তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক এত খারাপ কেন হচ্ছে জানেন?
রাজেশ রায়:— বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বড় জিও পলিটিক্যাল সমস্যা হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। যা নিয়ে গোটা বিশ্বে রাশিয়াকে এক ঘরে করে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে রাশিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হয়ত চীনও তাইওয়ান আক্রমন করতে পারে। সেজন্য আমেরিকা জানিয়েছে এরকম পরিস্থিতিতে তারা তাইওয়ানকে সাপোর্ট করবে। যার বিরোধীতা করে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকা চাইনিজ অ্যামবাসডর বলেছে যদি আমেরিকার নেভাল ফ্লীট তাইওয়ানের দিকে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে চীন ও আমেরিকার মধ্যে বড় যুদ্ধ হতে পারে। তাইওয়ানকে নিয়ে কেন এত মাথাব্যথা চীনের? তাইওয়ান ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক এত বিতর্কিত কেন??? এসব নিয়েই আজ বিস্তারিত আলোচনা করব।
একটি স্বাধীন দেশ হওয়া সত্বেও তাইওয়ানকে দেশ হিসাবে এখনও স্বীকৃতি দেয় নি জাতিসংঘ। তাইওয়ান এখনও জাতিসংঘের সদস্য নয়। চীন তাইওয়ানকে নিজেদের অবিশ্বেদ্য অংশ হিসাবে মনে করে। যাকে চীনের ওয়ান চীন পলিসি বা এক চীন নীতি বলে। বিশ্বের কোন কোম্পানিকে চীনে ব্যবসা করতে হলে চীনের এই এক চীন নীতি মানতে হবে। এই নীতি অনুযায়ী সেই সব কোম্পানি গুলোকে তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যদি তাইওয়ানের অবস্থান লক্ষ্য করা হয় তাহলে দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগরের মাঝে অবস্থিত তাইওয়ান স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারন পূর্ব চীন সাগরে জাপানের সাথে চীনের বিরোধীতা আছে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপিন্স, ব্রুনেই, সিঙ্গাপুরের সাথে বিরোধীতা আছে চীনের। সুতরাং তাইওয়ান দখল করতে পারলে তা চীনের জন্য সবচেয়ে সুবিধা হবে কারন চীনের সমুদ্রসীমা অনেক বেড়ে যাবে আন্তর্জাতিক স্তরে যাকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বলা হয়। কোন দেশের সমুদ্র তীর থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল বা ৩৭০ কিলোমিটার দূরত্বকে দেশটির এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বলা হয়। চীন তাইওায়ন দখল করলে ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান দ্বারা গঠিত ভারত মহাসাগরে কোয়াড সংগঠনের উপর বড় ধাক্কা আসবে। কোয়াডের অস্তিত্বের উপরই প্রশ্ন এসে যাবে। এবার এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার বলি আমেরিকা একদিকে জানিয়েছে তারা তাইওয়ানকে সাহায্য করবে কিন্ত এখনও পর্যন্ত তাইওয়ানে আমেরিকার কোন দূতাবাসই নেই। যার অর্থ আমেরিকা স্বাধীন দেশ হিসাবে তাইওয়ানকে স্বীকার করে না এখনও। তবে আমেরিকার এই ডবল স্ট্যান্ডাড মানসিকতার জন্য দোষ আমেরিকাকেও দেয়া যায় না কারন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ভাল, খারাপ দেখে হয় না। আমেরিকার অর্থনীতির জন্য চীনের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল আমেরিকার বড় বড় কোম্পানি গুলোর উৎপাদন কেন্দ্রই চীনে।
