পৃথিবীর সবথেকে ধনী দেশ লুক্সেমবার্গকে কেন বলা হয় জানেন?
রাজেশ রায়:– পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোক দেশের কথা বলা হলে প্রথমেই মাথায় আসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাম কিংবা চীন বা সুইজারল্যান্ডের নাম। জিডিপির দিক দিয়ে আমেরিকা সবার আগে এটা ঠিকই কিন্তু যখনই মাথা পীছু আয়ের কথা বিচার করা হয় তাহলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী লুক্সেমবার্গ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ। লুক্সেমবার্গ কী করে এত ধনী দেশ হল? দেশটির ইতিহাস কী এবং দেশটির জিওপলিটিক্যাল গুরুত্ব কতটা, এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
প্রথমেই জানা যাক লুক্সেমবার্গের অবস্থান সম্পর্কে। ভারতের উত্তর পশ্চিমে রয়েছে ইরান, তার পাশে কাস্পিয়ান সাগর, এরপর আসে কিষ্ন সাগর এবং এরপরেই ইউরোপ। এই ইউরোপের একটি ছোট দেশ হচ্ছে লুক্সেমবার্গ। ইউরোপের সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান সিটি যা রোমে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে ছোট দেশ লুক্সেমবার্গ যা একটি ল্যান্ড লকড দেশ। লুক্সেমবার্গ দুটি ইউরোপীয়ান মহাশক্তি ফ্রান্স ও জার্মানির মাঝে অবস্থিত, এছাড়াও বেলজিয়ামের সাথেও সীমানা আছে লুক্সেমবার্গের। দেশটির রাজধানী হচ্ছে লুক্সেমবার্গ শহর। দেশটির উত্তরাংশকে বলা হয় ওয়েস লিংক, এখানে অনেক পাহাড় রয়েছে। দেশটির দক্ষিনাংশকে বলা হয় গুটল্যান্ড, জার্মান ভাষায় যার অর্থ ভালো জমি অর্থাৎ দক্ষিনাংশে বসতি বেশী, চাষ ভাল হয়, উর্বর জমি রয়েছে। তবে লুক্সেমবার্গে চাষ খুবই কম হয় কারন দেশটি বেশীরভাগ খাদ্য আমদানি করে। তবে এই দক্ষিনাংশের গুরুত্ব ছিল একদিন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এখানে লোহার খনি ছিল এবং স্টিল তৈরি হত। তবে ১৯৮০ সালের পর লোহা পাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এখানে। দেশটিতে ইউরেনিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাসের মতোন কোন মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদও পাওয়া যায়না।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গুলোর অবস্থান বললে আরও ভালো ভাবে লুক্সেমবার্গের অবস্থান বোঝা যাবে। দক্ষিন ইউরোপে রয়েছে পর্তুগাল, স্পেন, অ্যান্ডোরা, ইটালি মতোন দেশ, মধ্য ইউরোপে রয়েছে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়ার মতোন দেশ, দক্ষিন পূর্ব ইউরোপে রয়েছে স্লোভানিয়া, বসিনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়ার মতোন দেশ, পূর্ব ইউরোপে আছে এস্তোনিয়া, লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেনের মতোন দেশ এবং পশ্চিম ইউরোপে আছে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়ামের মতোন দেশ। অর্থাৎ লুক্সেমবার্গ পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত, এছাড়াও ইউরোপে ইউনাইটেড কিংডম রয়েছে যার মধ্যে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড পড়ে। লুক্সেমবার্গের সরকারি ভাষা তিনটি লুক্সেমবার্গিস, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান। লুক্সেমবার্গিস ভাষা জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষার মিশ্রন। সেখানকার সব স্কুল, কলেজেও ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষা শেখানো হয়। আসলে ফ্রান্স ও জার্মানি দুই মহাশক্তির মাঝে অবস্থিত হওয়ায় দুই দেশের সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে দেশটির উপর। লুক্সেমবার্গকে ইউরোপের দুর্গের শহরও বলা হয় কারন দেশটিতে প্রচুর দুর্গ রয়েছে। দেশটির উত্তরাংশে প্রচুর দুর্গ আছে কারন ফ্রান্স ও জার্মানির মাঝে অবস্থিত হওয়ায় এই দুই দেশের যুদ্ধের সময় লুক্সেমবার্গ নিজের দেশবাসীর সুরক্ষার জন্য দুর্গ তৈরি করেছিল।
দেশটির রাজধানী লুক্সেমবার্গ শহরকে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো সংরক্ষিত জায়গার তকমা দেয় এসব দুর্গের কারনে। দেশটির সর্বোচ্চ উচ্চ জায়গা বুরজাপলাজ যার উচ্চতা মাত্র ১৮৪৩ ফুট। দেশটিতে অনেক নদী আছে যেমন এইশ, আওয়ার, সিওর, মসেল। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী হচ্ছে মসেল। তবে এসব নদী সবই ফ্রান্স ও জার্মানি হয়ে বয়ে গিয়েছে। অতিরিক্ত ঘন বন ও সবুজের সমারোহের জন্য দেশটিকে ইউরোপের সবুজ হৃদপিণ্ড বলা হয়।
