-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করে সঙ্গীদের মৃত দেহের মাংস ভক্ষণ করে যেভাবে বেঁচে ছিল
সাধারনত বিমান দুর্ঘটনায় বিমানের সমস্ত যাত্রিরই মৃত্যু হয়। কিন্ত যদি কখনও ভাগ্যের জোরে কেউ বেঁচে যায় তাহলে সর্বোচ্চ দুই দিনের ভিতরেই তাকে খুঁজে বের করে উদ্ধারকারী দল। ১৯৭৩ সালে মানব ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর বিমান দুর্ঘটনা ঘটে দক্ষিন আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায়। বিমানে থাকা ৪৫ জন যাত্রীর মধ্যে ২৯ জনই মারা যায়, কিন্ত বাকী ১৬ জন যাত্রী – ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বরফাচ্ছাদিত এলাকায় ৭২ দিন ধরে সংঘর্ষ করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়। ডিসকভারি চ্যানেলে প্রচারিত বেয়ার গ্রিলসের ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড সিরিজকেও হার মানাবে এই ঘটনা।
দিনটা ১২ অক্টোবর, ১৯৭২, উরুগুয়ের কারাসকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি ছোট চার্টাড বিমান চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিমানে উরুগুয়ের মন্টেভিডিওর ওল্ড ক্রিশ্চিয়ানস ক্লাব রাগবি ইউনিয়ন দলের খেলোয়াড়রা সান্তিয়াগোতে ওল্ড বয়েজ ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলতে যাচ্ছিল। উরুগুয়ে বায়ুসেনার দুটি টার্বোপ্রোপ ইঞ্জিন বিশিষ্ট এফএইচ ২২৭ডি বিমানটিতে খেলোয়াড় ও তাদের পরিবারের কিছু সদস্য সহ ৪০ জন যাত্রী ও পাঁচ জন ক্রু সদস্য ছিল। দক্ষিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে থেকে চিলি পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র তিন ঘন্টা। যাত্রাপথেই রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালা। ৮৯০০ কিলোমিটার রেঞ্জ বিশিষ্ট দক্ষিন আমেরিকা সহ পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা এই আন্দিজ পর্বত। যাত্রাপথে হঠাৎ আবহওয়া খারাপ হওয়ায় পাইলট আর্জেন্টিনার মেনডোজাতে ল্যান্ড করতে বাধ্য হয়। পরের দিন অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর সকালেও আবহাওয়া খারাপ থাকে অবশেষে দুপুরের দিকে আবহাওয়া ঠিক হলে দুপুর ২:১৮ নাগাদ বিমানটি মেনডোজা থেকে সান্তিয়াগোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মেনডোজা থেকে সান্তিয়াগোর সোজা দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার কিন্ত এই পথে আন্দিজ পর্বতমালার উচ্চতা ২৫০০০- ২৬০০০ ফুট এবং এফএইচ ২২৭ডি বিমান সর্বোচ্চ ২৮,০০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে যেতে পারতো কিন্তু পূর্ন লোড অবস্থায় এই পথে যাওয়া বিপদজনক যে কোনও সময় দুর্ঘটনা হতে পারে যে কারনে মেনডোজা থেকে ম্যালার্গ পর্যন্ত ৬০০ কিলোমিটার ইউ আকৃতি পথ ঘুরে তারপর চিলি যেতে হয় এই ধরনের বিমানকে, এতে অতিরিক্ত ৯০ মিনিট সময় বেশী লাগে। এই এফএইচ ২২৭ডি বিমানটি মাত্র চার বছর পুরোনো এবং বিমানের পাইলট জুলিও ফেরাদাস এর আগে ২৯ বার এই পথে বিমান নিয়ে গিয়েছিল। ৩:২১ পর্যন্ত বিমানের যাত্রা আরামদায়কই ছিল। ৩:২১ নাগাদ বিমানটি প্ল্যানচোন পাসে পৌঁছায়, এখান থেকে সান্তিয়াগোর বিমানবন্দর আরও ৬০- ৭০ কিলোমিটার যাতে সময় ১১ মিনিট কিন্ত ৩:২২ নাগাদই বিমানটির সহকারী পাইলট সান্তিয়াগোর বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে নীচে নামবার অনুমতি চায়। আসলে মেঘের কারনে বিমানের পাইলট বিমানটির সঠিক অবস্থান বুঝতে পারেনি। পাইলট বিমনটিকে নীচে নামাতে শুরু করে কিন্ত পাইলট জানতোনা সে এখনও আন্দিজ পর্বতমালার উপরেই আছে। হঠাৎই পাইলট খেয়াল করে তার সামনে পর্বতের অংশ। পাইলট শেষ মহূর্তে বিমানটিকে উপরে ওঠানোর চেষ্টা