এদিকে চীন সেসব কোম্পানি গুলোকে দিয়ে এক চীন নীতি সাক্ষর করিয়ে রেখেছে। এবার তাহলে আপনাদের মনে হতেই পারে তাহলে আমেরিকা কী তাইওয়ান কে মিথ্যা ভরসা দিচ্ছে?? এর উত্তর হবে না। আলফ্রেড মাহানের একটি বই দি ইনফ্লুয়েন্স অফ সী পাওয়ার ইন হিস্ট্রি, এতে তিনি বলেছেন বিশ্বের কোন দেশ বানিজ্য ছাড়া থাকতে পারবে না এবং কোন দেশ নিজে তার সমস্ত দরকারী জিনিস তৈরি করতে পারবে না সুতরাং প্রত্যেক দেশকেই বানিজ্য করতেই হবে। আর বানিজ্যের জন্য সবচেয়ে ভাল পথ হচ্ছে সমুদ্র। সুতরাং আলফ্রেড মাহান বলেছেন যে সমুদ্রে রাজত্ব করবে সে গোটা বিশ্বে রাজত্ব করবে। এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছে আমেরিকা। যদি আমেরিকার সেনাবাহিনী ও নেভির মধ্যে তুলনা করা হয় দেখবেন আমেরিকার নেভি অনেকবেশী শক্তিশালী। এর আগে চীন একবার তাদের কিছু যুদ্ধজাহাজ তাইওয়ানের সমুদ্র সীমায় পাঠিয়ছিল সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকাও তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠায়, তারপর চাইনিজ যুদ্ধজাহাজ গুলো ফিরে যায় সুতরাং এর আগেও আমেরিকা তাইওয়ানকে সাহায্য করেছে। বলিউডে একটা সিনেমা আছে ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই যেখানে অজয় দেবঘন বলছে সমুদ্রই যথেষ্ট তার জন্য অর্থাৎ যে সমুদ্র দখল করবে গোটা বিশ্ব তার। কিছুমাস আগে তাইওয়ানের বিদেশ মন্ত্রক একটি টুইট করে ভারতকে তাইওয়ানের জাতীয় দিবস উদযাপনের জন্য ধন্যবাদ জানায়। আসলে ডোকলাম, গালওয়ান ভ্যালিমসহ অরুনাচল প্রদেশে চীনের সাথে ভারতের ঝামেলার পর ভারতও এর মাধ্যমে চীনকে একটি মেসেজ দিয়ে রাখল।
এবার চীন ও তাইওয়ানের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গঠন কাঠামো একটু দেখা যাক। দেখুন তাইওয়ানের আসল নাম রিপাবলিক চফ চায়না এবং চীনের নাম হচ্ছে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না। আসলে চীন তো মনে করেই তাইওয়ান তাদেরই অংশ কিন্তু তাইওয়ান নিজেও মনে করে একদিন চীন তাদের অংশ এটা হাস্যকর হলেও কিন্তু সত্যি। এবার দুটি দেশের রাজনৈতিক কাঠামো যদি দেখা হয় দেখবেন তাইওয়ান একটি গনতান্ত্রিক দেশ যাতে বিভিন্ন দল থাকে ভারতের মতই এবং নির্বাচন করে সরকার গঠন হয়। অন্যদিকে চীন হচ্ছে পুরো কমিউনিস্ট দেশ কিন্ত অবাক হবেন চীনেও কিছু রাজনৈতিক দল আছে কিন্তু চীনের সরকারে কমিউনিস্ট দলই রয়েছে এবং থাকবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিচার ধারার দিক দিয়ে চীন ও তাইওয়ান সম্পূর্ণ বীপরীত ধারার। এবার চীনের দুজন ব্যাক্তির নাম বলি চ্যাং কাই সেক ও মাও জে দং। চ্যাং কাই সেক গনতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল যার জন্য তাকে আমেরিকা সমর্থন করত এবং মাও জে দং কমিউনিস্ট চিন্তাধারার লোক ছিল তাকে সাপোর্ট করত জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুজনেরই লক্ষ্য ছিল চীনকে ঐক্যবদ্ধ করা কিন্তু ততদিনে চীনে একটু ভাঙন ধরেছিল। এর কারন জানতে আপনাদের ২০০ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। প্রায় ১৬৪৪ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত চীনে রাজত্ব করেছিল কুইং রাজবংশ। এসময় তাইওয়ান চীনের অংশ ছিল কিন্তু যখন কোন একটা বড় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সেই সাম্রাজ্যে ভাঙন শুরু হয়। ভারতেও মুঘল, গুপ্ত আমলে এমন হয়েছিল।
