ফিচার আর্টিকেল

সিন্ধ প্রদেশ পাকিস্তানের থেকে আলাদা হতে চাওয়ার পেছনে কি কারন ছিল?

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান একই সাথে ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা পায়। বিগত সাত দশকে ভারত যখন নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে তখন পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে প্রায়ই নতুন দেশ গঠনের দাবী ওঠে। গত সাত দশকে ভারত যখন নিজেকে অর্থনৈতিক ও সমরিক সুপার পাওয়ার তৈরি করার চেষ্টায় ছিল তখন পাকিস্তান তার বেশীরভাগ বাজেট সেনাবাহিনী ও জঙ্গী সংগঠনের প্রতি ব্যায় করে ভারতে নাশকতার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। যার ফলস্বরূপ অর্থিকভাবে সম্পূর্ন বিপর্যস্ত হয়ে যায় পাকিস্তান দেশটি। আজ পাকিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হওয়ার ডাক উঠছে। যেমন পাকিস্তানেরই একটি প্রদেশ সিন্ধ প্রদেশে মানুষ রীতিমতো বিক্ষোভ করছে আলাদা দেশ গঠনের জন্য। “ সিন্ধ বানেগা সিন্ধুদেশ “ স্লোগান প্রায় সময়ই শোনা যায় সিন্ধ প্রদেশে। এই অঞ্চলের মানুষদের দাবী তারা কোনওদিনই পাকিস্তানের অংশ ছিলনা, পাকিস্তান জোর করে তাদের ভূমি দখল করেছে। আজ সিন্ধ প্রদেশে লোক শুধু পাকিস্তান নয় বরং চীনের প্রতিও বিক্ষোভ দেখাচ্ছে তাদের দাবী চীনই অর্থনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী কাজকর্মের জন্য। 

পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে একটি হল সিন্ধ প্রদেশ যা আয়তনের দিক দিয়ে পাকিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ। সিন্ধ প্রদেশের পশ্চিমে বালুচিস্তান, উত্তরে পাকিস্তানি পাঞ্জাব, পূর্বে ভারতের রাজস্থান ও গুজরাট ও দক্ষিনে আরব সাগর রয়েছে। সিন্ধু নদীর নাম অনুযায়ী এই প্রদেশের নাম হয়েছে সিন্ধ। মহাভারতে সিন্ধ প্রদেশের উল্লেখ ছিল তখন এই অঞ্চলের রাজা ছিল জয়দ্রথ। সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র ছিল এই সিন্ধ প্রদেশ যার কারনে এখানকার অধিবাসীরা তাদের বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার অংশ মনে করে। এই প্রদেশে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শাসকরা শাসন করেছে, ষোলো শতকে সিন্ধ প্রদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়। মুঘল সম্রাট আকবরের জন্ম হয়েছিল এই সিন্ধ প্রদেশের উমরকোটে। আকবরের সময়েই সিন্ধ মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়েছিল। ১৮৪৩ সালে ব্রিটিশরা সিন্ধ দখল করে নেয়। উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ অভিযাত্রী রিচার্ড বার্টনের কথায় সিন্ধ ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে শান্ত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি ছিল। ব্রিটিশরা সিন্ধ দখল করার পর সিন্ধকে বোম্বে প্রেসিডেন্সির অংশ করে। কিন্তু বোম্বে থেকে সিন্ধের দূরত্ব বেশী হওয়ায় বোম্বে প্রেসিডেন্সির অধীনে সিন্ধ দীর্ঘদিন অবহেলিত প্রদেশ ছিল। ব্রিটিশ শাসনে সিন্ধকে পাঞ্জাবের সাথে যুক্ত করারও প্রস্তাব উঠেছিল কিন্তু ব্রিটিশরা তা করেনি। 

