ভুটানের নির্বাচনের কারনে ভূ-রাজনীতিতে কতোটা লাভ হতে চলেছে ভারতবর্ষের?
ভূ-রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক যত মজবুত হবে ততই আন্তর্জাতিক স্তরে সেই দেশটির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার আমেরিকার সাথে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র রাশিয়া ছাড়া তেমন কোন দেশের সাথেই তাদের দ্বন্দ্ব নেই। ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতোন যে সমস্ত দেশের সাথে আমেরিকার বৈরী সম্পর্ক রয়েছে সেই সমস্ত দেশই আমেরিকার থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যার জন্য আমেরিকাকে তার প্রতিবেশী নিয়ে কোনওদিন সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্ত বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তিশালী দেশ ভারতের ভৌগলিক অবস্থান এমনই যে ভারতের প্রতিবেশী হিসাবে পাকিস্তান ও চীনের মতো পরমানু শক্তিধর চিরশত্রু দেশ রয়েছে। এছাড়া ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ গুলো যেমন নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কাতে সময়ে সময়ে চীন রাজনৈতিক সংকট তৈরি করার চেষ্টা করে। যেমন সম্প্রতি মালদ্বীপ ও ভারতের মধ্যে কুটনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। এর আগে মালদ্বীপ বরাবর ভারতের পক্ষেই ছিল কিন্ত সম্প্রতি মালদ্বীপে নির্বাচনে চীন ঘনিষ্ঠ মহম্মদ মুইজু জয়ী হওয়ার পর থেকেই মালদ্বীপ ও ভারতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লাক্ষাদ্বীপের ছবিতে বিতর্কিত মন্ত্যবের জেরে রীতিমতো বয়কট মালদ্বীপ চলছে ভারতে।
শ্রীলঙ্কাকে ঋনের ফাঁদে ফেলে চীন হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য নিজেদের অধীনে করে রেখেছে। কিছুবছর আগে নেপালেও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে ভারতবিরোধী করে তুলতে চেয়েছিল নেপালকে। এছাড়া পাকিস্তান এমনিতেই চীনের ঋনের ফাঁদে আটকে গেছে। চীনের লক্ষ্য ভারতকে ঘিরে ফেলা প্রতিবেশীদের মাধ্যমে, চীনের এই নীতিকে স্ট্রিং অফ পার্লস। যদিও বর্তমান ভারত সরকার চীনকে প্রতিরোধ করার জন্য নেকলেস অফ ডায়মন্ড নীতি নিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে একাধিক নীতি গ্রহন করেছে বিশেষ করে দক্ষিন এশিয়ায় চীন বিরোধী দেশগুলোর সাথেও কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে ভারত। তবে এসবের মধ্যেই ভারতের জন্য ভালো খবর হচ্ছে ভুটানে ভারত পন্থী নেতা শেরিং তোবগে জিতে গেছে। শেরিং তোবগের ভুটানে বিজয় কুটনৈতিক ভাবে ভারতের জন্য খুবই আবশ্যক ছিল।
ভারত ও চীনের মাঝে হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ছোট একটি দেশ ভুটান। ৩৮,৩৯৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ বিশিষ্ট দেশটি ভারতের জন্য স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। চীন বরাবরই ভুটানকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে এসেছে। ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের জন্য ভুটান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে শিলিগুড়িতে প্রায় ২০০ কিলোমিটার লম্বা ও ২০ থেকে ৬০ কিলোমিটার চওড়া একটি অঞ্চলের মাধ্যমেই উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সাথে একমাত্র সংযোগ রয়েছে ভারতের, একেই শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক বলে। চিকেন নেকের পাশে রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল এবং উত্তরদিকে রয়েছে ভুটান। চীন যদি ভুটানে নিজের প্রভাব বাড়াতে পারে তাহলে খুব সহজেই শিলিগুড়ি করিডরে নজর রাখতে পারবে চীন। এইকারনেই ২০১৭ সালে চীন ভুটানের ডোকলামে জোর করে প্রবেশ করেছিল কিন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর চাপে পীছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। সেজন্য স্ট্রাটেজিক ভাবে ভুটান বরাবরই ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ন। তাই ভুটানে ভারতপন্থী সরকার সবসময় প্রয়োজন, যা অতীতকাল থেকেই হয়ে আসছে এবং এবারেও হয়েছে। ভারতের সংসদে দুটি বিভাগ আছে লোকসভা ও রাজ্যসভা, ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে লোকসভা। ঠিক তেমনি ভুটানের সংসদেও দুটি বিভাগ আছে। ভুটানের সংসদের নিম্নকক্ষকে বলা হয় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি যাতে ৪৭ জন সদস্য নির্বাচিত হয়। ভুটানে নির্বাচন দুটি ধাপে হয়। প্রথম ধাপে যতজন প্রার্থী আছে তারা নির্বাচনে অংশ নেয়। যেমন ভুটানের সম্প্রতি নির্বাচনের প্রথম ধাপ গতবছর সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসেই শুরু হয়ে গিয়েছিল যাতে পাঁচটি দল অংশ নিয়েছিল। প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর যে দুই দল সবচেয়ে বেশী ভোট পায় তারা দ্বিতীয় ধাপে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে অংশ নেয়। গত ৯ জানুয়ারি ভুটানের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে শেরিং তোবগে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি বা পিডিপির হয়ে জয়লাভ করেন। তিনি ভুটান টেনড্রেল পার্টি বা টিডিপির পেমা চেওয়াংকে পরাজিত করেন।