১৮৯০ এর দশকে জাপান তাইওয়ান আক্রমন করে শুরু হয় প্রথম সিনো জাপান যুদ্ধ। ১৮৯৫ সালে সিমোনোসেকী চুক্তি অনুযায়ী জাপান তাইওয়ান দখল করে নেয়। ১৯১০ সালে জাপান কোরিয়া দখল করে নেয়। দেখুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখনও পর্যন্ত যে জাপানকে আমরা চিনি তারা শান্ত, ভদ্র ও টেকনোলজি বেসড জাপান কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপান কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ছিল। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত ব্যক্তি চানক্যের নাম নিশ্চয় শুনেছেন, তখন গোটা ভারত জুড়ে অস্থির অবস্থা ছিল কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল না যার জন্য চানক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কে ভারতের সিংহাসননে বসেন এবং ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠম করেন। ঠিক তেমনি ঐক্যবদ্ধ চীন গঠনের স্বপ্ন দেখেন সুন ইয়াত সেন, ইনি মাও জে দং এবং চ্যান কাই সেকের ও আগের ব্যক্তি। সুন ইয়াত সেন কুমেনতাং দল গঠন করেন। কিন্তু ১৯২৫ সালে মৃত্যু হয়ে যায় সুন ইয়াত সেনের। এরপর তার দল কুমেনতাং দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি। ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রধান চ্যাং কাই সেক ও কমিউনিস্ট দলের প্রধান মাও জে দং উভয়ের লক্ষ্যই ছিল চীনকে ঐক্যবদ্ধ করা। চ্যাং কাই সেক উদার গনতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু মাও জে দং এর বক্তব্য ছিল উদার গনতন্ত্রে এক শ্রেনীর প্রচুর অর্থ কিন্তু এক শ্রেনী ক্রমশ গরীব হয়ে পড়ে সুতরাং এখানে শোষন হয়, সে জন্য মাও জেদং লক্ষ্য ছিল এমন এক সিস্টেম যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। কমিউনিজমের জনক বলতে আমরা বুঝি কার্ল মার্ক্স কে যার জন্ম জার্মানিতে। কিন্তু মাও জেদং কমিউনিস্ট হয়েও কার্ল মার্ক্সের মতবাদ মানত না। কার্ল মার্ক্স বলে গিয়েছিল এমন একটি সমাজ যেখানে মানুষের হাতে সব ক্ষমতা থাকবে। মাও জেদং বিশ্বাস করত সবার হতে ক্ষমতা দিয়ে দিলে সবাই নিজের নিজের সম্পত্তি বাড়াতে থাকবে সেজন্য সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে একটি কেন্দ্রীয় সরকার যা সুষম বন্টন করবে। সেই সময় চীন পুরো দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। চীনের উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভাগে মাও জেদং ও তার রেড আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং দক্ষিণ পশ্চিম চীন চ্যাং কাই সেকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই সময় আমেরিকা রীতিমতো অর্থ সাহায্য করত চ্যাং কাই সেককে কারন আমেরিকার প্রধান শত্রু কমিউনিজম। উভয় দলই চীনকে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে জাপানের সাথে বেশী যুদ্ধ করে। রেড আর্মি ন্যাশনালিস্টদের থেকে বেশী যুদ্ধ করে। এই সময় ন্যাশানালিস্টদের লক্ষ্য হয় কমিউনিজম কে ধ্বংস করা যার জন্য সেসময় ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
১৯২৭ সালে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময় চ্যাং কাই সেক একটি ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয় চীনের সাংহাই শহরে একে একে কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যা করে তার দল, ইতিহাসে একে সাংহাই ম্যাসাকার বলা হয়। চীনের গৃহযুদ্ধের সুযোগো জাপান চীনের মান্চুরিয়া অংশ দখল করে নেয়। গৃহযুদ্ধের প্রথম দিকে চ্যাং কাই সেকের দল রীতিমতো পীছু হটিয়ে দিয়েছিল কমিউনিস্ট দলকে। ১৯৪৩ সালে চ্যাং কাই সেক তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সাথে বৈঠক করেন কমিউনিস্টদের পুরো উৎখাত করতে। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমানবিক বোম্ব ফেলে যাতে হতবাক হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। কারন সেমসয় সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা একই পক্ষে যুদ্ধ করছিল এবং জাপানকে আটকানোর দায়িত্ব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর। কিন্তু আমেরিকা সোভিয়েত কে না জানিয়েই জাপানে আক্রমণ করে যার জন্য জোসেফ স্টালিন ক্ষুব্ধ হয় আমেরিকার উপর এবং স্টালিন সরাসরি সাহায্য করে মাও জেদং কে। ব্যাস শুধু এটারই দরকার ছিল। এতদিন পর্যন্ত কোনঠাসা হয়ে থাকা কমিউনিস্ট দল ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ এর মধ্যে চীনে ন্যাশানাল পার্টির লোকেদের হত্যা করতে শুরু করে সাংহাই ম্যাসাকারের বদলা নিতে। চ্যাং কাই সেক ও তার কিছু লোক ভয়ে ফরমোসা দ্বীপে পালিয়ে আসে যাকে আজ তাইওয়ান বলা হয়। আগেই বলেছি তাইওয়ান জাপানের দখলে ছিল কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপান হেরে যাবার পর তাইওয়ানের অধিকার ছাড়তে হয় তাদের। ১৯৪৯ সালে চীন সরকারি ভাবে নিজেকে কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৪৯-৫০ এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ ন্যাশনাল পার্টির লোক তাইওয়ানে পালিয়ে আসে।
চ্যাং কাই সেক ঘোষনা করে তাইওয়ানের লোকেরাই আসল চাইনিজ সেজন্য তিনি তাইওয়ানের নাম দেন রিপাবলিক অফ চায়না এবং তৎকালীন জাতিসংঘ একে স্বীকৃতিও দেয় কারন জাতিসংঘে পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্য ছিল এবং তারা চ্যাং কাই সেককে সমর্থন করত। কমিউনিস্ট দল তাদের অংশের নাম দেয় পিপিলস রিপাবলিক অফ চায়না। এবার তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বন্ধু দেশ গুলোর সহায়তায় পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না কে আসল চীন হিসাবে স্বীকৃতি দেয় যার মধ্যে ভারত ও ছিল। সেই সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর টেকনোলজি ও প্রতিরক্ষা খাতের জন্য নির্ভরশীল ছিল সুতরাং বন্ধুর বন্ধু আমার বন্ধু এই নীতি অনুযায়ী জহরলাল নেহেরু পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না কে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়,বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন হয়। এই সময় জাতি সংঘ তাইওয়ানের কাছ থেকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি কেড়ে নিয়ে তা পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না কে দিয়ে দেয় কারন ততদিনে চীন শক্তিশালী দেশ হিসাবে তৈরি হয়ে গেছে। আমেরিকার এই সময় প্রধান শত্রু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই সোভিয়েত ইউনিয়নই চীনকে সাপোর্ট করত। আমেরিকা দেখল যদি চীনকে সাপোর্ট করে নিজেদের দিকে আনা যায় তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধাক্কা দেওয়া যাবে। এছাড়াও সেসময় চীনের কট্টরপন্থী কমিউনিস্ট লিডার মাও জেদং বুড়ো হয়ে গেছিল, পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবার কথা ড্যাং জিওপিং এর। যার ধারনা ছিল আগে অর্থনীতি শক্তিশালী হোক তারপর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যার জন্য আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বন্ধুত্ব শুরু হয়। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই সময় চীন সফর করেন যা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এটাই নিয়ম, কেউ স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হয় না। পরিস্থিতি ও জাতীয় স্বার্থের উপর নির্ভর করে সম্পর্ক পরিবর্তন হয়।
