ভারত

৮০ বার দুর্ঘটনা হলেও এখনও কেন মিগ-২১ যুদ্ধবিমান সার্ভিসে?

নিজস্ব সংবাদদাতা: ভারতের মিগ-২১ নিয়ে সম্প্রতি উঠতে শুরু করেছে নানা প্রশ্ন। গত কয়েক বছরে বারবার দুর্ঘনার শিকার হচ্ছে এই যুদ্ধবিমান। প্রাণ হারিয়েছেন তরতাজা বেশ কিছু মেধাবী পাইলট। অনেকে আবার হয়েছেন গুরুতর আহত। পরিস্থিতি এমনই যে এই বছরেই বিভিন্ন সময় ভেঙ্গে পড়েছে তিনটি মিগ-২১। বিগত দুই দশকের হিসাব খতিয়ে দেখলে পরিষ্কার ৪০ বছরের বেশি পুরোনো ফ্লাইং কফিন খ্যাত এই রাশিয়ান যুদ্ধবিমান মিগ -২১অর্থাৎ ভারত যাকে আপগ্রেড করে  মিগ-২১ বাইসন নামকরন করেছে সেই বিমানগুলিই বাকি বিমানের তুলনায় সবচেয়ে বেশিবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। প্রায় ৮০টি বিমান! ভাবতে পারছেন?

সূত্রের খবর সাম্প্রতিককালে আরেকটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান আকাশে উড্ডয়নরত অবস্থায় ধ্বংস হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমানটি ওইদিন রাতে পাঞ্জাবের লেঙ্গিয়ানার কাছাকাছি মোগা নামক একটি গ্রামে অন্যান্য দিনের মতোই ফ্লাইট অপারেশন এর অংশ হিসাবে পার্ট নিলে উড়ন্ত অবস্থায় ভেঙে পড়ে। ৪০ বছরেরও বেশি পুরনো এই যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়লে প্রাণ হারান পাইলট। দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা না গেলেও অনুমান করা হচ্ছে মাঝ আকাশে হয় বিমানের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়ে অথবা কারিগরিজনিত কোন ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে এটি। এমনকি সেনা সূত্রে জানা গেছে সামরিক এবং অসামরিক নানা এয়ার মিশনে ২০২০ সালের জানুয়ারির শুরু করে এই বছরের মে মাস পর্যন্ত এতদিনে কমপক্ষে ১৫টি যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য এরিয়াল সিস্টেম হয় ধ্বংস হয়েছে নইতো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালের ২৬-২৭ই ফেব্রুয়ারীতে যখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা পৌঁছায় সেই সময়ও সামরিক সংঘর্ষের সময় বেশ কিছু যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় হারিয়েছিলো ভারতীয় বাহিনী।  

চিন্তা বাড়িয়েছে অপর এক পরিসংখ্যানও। ওই পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস অব্দি এই কয়েক বছরে ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং নৌ-বাহিনী একত্রে আনুমানিক প্রায় ৩২৫টি যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান,হেলিকপ্টার সহ অসংখ্য যুদ্ধবিমান ট্রেইনার এবং এরিয়াল সিস্টেম হারিয়েছে আকাশে উড্ডয়নকালে। একই গল্প এক্ষেত্রেও। কিছু বিমান যেমন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে কিছু আবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিনা মেরামতিতে অবসরে পড়ে রয়েছে।  

একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এতগুলো দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে কিন্তু মিগ-২১। প্রায় আশি বার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে ভারতের আপগ্রেড করা মিগ-২১। এরপরে তালিকায় রয়েছে পঁচিশবার দুর্ঘটনার কবলে পড়া মিগ-২৭। এছাড়াও, বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫টি জাগুয়ার, ১৩টি মিগ-২৩, ৭টি সী হ্যারিয়ার, ১৩টি মিরেজ-২০০০ এবং ১৩ টি মিগ-২৯। সম্প্রতি ১১ বার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এই তালিকায় নাম লিখিয়েছে ধ্রুব, ২৪টি রাশিয়ান মিল-৮ বা ১৭ এবং ৪টি এমআই-৩৫এস কম্ব্যাট হেলিকপ্টার সহ কিছু রাশিয়ান সামরিক পরিবহন এবং সামরিক হেলিকপ্টার। এছাড়াও এই লিস্টে রয়েছে নৌবাহিনী বেশকিছু সমুদ্র নজরদারি বিমান। এখনো পর্যন্ত রাশিয়া থেকে আমদানি করা ভারতের সবচেয়ে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান সুখোই এসইউ-৩০ এমকেআই অসামরিক মিশনে ধ্বংস হয়েছে মোট আটবার। এবার ঘটনা হচ্ছে ২০০৯ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত ভারতীয় নৌ এবং বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত যতগুলি বিমান,হেলিকপ্টার, এরিয়ার সিস্টেম উড্ডয়নরত অবস্থায় ধ্বংস হয়েছে তার তালিকা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল রাশিয়া থেকে আমদানি করা। এমনকি অবাক করার মত বিষয় হলো রাশিয়া থেকে আমদানি করা বিমানের দ্রুত অবসর নেওয়ার হারও বেশি। প্রায় ৬৫ শতাংশ।