ভুটানের ন্যাশানাল অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যা গরিষ্ঠতার জন্য ২৪টি আসন প্রয়োজন। ন্যাশানাল অ্যাসেম্বেলিতে নির্বাচনে ৪৭টির মধ্যে ৩০টি আসন পায় শেরিং তোবগের পিডিপি। শেরিং তোবগের সাথে ভারতের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তিনি অনেকবার ভারতে এসেছেন। ভুটানের মোট সরকারি ভোটার পাঁচ লাখ যার মধ্যে ৩.২ লাখ ভোট পেয়েছেন শেরিং তোবগে। এর আগে ভুটানের শাসনক্ষমতায় ছিল ড্রুক নামরুপ শোগপা দলের লোটে শেরিং। ২০২৩ পর্যন্ত এই লোটে শেরিংই ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ছিল। ২০২৩ সালে নভেম্বরে ভুটানের প্রাথমিক নির্বাচনের পরেই লোটে শেরিং পরাজিত হন। ভুটানের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগের বয়স ৫৮ বছর, তিনি এর আগে ভুটানের সরকারি কর্মচারি ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেছেন তিনি। ২০০৭ সালেই তিনি পিডিপি দল তৈরি করেন। শেরিং তোবগে এর আগেও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিনি প্রথমবারের জন্য ভুটানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভুটান একটি এমন দেশ যেখানে গনতন্ত্র এসেছে ২০০৮ সালে, এর আগে ভুটানে রাজতন্ত্র ছিল। যদিও এখনও ভুটানে রাজা রয়েছে, বর্তমানে ভুটানের রাজা জিগমে খেসর নামগিয়াল ওয়াংচুক। তবে ভুটানের রাজার কাছে সীমিত রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ যেমন পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমারে রীতিমতো সহিংস নির্বাচন হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই দেশ নিয়ন্ত্রিত করে, লোক দেখানো গনতন্ত্র রয়েছে সেখানে। বাংলাদেশের নির্বাচনও সরকার পক্ষ নিয়ন্ত্রনের অভিযোগ রয়েছে। মায়ানমারে সেনাশাসনই জারি হয়ে গেছে। সেই তুলনায় অনেক দেরীতে গনতন্ত্র শুরু হলেও ভুটানে নির্বাচন যথেষ্ট শান্তিপূর্ন হয়।
ভুটানের নির্বাচনে কোনও হিংসা হয়না, গত নভেম্বর ভুটানের ক্ষমতাসীন দল যখন নির্বাচনে হেরে যায় তখন কোনওরকম ঝামেলা ছাড়াই লোটে শেরিং প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। শেরিং তোবগে এবারের নির্বাচনের প্রচার করেছিলেন ভুটানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে। ভুটানের অর্থনীতির মূলভিত্তিই হচ্ছে পর্যটনশিল্প। করোনা মহামারীতে ভুটানের অর্থনীতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভুটানে বেকারত্ব ২৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে, ভুটানের মোট জনসংখ্যার আট ভাগের এক ভাগের কাছেই জীবনধারনের জরুরী উপাদানই নেই। বিগত পাঁচ বছরে ভুটানের জিডিপি মাত্র ১.৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারনে ভুটানের তরুন ভুটান ছেড়ে ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মতোন দেশে যাওয়া শুরু করেছে উন্নত জীবনযাপনের আসায়। এসব সমস্যার সমাধানই করারই প্রচার করে শেরিং তোবগে এবারের নির্বাচনে। শরিং তোবগে নির্বাচনী প্রচারে আরও জানিয়েছিলেন ভুটানের জিডিপি মাত্র তিন বিলিয়ন ডলার, তিনি ভুটানে আরও বিনিয়োগের ব্যবস্থা করবেন যাতে বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হয়। ভুটানের এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে ভারতের। অতীতকাল থেকে ভারতই ছিল ভুটানের সবচেয়ে বড় বন্ধু। ভুটানকে সবসময় ভারতই সাহায্য করে এসেছে। ভুটানের বহু প্রজেক্টে ভারত অর্থসাহায্য করে আসছে ভুটানকে যার মধ্যে নতুন রেলওয়ে প্রজেক্টও রয়েছে। ভুটানের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রধান সহযোগী ভারত, ভবিষ্যতে ভুটানের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ভারত বিদ্যুৎ কিনলে তাতে ভুটানের অর্থনীতিরই লাভ হবে। ভারতের বিদেশনীতিই সবসময় অনুসরন করে এসেছে ভুটান, যেমন ভারত চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআআই প্রজেক্টের বিরোধীতা করেছে যার ফলে ভুটানও বিআরআই প্রজেক্টের বিরোধীতা করেছে। চীন ভুটানের পাসাংলুং এলাকায় ভুটানের বেশ খানিকটা জমি অধিগ্রহন করে নিয়েছে, যদিও চীন তার সব প্রতিবেশীরই জায়গা অধিগ্রহন করার চেষ্টায় থাকে সবসময়। চীনের সাথে এই নিয়ে সীমান্ত সমস্যা রয়েছে ভুটানের। ভুটানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং অনেকটা চীন ঘনিষ্ঠ ছিল।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সীমান্ত সমস্যা মেটানোর জন্য লোটে শেরিং ভারতের সাথে কথা না বলেই চীনের সাথে চুক্তি করে ফেলেছিল। এই প্রথম ভারতের সাথে আলোচনা না করেই কোবও সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। যার পরে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারনা করেছিল ভুটনাও ধীরে ধীরে চীনের মেরুতে চলে যাচ্ছে কিন্তু এবার নির্বাচনে লোটে শেরিং নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লাভ হয়েছে ভারতের। শেরিং তোবগে নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত শেরিং তোবগে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও ভারতের সাথে খুব গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল ভারতের, এবার ভারত ও ভুটানের কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে বলেই ধারনা করা হচ্ছে।