এবার একটা ঘটনা ঘটে যে যে ফরমোসা দ্বীপ বা তাইওয়ান কমিউনিস্ট শাসনকে বিরোধীতা করে গনতন্ত্র স্থাপন করেছিল তা আসতে আসতে নষ্ট হতে শুরু করে। কারন ১৯৭৯ সালে চ্যাং কাই সেকের মৃত্যুর পর তার ছেলে তাইওয়ানের নেতৃত্ব শুরু করে এবং তাইওয়ানে একটি দল নীতি চালু করে। সেই সময় তাইওয়ান জুড়ে মার্শাল আইন চালু হয় যাতে সরকার সমস্ত মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। কারন সেসময় তাইওয়ানের ২৭ শতাংশ মানুষ চাইছিল চীনের সাথে যুক্ত হতে কারন তারা গনতন্ত্র চেয়েছিল, একটি দল নীতি সেই কমিউনিস্টেদের মতই হয়ে গেল তাই তার থেকে ভাল চীনের সাথে যুক্ত হওয়া। তারা তাইওয়ানে ফরমোসা ম্যাগাজিন শুরু করে যাতে তাইওয়ানে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথা প্রচার হচ্ছিল। ফলে তাইওয়ানে আরও একটি দল গঠন হয় যার নাম হয় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি।
২০০৫ সালের এপ্রিলে তাইওয়ানের ন্যাশনালিস্ট পার্টির লিডার লিয়েন চ্যান চীন সফরে গিয়ে কমিউনিস্ট দলের সাথে বৈঠক করেন। ১৯৪৯ সালে রিপাবলিক অফ চীন বা তাইওয়ান তৈরি হবার পর এটাই ছিল এই দুই দলের প্রথম বৈঠক। তখন সবার মনে হয়েছিল বোধহয় এবার বোধহয় চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্ক ভাল হবে। কিন্তু ২০০৭ সালের মার্চ মাসে তাইওয়ান একটি ক্রুজ মিসাইল টেস্ট করে যা চীনের হংকং ও সাংহাই শহরে অ্যাটাক করবার ক্ষমতা রাখে। যা নিয়ে আবারও চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। আচ্ছা এতক্ষন পর্যন্ত যে তাইওয়ান বলছি বারবার, আসলে তাইওয়ান নাম আসে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে যখন রিপাবলিক অফ চায়না ঠিক করে তারা পুনরায় জাতিসংঘে যুক্ত হবে সেজন্য রিপাবলিক অফ চায়না পাল্টে রাখা হয় তাইওয়ান। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ তাদের সদস্য থেকে বের করে দেয় সেজন্য নতুন নাম নিয়ে ২০০৭ সালে তারা আবার আবেদন করে কিন্তু এবারেও জাতিসংঘ মানা করে দেয় কারন চীন জাতিসংঘের পাঁচ জন স্থায়ী সদস্যের একজন। তবে ২০১০ সালের জুন মাসে চীনের সাথে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট করে তাইওয়ান তারপর চীনের সাথে সম্পর্ক একটু ভাল হয়। তবে আবার ২০১৪ সালে তাইওয়ান তাদের সিনিয়র অফিসিয়াল দের চীনে যেতে নিষেধ করে। এবার একটা প্রশ্ন মনে হতেই পারে তাইওয়ানের মত এই ছোট দেশ নিয়ে আমেরিকার আবার এত মাথা ব্যাথা কেন হল?? দেখুন আকারে ছোট হলেও তাইওয়ানের অর্থনীতি ও টেকনোলজি যথেষ্ট ভাল। বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর চীপ সেট সবচেয়ে বেশী তাইওয়ানই তৈরি করে। ফক্সকন, মিডিয়াটেকের মতন কোম্পানি গুলো তাইওয়ানেরই। এই ফক্সকনই অ্যাপেলের সমস্ত ম্যানুফাকচারিং করে। করোনা মহামারীর জন্য বিশ্বে যখন সেমিকন্ডাক্টর চীপ সেট উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল তখন তাইওয়ানই বেশীরভাগ চীপ সাপ্লাই দিয়েছিল। সুতরাং আমেরিকা খুব ভাল করেই জানে তাইওয়ানের গুরুত্ব কতটা। তবে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে বিতর্ক সবসময় লেগেই আছে। প্রায়ই এটা শোনা যায় চীনের যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আাকশে ঢুকেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর সবাই ভেবেছিল চীনও হয়ত তাইওয়ানে আক্রমণ করবে কিন্তু চাইনিজ প্রেসিডেন্ট শী জিনপিং জানায় ইউক্রেনের সাথে তাইওয়ানের পার্থক্য আছে। ইউক্রেন একটা আলাদা দেশ কিন্তু তাইওয়ান চীনের নিজস্ব অংশ। ২০১৮ থেকে এর জন্যই চীন সমস্ত বিদেশী কোম্পানিকে এক চীন নীতিতে সাক্ষর করায়। তবে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তাইওয়ান কে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও চীনের যুদ্ধ হতেও পারে কারন এই এলাকা রীতিমতো জিও পলিটিক্যাল হটস্পট।