রাশিয়া

ইউক্রেন ও তাইওয়ানের অবস্থান এক! কেন একথা বলা হচ্ছে?

রাজেশ রায়:– রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এর জন্য। অনেক ছোট দেশ তাদের বড় প্রতিবেশী দেশ গুলো দ্বারা আক্রমনের ভয়ে আছে। বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলেই এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে তবে এশিয়াতে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশী রয়েছে। এশিয়াতে চারটি পরমানু শক্তিশালী দেশ রয়েছে, যাদের নিজেদের মধ্যেই ঝামেলা রয়েছে। ভারত, চীন, পাকিস্তান এসব দেশের নিজেদের মধ্যেই সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা রয়েছে এবং পাকিস্তান তো নিজেদের তৈরি জঙ্গি সংগঠন নিয়েই চিন্তিত। এছাড়া এশিয়া তে আরও একটি দেশ আছে যারা সবচেয়ে বেশী চিন্তিত তা হচ্ছে তাইওয়ান। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশ গুলোর সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে অংশ না নেওয়া আরও বেশী ভাবাচ্ছে তাইওয়ান কে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তবু রাশিয়ান সেনাকে আটকেছে, তাইওয়ানের সে ক্ষমতাও নেই। চীনের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত তাইওয়ানেরও চীনকে নিয়ে ততটাই চিন্তিত যতটা ইউক্রেন রাশিয়াকে নিয়ে ভাবত। তবে আমেরিকা তাইওয়ানের জন্য অনেক কীছু করছে তবে বর্তমানে জিওপলিটিক্যাল পরিবর্তন বিশেষ করে আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার ফলে এশিয়াতে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ইউক্রেন ও প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত তাইওয়ানের অবস্থান একই হয়ে গেছে? রাশিয়া- ইউক্রেন এবং চীন তাইওয়ান সমস্যায় আমেরিকার ভূমিকা কি?

প্রথমে ইউক্রেন রাশিয়া সম্পর্কে এবং তারপর চীন তাইওয়ান সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। ১৯৯১ সালের আগে ইউক্রেন সর্বদাই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ ছিল, যার জন্য প্রায় হাজার বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অত্যন্ত মজবুত ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ গুলো নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করতে থাকে। ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট ইউক্রেন নিজেকে স্বাধীন দেশ হিসাবে দাবি করে এবং সেই বছরই ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার ফলে ইউক্রেনের এই দাবিতে সীলমোহর পড়ে যায়। এরপর আগামী তিন দশক অর্থনীতি বৃদ্ধি ও দুর্নীতি রোধই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায় ইউক্রেন সরকারের কাছে। তাছাড়া সীমান্তে রাশিয়ার মত দেশ থাকায় একটা অস্বস্তি সবসময় থেকেই যায় ইউক্রেনের কাছে। স্বাধীন দেশ হওয়া সত্বেও রাশিয়ান একটা প্রভাব ইউক্রেনের উপর সবসময়ই ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঝামেলা সবচেয়ে বেশী সৃষ্টি হয় ২০১৩ সালে যখন ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কিছু বানিজ্যিক ও রাজনৈতিক চুক্তি করে। যার জন্য ২০১৪ সালে ইউক্রেনের বন্দর শহর ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। তারপর রাশিয়ার উপর অনেক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক স্তরে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। বরং বর্তমানে গোটা ইউক্রেনেই আক্রমন করেছে রাশিয়া। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করেছে প্রধানত ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতো যোগ না দেয় সেজন্য।

১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো গঠন করা হয় যা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়ান জোট ছিল। বর্তমানে ৩০ টি দেশ ন্যাটোর সদস্য যার মধ্যে ২৮ টি ইউরোপীয়ান দেশ ও ২ টি উত্তর আমেরিকান দেশ। ন্যাটো তার সদস্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়িয়েই যাচ্ছে। ইউক্রেন চাইছিল ন্যাটোর সদস্য হতে, কারন ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী কোন একটি ন্যাটো দেশের উপর আক্রমন হলে সব দেশ একসাথে লড়াই করবে। এখানেই রাশিয়ার সমস্যা ছিল। কারন রাশিয়া কখনওই চাই ছিলনা ন্যাটো তার সীমান্তে আসুক। যদি ইউক্রেনের দিক দিয়ে বিচার করা যায় তাহলে রাশিয়ার মতন বিশাল দেশের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে গেলে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে ঢুকতেই হত। রাশিয়া ইউক্রেনের মতই তাইওয়ানের সাথেও চীনের ঝামেলা ইতিহাসের পাতা থেকেই শুরু। পূর্ব চীন সাগরে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপের তাইওয়ানের পূর্ব নাম ছিল ফরমোসা দ্বীপ। ২৩৯ এডি তে ঐতিহাসিক দলিলে এই জায়গার উল্লেখ আছে।  তবে ডাচ, স্পেন, ব্রিটেন সহ বিভিন্ন সময়ে অনেক শক্তিই তাইওয়ান দখল করেছিল। ১৮৯৪-৯৫ সালে প্রথম সিনো জাপান যুদ্ধের সময় জাপান তাইওয়ান দখল করে নেয় চীনের কুইং রাজবংশ কে পরাস্ত করে। চীনে গৃহযুদ্ধের সময় একদিকে মাও জেদং এর কমিউনিস্ট সরকার এবং অন্যদিকে চ্যাং কাই সেকের রিপাবলিক অফ চায়না দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, শেষপর্যন্ত ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট সরকার চীনের ক্ষমতা দখল করে। তখন প্রায় ২ মিলিয়নের বেশী মানুষ ফরমোসা দ্বীপে চলে আসে। ১৯৮০ সালে চীন সরকার তাইওয়ানের জন্য এক দেশ দুই নীতি চালু করার অফার দিয়েছিল কিন্তু তাইওয়ান প্রত্যাখ্যান করে। গত ৭০ বছর ধরে এইম সমস্যা এখনও মেটে নি। 