উনিশ শতকের প্রথমের দিকে সিন্ধে আন্দোলন শুরু হয় বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা হওয়ার জন্য, এই সুযোগে ব্রিটিশরা সিন্ধকে ১৯৩৬ সালে বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা করে একটি ভিন্ন প্রদেশের মর্যাদা দেয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের সময় সিন্ধ পাকিস্তানের অংশ হয়। পাকিস্তান গঠনের সময় যেমন পাঞ্জাব ও বাংলা দুই দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় কিন্তু সিন্ধ প্রদেশের সাথে এমন ঘটেনি, সিন্ধের আয়তন নয় বরং জনসংখ্যা ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তান গঠনের সময় সিন্ধ অঞ্চল থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে চলে আসে এবং ভারত থেকে বেশ কিছু মুসলিম জনসংখ্যা সিন্ধে চলে যায়। পাকিস্তানে ভারত থেকে যাওয়া এই মুসলিম জনসংখ্যাকে মুহাজির নাম দেওয়া হয়। বর্তমানে পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৭.৫ শতাংশ এই মুহাজির। ভারত থেকে যাওয়া মুহাজিররা স্থানীয় সিন্ধদের থেকে শিক্ষিত হওয়ায় দ্রুত সরকারি চাকরি সহ ব্যবসায় মুহাজিরদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। এমনকী পাকিস্তানের রাজনীতিতেও পাঞ্জাবি ও সিন্ধি মুহাজিরদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে মুহাজিরদের কারনে স্থানীয় সিন্ধিরা বুঝতে পারে তারা অবহেলিত হচ্ছে পাকিস্তানে এবং তাদের সম্পত্তি সহ সমস্ত কিছু মুহাজিরদের অধীনে চলে যাচ্ছে। 

পাকিস্তানের ৬৩ শতাংশ রাজস্ব এই সিন্ধ থেকেই আসে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৬৫ শতাংশই পাঞ্জাবি। ভারত থেকে যওয়া মুহাজিরদের প্রধান ভাষা ছিল উর্দু যা সিন্ধের সাধারন মানুষদের ভাষা থেকে ভিন্ন ছিল। উপরন্তু পাকিস্তান তাদের সরকারি ভাষা হিসাবে উর্দুকে ঘোষনা করে যা জোর করে চাপিয়ে দেয় অন্যান্য ভাষা গোষ্ঠীর মানুষের উপর। পাকিস্তানের বিখ্যাত লেখক ফারহান হানিফ সিদ্দিকী তার বই দি পলিটিকস অফ ইথনিসিটি ইন পাকিস্তান বইয়ে লিখেছেন পাকিস্তান সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারনে সমস্যায় পড়ে সিন্ধ প্রদেশের নাগরিকরা, সরকারি চাকরি পেতে গেলেও তাদের বাধ্য হয়ে উর্দু শেখার প্রয়োজন হচ্ছে। 

১৯৫৫ সালে পাকিস্তান এক ইউনিট পরিকল্পনার মাধ্যমে বালুচিস্তান, সিন্ধ, পাকিস্তানি পাঞ্জাব এবং উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টিয়ারকে পশ্চিম পাকিস্তান ঘোষন করে এবং পূর্ব পাকিস্তান আগেই আলাদা প্রদেশ ছিল। এই পশ্চিম পাকিস্তান ঘোষনার কারনে সিন্ধ প্রদেশের উপর পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের আধিপত্য বেড়ে যায় যার কারনে ১৯৭০ এর দিক থেকে সিন্ধ প্রদেশে আসতে আসতে জাতীয়তাবাদ চেতনা গড়ে উঠতে শুরু করে। এই চেতনায় আরও বিস্তার পায় যখন পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। তখন থেকে সিন্ধ প্রদেশে ধীরে ধীরে পাকিস্তান বিরোধী জনমত গড়ে উঠতে শুরু হয়। সিন্ধ প্রদেশের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী গোলাম মোর্তাজা সৈয়দ এবং আলি মহম্মদ রাশিদি সিন্ধুদেশ গঠনকে সমর্থন করে ১৯৭০ সালে। মোর্তাজা সৈয়দ তার বই এ নেশন ইন চেনস সিন্ধুদেশ বইয়ে সিন্ধুদেশ গঠনের নীল নকশা দিয়েছে, এই বইয়ে তিনি বলেছেন পাঁচ হাজার বছর ধরে সিন্ধের অধিবাসীদের একটি নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশের মতোন স্বাধীন সিন্ধুদেশ গঠনের দাবী করেন। ১৯৮০ সাল আসতে আসতে রীতিমতো সিন্ধ প্রদেশে পাকিস্তানের পাঞ্জাব অধুষ্যিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই বিদ্রোহকে দমিয়ে দেয়। 