করে কিন্ত বিমানের শেষ অংশ পর্বতে ধাক্কা খায় এবং বিমানের পেছনে থাকা তিনজন যাত্রী সাথে সাথে সেখান দিয়ে ছিটকে বাইরে বেড়িয়ে যায় এবং তাদের মৃত্যু হয়। বিমানটি ওই অবস্থায় ২০০ মিটার উপরে ওঠার পর বিমানের বাম ডানা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যায় এবং আরও দুজন যাত্রীর মৃত্যু হয়। বিমানের সামনের অংশ ৩৫০ কিলোমিটার প্রতিঘন্টা গতিতে একটি গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে ৭২৫ মিটার নীচে গড়িয়ে এসে বরফের স্তূপে সোজোরে ধাক্কা খায় যাতে বিমানের পাইলট ফেরাদাস সাথে সাথে মারা যায়। উরুগুয়ে বায়ুসেনার ফ্লাইট ৫৭১ এর ধ্বংসাবশেষ আন্দিজ পর্বতমালায় কোন এক স্থানে প্রায় ৩,৮০০ ফুট উচ্চতায় পড়েছিল। এতবড় দুর্ঘটনার পরেও বিমানে ৩৩ জন যাত্রী কোনওরকমে বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু তাদের মধ্যে বেশীরভাগই আহত ছিল।
দুর্ঘটনার এক ঘন্টার মধ্যে চিলির উদ্ধারকারী দল চারটি বিমানে উদ্ধারকার্যের জন্য রওনা দেয় কিন্তু অনেক খুঁজেও বিমান দুর্ঘটনার স্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৩ অক্টোবর রাতেই পাঁচজন যাত্রীর মৃত্যু হয় অত্যাধিক ঠান্ডা ও আঘাতে। ফলে বেঁচে থাকা যাত্রীদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৮ জনে, পরেরদিন ১৪ অক্টোবর আর্জেন্টিনা, চিলি ও উরুগুয়ের এগারোটি বিমান উদ্ধারকার্য শুরু করবার জন্য রওনা দেয়। বেঁচে যাওয়া বাকি যাত্রীরা বিমানের উপর লিপস্টিক দিয়ে এসওএস লেখার চেষ্টা করে কিন্তু পর্যাপ্ত লিপস্টিক ছিলনা, বিমানের যাত্রীরা ব্যাগ দিয়ে বড় ক্রশ তৈরি করে বরফে কিন্ত তাও কোনও কাজ হয়নি। বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানের রং সাদা হওয়ায় সেদিনও দুর্ঘটনার স্থান জানা সম্ভব হয়নি। ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪২ ঘন্টা উদ্ধারকার্যের চেষ্টা করেও যখন বিমানের কোন ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন ধারনা করে নেওয়া হয় গ্রীষ্মকালে বরফ না গলা অবধি কোন মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাবেনা এবং উদ্ধারকার্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুর্ঘটনার দুদিনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা যায় তা হল জলের সমস্যা এবং স্নো ব্লাইন্ডনেস। সূর্যের আলো যখন বরফে পড়ে প্রতিফলিত হয় তখন তা চোখের ক্ষতি করে। বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে সোলার কালেক্টার জোগাড় করে কোনওরকমে বরফ গলিয়ে জল সংগ্রহ করা হয় অল্প পরিমানে। এই বিমানের যাত্রীরা সবাই সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা থাকার কারনে হঠাৎ করে – ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এসে তাদের শরীর পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলনা। এরই মধ্যে বিমানের মধ্যে একটি ভাঙ্গা রেডিও পাওয়া যায় অনেক চেষ্টা করে সেই রেডিও ঠিক করে দেখা যায় বাইরের ঘটনা শোনা যাচ্ছে কিন্ত কোন বার্তা পাঠানো যাচ্ছেনা। রেডিওর মাধ্যমে সবাই জানতে পারে উদ্ধারকার্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যা শুনে অনেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। এগারো দিন পর যাত্রীদের মধ্যে খাদ্য সমস্যা দেখা দেয়। তাদের কাছে আটটি চকলেট বার, ক্যান্ডি, তিনটি জ্যামের পাত্র, অল্প আমন্ড বাদাম, ঝিনুক, শুকনো কুমড়ো, অল্প খেজুর ও কয়েক বোতল মদ ছিল। অবস্থা এমন হয় যে একটা চকলেট বাদাম তিন দিন ধরে খেয়েও খাদ্য সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৩,৮০০ ফুট বরফাচ্ছাদিত এলকায় কোন পশু ও গাছ পর্যন্ত ছিলনা খাবার মতোন। অনেকে বিমানের সিটের ভিতর থাকা তুলো ও চামড়া খাবার চেষ্টা করে যার ফলে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে আরও একজন যাত্রী মারা যায় ফলে বাকী থাকে আর ২৭ জন।