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষন করছে চীন। তবে চীন বারবার দাবি করেছে ইউক্রেন ও তাইওয়ান এক নয়। আমেরিকায় থাকা চাইনিজ রাষ্ট্রদূত কুই গ্যাং ওয়াশিংটন পোস্টে জানান তাইওয়ান ও ইউক্রেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। ইউক্রেন একটি স্বাধীন দেশ যেখানে তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইউক্রেন ও তাইওয়ানের মাঝের দূরত্ব ৫০০০ মাইল কিন্তু এখন বিশেষজ্ঞরা বলছে আজ যা ইউক্রেনের পরিস্থিতি, কাল তাই তাইওয়ানের হবে। এবার তাইওয়ান ও ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে কেনো একই বলা হচ্ছে তা জানা যাক। চীন ও রাশিয়া উভয়ই ঐতিহাসিক কারন দেখিয়ে তাইওয়ান ও ইউক্রেনকে নিজেদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। বর্তমানে কনভেনশনাল যুদ্ধ হোক না পারমানবিক যুদ্ধ, চীন ও রাশিয়া খুব সহজেই তাইওয়ান ও ইউক্রেনকে হারাতে সক্ষম। একটি তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ার মোট সেনার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তেরো লাখ, যেখানে ইউক্রেনের পাচ লাখ, রাশিয়ার মোট যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ১৫০০ কিন্তু ইউক্রেনের ৯৮ টি মাত্র। রাশিয়া তাদের জিডিপির ১১ শতাংশ বা ৬১ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর সামরিক খাতে ব্যায় করে, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এটি ৬ বিলিয়ন ডলার। চীন ও তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য আরও চিন্তা জনক। চীনের মোট সেনা সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ যেখানে তাইওয়ানের দেড় লাখ।

চীনের ১,২০,০০০ স্ট্রাটেজিক মিলিটারি ফোর্স রয়েছে কিন্তু তাইওয়ানের কাছে এমন কিছু নেই। চীনের টোটাল মিলিটারি বাজেট ১৫৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে তাইওয়ানের ১০ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং এই তথ্য দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাইওয়ান ও ইউক্রেন এমন দেশের বিরুদ্ধে রয়েছে যারা সব ফিল্ডে অনেক এগিয়ে। গত ফেব্রুয়ারী মাসে চীন সফরে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন তাইওয়ানের স্বাধীনতা নিয়ে বলা রাশিয়ার সমস্ত কথা ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে যার অর্থ রাশিয়া চীনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছে। সম্প্রতি রাশিয়া চীনের বন্ধুত্ব অনেকটাই বেড়েছে। তবে তাইওয়ান ও ইউক্রেনের অবস্থার মধ্যে পার্থক্যও আছে। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দীর্ঘ ল্যান্ড বর্ডার আছে। ট্যাঙ্ক ও সেনার সাহায্যে ল্যান্ড বর্ডার সহজেই অতিক্রম করা যায়। তাছাড়া ইউক্রেন সবে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশ গুলো থেকে অস্ত্র পওায় শুরু করেছে। অন্যদিকে তাইওয়ান ও চীনের মাঝে কোন ল্যান্ড বর্ডার নেই। তাইওয়ান চীন থেকে তাইওয়ান প্রনালী দ্বারা আলাদা। বিগত চার দশক ধরে তাইওয়ান চীনের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তত করছে, বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আমেরিকা থেকে তাইওয়ান কিনেছে। তাইওয়ানের বিমানবাহিনী অনেক বেশী শক্তিশালী।

এবার বলা যাক আমেরিকার ভূমিকা সম্পর্কে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় চার দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল আমেরিকা। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার উত্থানের ফলে কিছুটা হলেও আজ বিশ্ব একটু বিভক্ত হয়ে গেছে। তবুও এখনও পর্যন্ত টেকনোলজি ও মিলিটারি জায়েন্ট হিসাবে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে। তাইওয়ান আমেরিকার অষ্টম বৃহত্তম বানিজ্যিক পার্টনার, আমেরিকাতে তাইওয়ান অন্তত ১৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর তৈরির ক্ষেত্রে গ্লোবাল পাওয়ার হাউস। ১৯৭৯ সালের পর থেকে আমেরিকা তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসাবে কোনওদিন স্বীকার করেনি কিন্তু আমেরিকার মত সাহায্য তাইওয়ানকে কেউ করে নি। আমেরিকা তাদের প্রচুর অ্যাডভান্সড অস্ত্র তাইওয়ান কে বিক্রি করেছে। আমেরিকার নেভির যুদ্ধ জাহাজ তাইওয়ানকে রক্ষা করতে সচেষ্ট রয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে আমেরিকা একটু অন্য ভূমিকা নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে আমেরিকা ইউক্রেনকে ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু এটা ভূল। আমেরিকা যথেষ্ট অস্ত্র সাহায্য করছে ইউক্রেনকে। ন্যাটো দেশগুলো খাদ্য সহ প্রয়োজনীয় জিনিস দিচ্ছে ইউক্রেনকে, সাথে সাথে ইউক্রেন থেকে চলে আসা লোকদের আশ্রয় ও দিচ্ছে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক প্যাকেজে দিয়েছে ইউক্রেনকে। আসলে রাশিয়ার মত পরমানু শক্তিশালী দেশের বিপক্ষে সরাসরি যাওয়ার অর্থ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে আমন্ত্রন করা, তাই আমেরিকা ইউরোপীয়ান দেশ গুলোকে সাথে নিয়ে গোপনে যথেষ্ট সাহায্য করে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.