আন্টার্কটিকার জন্য বিশেষ বিল পাশ করা হয়েছে ভারতবর্ষে
রাজেশ রায়:- আন্টার্কটিকা টিকা বিল ২০২২ এর নাম শুনেছেন? গত ২২ জুলাই লোকসভা এই বিল পাশ করিয়েছে। গত ২৭ জুলাই রাজ্যসভা তে এই বিল পাশ করানো হয়। এবার আপনাদের মনে হবে কেন এই বিল ভারত সরকার আনল? কারন ইতিমধ্যেই আন্টার্কটিকা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক আইন আছে। এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে সাথে আন্টার্কটিকার ইতিহাস সম্পর্কেও আলোচনা করা হবে।
পৃথিবীর একদম দক্ষিনমেরুতে অবস্থিত আন্টার্কটিকার আয়তন অস্ট্রেলিয়ার দ্বিগুণ এবং এটি ইউরোপের থেকেও বড়। এত বড় মহাদেশ হওয়া সত্বেও এখানে কেউ থাকে না কারন এর বেশীরভাগ অংশ পুরু বরফে ঢাকা। এখানে মানুষ সাধারনত যায় পর্যটক হিসাবে না হয় গবেষনা করতে। এই প্রদেশ কোন দেশেরই অংশ নয়। এখানের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৮৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতন। এখানে বিভিন্ন দেশ তাদের গবেষনা কেন্দ্র তৈরি করেছে। ১৮২০ সালে প্রথম আন্টার্কটিকার নাম শোনা যায়, যা আবিষ্কার করেছিল রাশিয়ানরা। এর আগেও বিভিন্ন মাছুড়েরা এই প্রদেশ সম্পর্কে জানত তবে সরকারি ভাবে ১৮২০ সালকেই আন্টার্কটিকার আবিষ্কার হিসাবে ধরা হয়। এরপর ইউরোপীয়ান দেশ গুলো এখানে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। উনিশ শতক আসতে আসতে এশিয়া ও আফ্রিকাতে ইউরোপীয়ানরা তাদের উপনিবেশ তৈরি করেই ফেলেছিল, সেইজন্য তাদের মনে হল এবার একটা নতুন কোন মহাদেশে যাওয়া যাক। কিন্ত কিছুদিনের মধ্যেই তাদের ভুল ভাঙল। তারা বুঝতে পারল আন্টার্কটিকা মানুষের বসবাসের জন্য নয়।
১৯১১ সালে নরওয়ের রোয়াল্ড আমান্ডসেন প্রথম কোন ব্যাক্তি হিসাবে দক্ষিন মেরুতে পৌঁছান। রোয়াল্ড আমান্ডসেন ও ব্রিটিশ পর্যটক স্কটের মধ্যে সবসময় একটি প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত নতুন জায়গা আবিষ্কার নিয়ে। রোয়াল্ড আমান্ডসেনের দক্ষিন মেরু পৌঁছানোর কীছুদিন পরেই স্কট সেখানে পৌঁছায় তবে দুর্ভাগ্যবশত তিনি মারা যান সেখানে। ১৯০৮ সালে ব্রিটেন আন্টার্কটিকা তাদের বলে দাবি করতে থাকে। কারন যেহেতু ফকল্যান্ড দ্বীপে সেসময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রন ছিল সেজন্য আশেপাশের সবকীছু ব্রিটেন নিজেদের বলে দাবি করতে থাকে। আগামী ৪০ বছর ধরে ব্রিটেনের দাবি চলতেই থাকে। তবে অন্যান্য দেশগুলোও পিছিয়ে থাকে না। ১৯২৪ সালে ফ্রান্স আন্টার্কটিকা তাদের বলে দাবি করতে থাকে। এরপর নাজি জার্মানি, নরওয়ে আন্টার্কটিকা দাবি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ব্যাপারটা একটু থেমে গিয়েছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর চিলি, আর্জেন্টিনাও এই প্রদেশ তাদের বলে দাবি করতে থাকে। কারন তাদের দাবি ছিল ভৌগোলিক ভাবে আন্টার্কটিকার সবচেয়ে কাছে তারাই রয়েছে।