১৯৮০ সালের শেষের দিকে সিন্ধ ন্যাশানাল অ্যালয়েন্স দল গঠন হয় পাকিস্তানে যার নেতা হয় মোর্তজা সৈয়দ। কিন্ত ১৯৮৮, ১৯৯০ ও ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানে নির্বাচনে একটি আসন পায়নি মোর্তাজা সৈয়দের দল। বর্তমানে সিন্ধ প্রদেশে জে সিন্ধ কোয়ামি মাহাজ, ওয়াল্ড সিন্ধি কংগ্রেস, সিন্ধুদেশ লিবারেশন আর্মি, জে সিন্ধ তারাক্কি পাসান্দ পার্টি একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা সময়ে সময়ে সিন্ধুদেশ গঠনের জন্য আন্দোলন করছে সিন্ধ প্রদেশে, এইসব দলই মোর্তাজা সৈয়দের আদর্শে অনুপ্রানিত। সিন্ধুদেশ লিবারেশন আর্মির মতোন সংগঠন বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মির মতোই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন করে। সিন্ধ অঞ্চলে একদিকে যখন করাচির মতো বড় বন্দর রয়েছে তখন অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের কোনও উন্নয়ন আজও হয়নি যার কারনে সিন্ধ অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ রয়েছে যে পাকিস্তান সরকার ইচ্ছে করেই সিন্ধ প্রদেশের জনসংখ্যা কম দেখিয়ে এখানের জন্য বাজেট কম দেয়। সিন্ধ প্রদেশে কৃষিকাজের সুযোগসুবিধাও করে দেয়নি পাকিস্তান সরকার। সিন্ধ অঞ্চলে জলের স্তর কম তাসত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার কৃষিকাজের জন্য জলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করেনি পাকিস্তান সরকার, উপরন্তু সিন্ধ প্রদেশের জন্য বরাদ্দ থাকা অধিকাংশ জল ব্যবহার করা হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ৫০,০০০ একর জমির জন্য। এছাড়া ২০১৯ সালে শুরু হওয়া করোনা, শস্যে পতঙ্গের আক্রমন ও ২০২০ সালে বন্যার কারনে এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে কিন্ত তবুও পাকিস্তান সরকার সিন্ধ প্রদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রতি উদাসীন থাকে। 

জাতিসংঘের মানব অধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সিন্ধ প্রদেশে অনৈতিক গ্রেফতার, অপহরন, হত্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিমান বাড়ছে ক্রমশ। ওয়াল্ড সিন্ধ কংগ্রেসের হিসাব অনুযায়ী বিগত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, সরকার বিরোধী মানুষদের গুম হত্যা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখানকার মানুষদের মিথ্যে সন্ত্রাসী অভিযোগে গ্রেফতার করে অত্যাচার করে যাতে তারা এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ঠিক এমনই বালুচিস্তান প্রদেশেও করে থাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। 

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বালুচিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার নাগরিককে গুম করেছে যাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি, সিন্ধ প্রদেশেও হিসাবটা এরকমই। পাকিস্তান সরকার এখানকার ভূমি নাগরিকদের থেকে জোর করে কম দামে কিনে তা চীনকে উপহার দিচ্ছে বা শিল্পপতিদের বেশী দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। সিন্ধ অঞ্চলের কয়লা, গ্যাস, তেল পাকিস্তান সরকার পর্যাপ্ত পরিমানে ব্যবহার করে কিন্তু সাধারন মানুষ ততটা সুবিধা পায়না। এসব কারনে সিন্ধ প্রদেশে পাকিস্তান বিরোধী জনমত গড়ে উঠছে দ্রুত এবং এই অঞ্চলে তেহরিক ই তালিবান বা টিটিপির মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনের উপস্থিতি বাড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.