সোভিয়েত ইউনিয়নের হাইড্রোজেন বোম্ব পরীক্ষার ব্যাপারে জানতে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের গোপন অপারেশান- প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু বাস্তবে হয় ঠিক তার বিপরীত। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও একটি যুদ্ধের সূচনা হয় তবে এই যুদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র নিয়ে কোনও সরাসরি যুদ্ধ ছিলনা বরং এই যুদ্ধ ছিল একে অপরের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, স্নায়ুর চাপ ধরে রাখার সংঘর্ষ, ইতিহাসে এই ঘটনা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই পক্ষে থাকা আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের এই লড়াই বিশ্বকে সেসময় দুটি মেরুতে ভাগ করে দিয়েছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই শীতল যুদ্ধ চলেছিল। এইসময় দুই দেশ বহু গোপন প্রজেক্ট, মিশনে কাজ করছিল।
এমনই এক বিচিত্র মিশন হয় ১৯৫৪ সালের দিকে, যাতে কে জেতে বা কে হারে তা বলা মুস্কিল। এই মিশনের পটভূমি রচনা হয় ২৯ আগস্ট, ১৯৪৯ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমানু বোম্বের পরীক্ষা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সফল পরমানু পরীক্ষার খবর আমেরিকার কাছেও পৌঁছায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সফল পরমানু পরীক্ষন আমেরিকার কাছে রীতিমতো হুমকি ছিল। পরমানু পরীক্ষনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার মতোই সুপার পাওয়ার দেশের মর্যাদা পেয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও একটি ঘটনা ঘটে তা হল জার্মানির বিভাজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়, পূ্র্ব জার্মানি যার নিয়ন্ত্রন যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে এবং পশ্চিম জার্মানি যার নিয়ন্ত্রন যায় মিত্রশক্তি অর্থাৎ আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হাতে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও দুই ভাগে ভাগ করা হয় সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব বার্লিন ও আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম বার্লিন। এইসময় পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে এবং পশ্চিম জার্মানিতে গনতন্ত্র ও পুঁজিবাদ প্রভাব বিস্তার করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পরমানু পরীক্ষনের পরই আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ খবর পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন গোপনে হাইড্রোজেন বোম্ব পরীক্ষার তোড়জোড় করছে যা পরমানু বোম্বের থেকেও শক্তিশালী। সিআইএ ঠিক করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এরকম কী কী গোপন প্রজেক্টে কাজ করছে সে ব্যাপারে পূর্ন নজরদারি করতে হবে। যার কারনে সিআইএ একটি গোপন মিশনের পরিকল্পনা করে যাতে ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআইসিক্সও সহায়তা করে সিআইএকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নজরদারির জন্য সিআইএ ও এমআইসিক্স যৌথভাবে এমন এক অপারেশন করেছিল যার কোনও ফলাফলই পাওয়া যায়নি। বিচিত্র এই মিশনের ব্যার্থতা দাবী করে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিন্ত আমেরিকার মতে এই মিশন যথেষ্ট সফল।
সিআইএ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অপারেশনের জন্য প্রথম তাদের এজেন্ট বিল হার্ভিকে পশ্চিম বার্লিন পাঠায়। বিল হার্ভি পশ্চিম বার্লিনে অপারেশনের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে শুরু করে। অবশেষে পশ্চিম বার্লিনে মাটির তলায় ছয় ফুট, সাত ইঞ্চি একটি সুড়ঙ্গ খুঁজে পায় সিআইএ যা তাদের অপারেশনের জন্য উপযুক্ত ছিল। এই অপারেশনের সমস্ত খরচ সিআইএ বহন করে এবং মিশনের প্রযুক্তিগত বিভাগের দায়িত্বে থাকে এমআইসিক্স। সিআইএর লক্ষ্য ছিল পূর্ব বার্লিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ফোনে আড়ি পাতা, যার কারনে পশ্চিম বার্লিনের ওই নির্দিষ্ট সূড়ঙ্গ দিয়ে পূর্ব বার্লিন পর্যন্ত সূড়ঙ্গ তৈরি করে তার মধ্যে দিয়ে ফোনের আড়ি পাতার জন্য তার সহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সিআইএ। সোভিয়েত গুপ্তচরদের এড়িয়ে এই মিশন করা যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিন্তু এমআইসিক্সের এই ধরনের মিশনের অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৪৯ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে সোভিয়েত অফিসারদের ফোনে আড়ি পাতার এমনই এক মিশন করেছিল এমআইসিক্স। ওই মিশনের নাম ছিল অপারেশন সিলভার। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই সিআইএ পূর্ব বার্লিনে তাদের অপারেশনের নাম দেয় অপারেশন গোল্ড।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৪ সাল থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ২৩ ফুট গভীর সূড়ঙ্গ তৈরি করে এমআইসিক্স। এতদিন পর্যন্ত সিআইএ ও এমআইসিক্স যেমন চাইছিল তেমন গোপনীয় ভবেই হয় এই প্রজেক্ট। সূড়ঙ্গ তৈরি শেষ হলে গোটা সূড়ঙ্গে বিস্ফোরক দিয়ে ভর্তি করা হয় যাতে মিশন শেষ হওয়ার পর সূড়ঙ্গ ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এই সূড়ঙ্গ খনন করতে তখন খরচ হয় প্রায় সাড়ে প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলার যা আমেরিকার লকহিড মার্টিনের ইউ ২ গোয়েন্দা বিমানের দামের থেকেও বেশী ছিল। তৎকালীন সময়ে পূর্ব বার্লিন ও পশ্চিম বার্লিনের সবচেয়ে বিপদজনক সীমান্তের তলায় ৪৫০ মিটার লম্বা সূড়ঙ্গ তৈরি করে অসাধারন কারিগরি বিদ্যার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল এমআইসিক্স। সূড়ঙ্গ তৈরি ছিল অপারেশন গোল্ডের প্রথম ধাপ। এরপর দ্বিতীয় ধাপে পূর্ব জার্মানির সোভিয়েত অফিসারদের ফোন ট্যাপ করা শুরু হয়। সিআইএ ও এমআইসিক্স সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ৬৭,০০০ ফোন কলকে ট্যাপ করেছিল। ফোন কলের বার্তা সরাসরি লন্ডন পাঠানো হত বিশ্লেষনের জন্য। এই ফোন ট্যাপের মাধ্যমে আমেরিকা ও ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক গোপন তথ্য জানতে পারে। কিন্ত এখানে একটা মজার ব্যাপার ছিল তাহল এই সূড়ঙ্গের ব্যাপরে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই জানতো। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে অপারেশন গোল্ডের সূচনা লগ্ন থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এই মিশনের যাবতীয় তথ্য ছিল। কারন সূড়ঙ্গ তৈরির জন্য সিআইএ ও এমআইসিক্সের এজেন্টদের মধ্যে যখন বৈঠক হত তখন সেখানে জর্জ ব্ল্যাক নামে এক ব্রিটিশ এজেন্ট উপস্থিত ছিল যে এমআইসিক্সের পাশপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইনটেলিজেন্স সংস্থা কেজিবির হয়েও কাজ করতো। অর্থাৎ জর্জ ব্ল্যাক ডবল এজেন্ট ছিল।