কিন্তু আমেরিকার এসব পচ্ছন্দ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা অনেক শক্তিশালী ছিল, সুতরাং তারা কারও পরোয়া না করেই অপারেশন হাইজাম্প শুরু করে। এর লক্ষ ছিল আন্টার্কটিকায় বৈজ্ঞানিক অভিযান করা। লাতিন আমেরিকার দেশ গুলোর সাথে ব্রিটেনের যুদ্ধও হয় এসময়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয় যার জন্য দু’পক্ষই আন্টার্কটিকা নিজেদের বলে দাবি করতে থাকে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন ১৯৫০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডও আন্টার্কটিকার দাবি করতে থাকে। এই বহু পক্ষীয় লড়াইয়ের জন্য সমস্ত দেশগুলো আলোচনায় বসে এবং ১৯৫৯ সালে আন্টার্কটিকা চুক্তি হয় ১২ টি দেশের মধ্যে। ১৯৬১ সাল থেকে এই নিয়ম শুরু হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এটাই প্রথম কোন চুক্তি যেখানে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একসাথে সম্মত হয়। দুই দেশই আন্টার্কটিকায় অস্ত্র না ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তিতে ঠিক করা হয় আন্টার্কটিকা কোন একটি দেশের অধীনে থাকবে না বরং এখানে সবদেশ আসতে পারবে। চুক্তিতে বলা হয় বিশ্বের সব দেশ এখানে বৈজ্ঞানিক গবেষনার জন্য আসতে পারবে কিন্তু কেউ কোনও সামরিক বেস তৈরি করতে পারবে না এখানে। ভারত ১৯৫৯ সালে আন্টার্কটিকা চুক্তিতে সই করেনি কারন ভারত চাইছিল আন্টার্কটিকাতে যেন মাইনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৮১ সালে ভারত ভাবল তারা বাকী বিশ্বের থেকে যাতে পিছিয়ে না যায় সেজন্য আন্টার্কটিকায় অভিযান শুরু করে। সেসময় যারা চুক্তিতে সই করেছিল তারাই এখানে গবেষনা দল পাঠাতে পারত। সেজন্য ভারত ১৯৮১ সালে গোপনে গোয়া উপকূল থেকে একটি গবেষনা দল পাঠায় আন্টার্কটিকায়, এর নাম দেওয়া হয় অপারেশন গঙ্গোত্রী। এরপর থেকে সবসময় এখানে ভারতীয় গবেষনাগার রয়েছে।
১৯৮৩ সালে ভারতও আন্টার্কটিকা চুক্তিতে সই করে। বর্তমানে এই চুক্তিতে ৫৪ টি দেশ যুক্ত আছে যার বেশীরভাগ ইউরোপীয়ান, আমেরিকান দেশ। মধ্য প্রাচ্য ও আফ্রিকান দেশ গুলোর এখানে তেমন কোন আগ্রহ নেই। তবে একটা ব্যাপার যে ৫৪ টি দেশের মধ্যে ২৯ টি দেশ আন্টার্কটিকা চুক্তির যেকোনো বৈঠকে ভোট দিতে পারে যার মধ্যে ভারতও আছে। আন্টার্কটিকা কোন দেশের অংশ নয় কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, চিলি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের এখানে এখনও দাবী আছে। তাদের বক্তব্য যদি ভবিষ্যতে কোনওদিন এই মহাদেশের ভূমি ভাগ হয় বিভিন্ন দেশের মধ্যে তাহলে তাদের দাবী সবার আগে থাকবে। ১৯৮১ এর পর থেকে ৪০ বছরে ভারত এখানে অনেক বৈজ্ঞানিক অভিযান করেছে এবং এখানে ভারতের তিনটি বেস আছে। ১৯৮৩ সালে ভারত আন্টার্কটিকায় তাদের প্রথম বেস তৈরি করে যার নাম দক্ষিন গঙ্গোত্রী, ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় বেস তৈরি হয় মৈত্রী এবং ২০১২ সালে ভারতী বেস তৈরি করা হয়। এখনও পর্যন্ত আন্টার্কটিকায় ভারত ৪০ এর বেশী বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছে এবং ২০০৭ সালে ভারতের আন্টার্কটিকা অভিযানে ৭০ টি ভারতীয় সংস্থা যুক্ত ছিল। দক্ষিন গঙ্গোত্রী বেস ১৯৮৯ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় কারন এর অর্ধেক অংশ বরফে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সেজন্য এখন মৈত্রী ও ভারতী এই দুটো বেসই রয়েছে।