তবে প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্বেও অত্যাধিক বড়লোক লুক্সেমবার্গের মানউস। কাতার ও লুক্সেমবার্গের মানুষের মাথা পীছু আয় সবচেয়ে বেশী। লুক্সেমবার্গ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যাদের মানুষের মাথা পীছু গড় আয় বছরে ১ লাখ ১৮ হাজার ডলার বা প্রায় ৯৪ লাখ টাকা। বিশ্বের আর কোনও দেশের মানুষের এত আয় নেই। পৃথিবীর মাত্র এগারোটি দেশের মানুষের মাথা পীছু গড় আয় বছরে ৫০,০০০ ডলার, ৩৯ টি দেশের ২০,০০০ ডলার এবং ৬৬ টি দেশের ১০,০০০ ডলার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন লুক্সেমবার্গ কতটা ধনী দেশ। এখানকার মানুষদের সবচেয়ে পচ্ছন্দের গাড়ি হচ্ছে অডি। এই ছোট্ট দেশটিতে অডি তাদের তৃতীয় সর্বোচ্চ গাড়ি বিক্রি করে। তাহলে এবার একটা কথা মনে হতে পারে লুক্সেমবার্গ কী সবসময়ই এত ধনী ছিল! দেশটির এত পয়সা এল কীভাবে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত লুক্সেমবার্গ একটি মধ্য অর্থনীতির দেশ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের উত্থান শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো ইউরোপ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছিল। বোম্বিংএ ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম সহ সব দেশগুলোর প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। যারজন্য আমেরিকা ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য মার্শাল প্ল্যান ঘোষনা করে। নতুন করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করতে দরকার হয় লোহার এবং লুক্সেমবার্গে অনেক লোহার খনি ছিল। শুধু সম্পদ থাকলেই হবেনা তা যদি সহজে খরিদ্দারের কাছে পৌছায় তাহলে লাভ অনেক বেশী হয়।
লুক্সেমবার্গের অবস্থান এতটাই ভাল জায়গায় যে খুব সহজেই লোহা, জার্মানি, ফ্রান্স সহ ইউরোপে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। রাশিয়ার কাছে তেল পাওয়া যায় কিন্তু রাশিয়ার অবস্থান খানিকটা বিছিন্ন, রাশিয়ার অবস্থান যদি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক দেশগুলোর কাছে হত তাহলে রাশিয়ার লাভ আরও বেশী হত। স্টিল বিক্রি করে লুক্সেমবার্গ প্রচুর পয়সা উপার্জন করেছিল। আজ যদিও লোহা তেমন আর পাওয়া যায়না এখানে কিন্তু তবুও বিশ্বের বড় বড় স্টিল সংস্থা গুলোর মুখ্য কার্যালয় এখানেই। এখানকার একটি বিখ্যাত স্টিল সংস্থা হচ্ছে আর্সেলেলোরমিত্তাল। ২০০৬ সালে আর্সেলোর সংস্থা ও মিত্তাল গ্রুপ একসাথে মিশে গিয়ে এই নতুন সংস্থাটি তৈরি হয় যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টিল উৎপাদন সংস্থা। ২০১৭ সালে এটি বিশ্বের ১২৩ তম বড় সংস্থার লিস্টে জায়গা করে নিয়েছিল। অনেকে এই সংস্থাটিকে ভারতীয় সংস্থা মনে করলেও আদতে এটি একটি লুক্সেমবার্গের সংস্থা যার সিইও লক্ষী মিত্তাল। লুক্সেমবার্গে মুখ্য কার্যালয় করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে কর ছাড়। লুক্সেমবার্গ দেশটি শুধু স্টিলের কারনেই এত বড়লোক হয় এর সাথে ১৯২৯ সালে একটি অদ্ভুত আইন পায় হয় এখানে যাতে এখানে বিনিয়োগ করা সংস্থাগুলিকে অবিশ্বাস্য কর ছাড় দেওয়া হয়। সেখানকার সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এত কর ছাড় দিলে প্রচুর সংস্থা এখানে আসবে, কম করে হলেও অনেক সংস্থার কর পাবে তারা, চাকরী, কর্মসংস্থান হবে। বাস্তবে তাই হয়, ১৯৮০ সালের পর থেকে বিশ্বের সমস্ত বড় বড় সংস্থা গুলোর শাখা সংস্থাগুলো এখানে তাদের অফিস খুলতে শুরু করে। এখানে কর ছাড়ের জন্য আরও একটি ব্যাপারে সংস্থা গুলো অফিস খোলে যেটা এরকম যে ধরুন অ্যাপেল সংস্থা আমেরিকার অ্যাপেল যদি লুক্সেমবার্গে তাদের একটি শাখা সংস্থা তৈরি করে অন্যকোনও নামে তাহলে লুক্সেমবার্গ শাখায় সেই সংস্থাটির যে আয় হয় তার কর লুক্সেমবার্গ সরকারকে দেওয়ার পাশাপাশি আমেরিকার সরকারকেও দিতে হবে। কিন্তু এখানে সংস্থাগুলি করে কী শাখা সংস্থাগুলি লুক্সেমবার্গ সরকারকে তাদের নামমাত্র কর দেওয়ার পর বাকী লভ্যাংশ তারা মূল সংস্থাকে লোন হিসাবে দেয় তাহলে এক্ষেত্রে মূল সংস্থাটি তার নিজের দেশের সরকারকে দেখাতে পারবে তাদের লোন লাভ হয়নি বরং তারা লোন নিচ্ছে। এরকম অনেক পদ্ধতিতে কর ছাড় পায় সংস্থা গুলো যার জন্য লুক্সেমবার্গের মানুষের সবচেয়ে পচ্ছন্দের পেশা হচ্ছে উকিল এবং ব্যাঙ্কার। ইউরোপের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় দেশটি ব্যাবসায়িক দিক দিয়ে যথেষ্ট আকর্ষনীয়। দেশটির ৫০ শতাংশ লোকই বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এখানে কাজ করে। তবে যতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে লুক্সেমবার্গ বড়লোক দেশ থাকবে যদি কোনওদিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে যায় তাহলে লুক্সেমবার্গের মতন ল্যান্ডলকড দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।