়বে, পরিবহনে খরচ কমবে ভারতের এবং লজিস্টিকে গতি বাড়বে যাতে ভারতের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে। জাতীয় সড়ক নির্মানের সময় থেকেই দেখা গেছে এর সাথে যুক্ত প্রত্যন্ত এলাকারও উন্নয়ন হয়েছে। আমেরিকার ৩৫ তম রাাস্ট্রপতি জন এফ কেনেডি বলেছিলেন আমেরিকা ধনী কারন আমেরিকার রাস্তা ভালো। যার থেকেই বোঝা যায় একটি সমৃদ্ধ দেশের জন্য উন্নত সড়ক ব্যাবস্থা কতটা জরুরী। ভারত সরকার ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে যে হারে আধুনিক সড়ক নির্মান করছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে ভারতও একটি সমৃদ্ধ দেশ হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.