হৃদয়বিদারক ঘটনা হল এতগুলি বিমান দুর্ঘটনায় ভারত একদিকে যেমন এখনো পর্যন্ত অত্যন্ত মেধাবী উচ্চশিক্ষিত প্রায় চার শতাধিক যোগ্য পাইলটকে হারিয়েছে তেমনি পাশাপাশি আরো কমপক্ষে শতাধিক সেনা ও বৈমানিক অফিসার মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। কেউ চিরস্থায়ী ভাবে বিকলাঙ্গ হয়েছেন আবার কেউ চিরতরে বয়েসের আগেই অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন।  ঘনঘন এত দুর্ঘটনা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আকাশ সুরক্ষা ব্যবস্থাকে এক বড়োসড়ো প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে ।সেই সঙ্গে পরিরক্ষা ক্ষেত্রেও এটি এক বড় ধরনের দুর্বলতা সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতিতে আকাশ প্রতিরক্ষায় বিপর্যয় ঠেকাতে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে ভারতের শেষ ভরসা ফ্রন্সের ড্যাসাল্ট এভিয়েশন কর্পোরেশনের তৈরি রাফায়েল সুপার এডভান্স যুদ্ধ বিমান। অথচ ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান কেনার কথা থাকলেও অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে ভারতের বহু প্রতীক্ষিত এই বিমান ক্রয়ের প্রজেক্টটি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায়।

সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী শিবির থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলেও এই বছরের 15 মে অব্দি ভারতের মাটিতে এসে পৌঁছেছিলো চব্বিশটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রাফায়েল মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। পরে বাকি 12 টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান এসে পৌঁছায় জুন মাসে। ফ্রান্স ছাড়াও ভারতীয় বিমান বাহিনীকে অত্যাধুনিক রণতরীতে সাজিয়ে তুলতে ভারত সরকার বিগত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইসরায়েল, সহ দেশ কিছু দেশের সাথে প্রায় ২৫.০০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন চুক্তি সম্পন্ন করেছে। আশা করা হচ্ছে এর সুফল খুব শীঘ্রই পাবে ভারত। সব কিছু ঠিক মতো চললে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, হেলিকপক্টার, ড্রোন প্রভৃতি খুব শীঘ্রই হাতে পেতে চলেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী। ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কর্পোরেশন আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে বেশকিছু অত্যাধুনিক চিনুক সামরিক পরিবহণ এবং ২২টি এমএইচ-৬৪ যুদ্ধবিমান। 

তবে এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য, এতো কিছুর পরেও সেই সত্তরের দশক থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে সক্রিয় থাকা পুরনো মিগ-২১ ও মিগ-২৭, জাগুয়ার এবং মিরেজের মতো মোট ৭০০ এর কাছাকাছি যুদ্ধবিমান  ২০২০-২২ সালের মধ্যে অবসরে চলে যাবে বলে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে যে মারাত্বক স্কোয়াডন ঘাটতির সম্মুখীন হতে হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। আর ঠিক এই কারণেই ফ্রান্স থেকে আমদানি করা চতুর্থ প্রজন্মের রাফায়েল এতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীর ঘাটতি কমানোর জন্য প্রয়োজন ২.০ প্রকল্পের আওতায় ২০২৫-৩০ সালের মধ্যে অন্তত ১১৪টি এডভান্স যুদ্ধবিমান এবং ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ১০০টি হালকা সামরিক যুদ্ধবিমান তেজাস বিমান বাহিনীতে সংযুক্ত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে বিমান বাহিনীর এয়ার স্কোয়াডন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার এটাই একমাত্র পথ।

অপরদিকে, ভারতের নৌ বাহিনীর ক্যারিয়ার বেসড ৫৭টি এডভান্স যুদ্ধিবিমান প্রজেক্টের আওতায় ফ্রান্সের রাফায়েল ক্যারিয়ার ভার্সন রাফাল-এম সিরিজের যুদ্ধ বিমান সার্ভিসে আনার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করছে ভারতের সরকার। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হালফিলের তেজাস এর প্রোডাকশন পুরো দমে চালু হওয়ার পরেও হিন্দুস্থান অ্যারোনটিকস লিমিটেড  ভারতীয় বিমান বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট সংখ্যায় বিমান সরবরাহ করতে অক্ষম। এক্ষেত্রে বিশেষ খেয়াল রাখার প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.