খাদ্য সংকটে বাধ্য হয়ে তারা নিজেদেরই সাথীদের যারা মারা গিয়েছিল তাদের মাংস খাওয়া শুরু করে। ২৯ অক্টোবর রাতে হঠাৎই পাহাড় থেকে বরফের ধ্বস নেমে বিমানের ভাঙা অংশের উপর পড়ে যার ভিতর যাত্রীরা কোনওরকমে থাকছিল। এই বরফধ্বসে চাপা পড়ে আটজন মারা যায়। বাকী ১৯ জন যাত্রী কোনওরকমে বরফে চাপা পড়েই বিমানের ভিতর পাঁচদিন কাটায় কারন বাইরে তুষার ঝড় চলছিলো। পাঁচদিন পর সবাই বাইরে এসে ঠিক করে এভাবে দুর্ঘটনার স্থানে বসে থাকলে চলবেনা তাদের চেষ্টা করে লোকালয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। ১৫ নভেম্বর, দুর্ঘটনার তিনদিন পর বিমানের তিনজন যাত্রী কেনেসা, প্যেরাডো এবং ভিজিন্টিন পর্যাপ্ত মাংস নিয়ে পশ্চিম দিকে যেতে শুরু করে কোন লোকালয়ের আশায়। কয়েকঘন্টা যাবার পর তারা তাদের বিমানের লেজের অংশ খুঁজে পায় সেখানে রামের বোতল, চকলেট, সিগারেট, মাংস সহ জামাকাপড় খুঁজে পায় তারা। সেখানে একটি রেডিও পাওয়া যায়, বিমানের লেজের অংশ থেকে একটি ব্যাটারি দিয়ে রেডিও চালু করে বাইরে যোগাযোগের চেষ্টা করে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয় কারন রেডিও চলার জন্য ১১৫ ভোল্ট এসির দরকার ছিল কিন্তু ব্যাটারি ছিল ২৪ ভোল্ট ডিসি।
১৫ ডিসেম্বর দুর্ঘটনার ৬০ দিনের মাথায় আবারও তুষার ধ্বসে তিনজন যাত্রীর মৃত্যু হয় এবং বেঁচে থাকা যাত্রী সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১৬ জনে। কেনেসা, প্যেরাডো এবং ভিজিন্টিন আবারও পশ্চিম দিকে যেতে শুরু করে। বহুকষ্টে তারা একটি পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে দেখতে পায় চারদিকে শুধু বরফাচ্ছাদিত পাহাড়। অকস্মাৎ বহুদূরে একটি পাহাড় দেখতে পায় যেখানে বরফ ছিলনা, তারা ভাবে ওটা চিলি। কিন্ত এরই মধ্যে খাবারের সমস্যা দেখা দেয়, তাদের কাছে মাত্র তিন দিনের খাবার ছিল যার কারনে ভিজিন্টিন পুনরায় দুর্ঘটনার জায়গায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কেনেসা ও প্যারাডো এগিয়ে যাবে ঠিক করে। যেপথে তিনদিন ধরে ট্রেক করে এসেছে সেই পথে মাত্র এক ঘন্টায় দুর্ঘটনার স্থানে ফিরে যায় ভিজিন্টিন। বিমানের সিটের অংশ স্লেজ হিসবে ব্যবহার করে ঢালু পার্বত্যপথ ধরে গড়িয়ে পূর্বের স্থানে ফিরে যায় ভিজিন্টিন। কেনেসা ও প্যারাডো আরও কিছুক্ষন ট্রেক করার পর পর্বতের মাঝে নদী দেখতে পায়, নদীর গতির অভিমুখে তারা আরও নয়দিন ট্রেক করার পর ২০ ডিসেম্বর তারা জনবসতির কিছু লক্ষন দেখতে পায়। হঠাৎই নদীর অপর পাড়ে ঘোড়ায় চড়া তিনজন মানুষকে দেখতে পায় তারা, সেই মানুষ গুলোও তাদের দেখতে পায়। কিন্ত সেদিন যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি নদীর আওয়াজের কারনে। পরেরদিন সেই তিনজনের একজন একটি কাগজ পাথরে বেঁধে, পেন্সিল সহ প্যারাডো ও কেনেসার দিকে ছুঁড়ে দেয়, প্যারাডো এই কাগজে তাদের দুর্ঘটনার সমস্ত তথ্য জানায়। সার্গিও কাটালান নামে চিলির ওই কৃষক এই তথ্য দশ ঘন্টা যাত্রা করে চিলির সেনাবাহিনীকে পৌঁছে দেয়। প্যারডো ও কেনেসাকে লস মেইটেন্স শহরে আনা হয়, সেখানেই তারা জানায় দশদিন ধরে ৬১ কিলোমিটার যাত্রা করে তারা এখানে এসেছে। বেঁচে থাকার জন্য তাদের ৭২ দিনের সংগ্রামের কথা আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে যায়। চিলির মিলিটারি তিনটি হেলিকপ্টারে করে উদ্ধারকার্য শুরু করে, প্যারাডোকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়, অবশেষে ২২ ডিসেম্বর দুর্ঘটনার ৭০ দিন পর বাকী ১৪ জনকে উদ্ধার করা হয়।