তাহলে এবার মনে হবে ভারত কেন আন্টার্কটিকা নিয়ে নতুন করে আইন করল? কারন ভারত চুক্তিতে সই করে দিয়েছে। দেখুন আন্তর্জাতিক মত অনুযায়ী আন্টার্কটিকায় প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইন থাকা দরকার। ৪০ বছর ধরে আন্টার্কটিকায় থাকার পরও ভারতের নির্দিষ্ট কোন আইন ছিলনা যার জন্য আমাদের অনেক গবেষনা আন্তর্জাতিক আইনের জন্য আটকে গিয়েছিল। ২৭ টি দেশ এর আগেই তাদের দেশে আন্টার্কটিকা বিল পাশ করিয়েছে, ভারত একটু দেরীতেই এটা করল। মিনিস্ট্রি অফ আর্থ সায়েন্স এই বিলের প্রস্তাব দিয়েছিল। এই বিলের জন্য বেশ কিছু কারন আছে। প্রথমত আন্টার্কটিকায় পর্যটক ও বৈজ্ঞানিক গবেষনার হার ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্ব উষ্ণয়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে আন্টার্কটিকায় অভিযান নিয়ন্ত্রন দরকার। দ্বিতীয় ১৯৮৩ সালে ভারত আন্টার্কটিকা চুক্তিতে সই করার প্রায় ৪০ বছর পরও কোন ভারতীয় আইন ছিল না ফলে এখানে ভারতকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসরন করতে হত যা লজ্জাজনক ব্যাপার। তৃতীয়ত সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে আন্টার্কটিকা যেহুতু কোন দেশের অংশ নয় তাই এখানে কোন দেশের আইন কাজ করে না। এবার আন্টার্কটিকা নিয়ে কোনও ভারতীয় আইন না থাকায় যদি এখানে কোন ভারতীয় ব্যাক্তি কোন অপরাধ করে তাহলে তার বিচার করা যেত না। যদিও আন্টার্কটিকায় খুবই কম সংখ্যক ভারতীয়কে ভাল ভাবে পীরক্ষা করে পাঠানো হয় তবুও এই আইন করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা না হয়। এই বিল পাশ করার ফলে এবার আন্টার্কটিকায় কোন ভারতীয় অপরাধ করলে তাকে ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে। চতুর্থত পরিবেশ রক্ষা করা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। সঠিক আইন থাকলে এখানে পরিবেশের ক্ষতি কেউ করতে পারবেনা।
পঞ্চমত এই বিল অনুযায়ী ভারতের কোন বৈজ্ঞানিক সংস্থা, কোম্পানি আন্টার্কটিকায় অভিযান করতে গেলে ভারত সরকারের ১০ সদস্যের একটি কমিটি থেকে অনুমতি নিতে হবে। মিনিস্ট্রি অফ আর্থ সায়েন্সের সেক্রেটারি এই কমিটির প্রধান হবে। এছাড়াও এই বিলে ভারতীয়দের এখানে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যা আগে ছিল না। এতদিন কোন ভারতীয় পর্যটক আন্টার্কটিকা ঘুরতে গেলে তাকে যেত হত দক্ষিন আমেরিকা বা আমেরিকার কোন ভ্রমন সংস্থার সাথে কারন ভারতীয় কোন ভ্রমন সংস্থার এখানে ভ্রমন করানোর অনুমতি ছিলনা, এই বিলে ভারতীয় ভারতীয় সংস্থাদের ভ্রমনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটা তো গেল এই বিলে কী কী অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবার জানা যাক এই বিল কী কী জিনিস বারন করছে। এই বিল অনুযায়ী কোন ভারতীয় ব্যাক্তি আন্টার্কটিকায় ভারত সরকারের অনুমতি ব্যাতীত ড্রিলিং, মাইনিং ও খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করতে পারবে না। গবেষনার জন্য এসব কাজে ভারত সরকারের অনুমতি লাগবে। আন্টার্কটিকার স্থানীয় প্রজাতি যেমন প্যেঙ্গুইন আরও অনেক প্রানী হত্যা করা বা ধরে নিয়ে আসা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এরকম করলে ৫০ লাখ অবধি জরিমানা ও সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হবে। কোনওরকম পরমানু মৌল নিয়ে গেলে ৫০ কোটি টাকা অবধি জরিমানার পাশাপাশি ও ২০ বছরের জেল হবে। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। আন্টার্কটিকায় কোন অপরাধের বিচারের জন্য ভারত সরকার একটি বিশেষ আদালত তৈরি করছে।