২০০ শতাংশ বেশী গতিতে সৌর বিদ্যুৎ ইনস্টল ভারতবর্ষে
রাজেশ রায়:– বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়া পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণয়ন কে প্রতিরোধ করতে বিশ্বকে ফসিল ফুয়েলের বদলে বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধান করতেই হবে। ২০৫০ এর মধ্যে ভারতকেও ফসিল ফুয়েল পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে, এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে। ফসিল ফুয়েলের বিকল্প হিসাবে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শক্তির উৎস রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সোলার এনার্জি বা সৌর বিদ্যুৎ। ইতিমধ্যেই ভারত সৌর বিদ্যুৎতের ব্যাবহারে রেকর্ড তৈরি করেছে এবং কিছু সমস্যাও আছে।
ভারত ২০২১ এ ১০ গিগাওয়াট সোলার এনার্জি ইনস্টল করেছে যা রেকর্ড। ভারত প্রতিবছর ২০০ শতাংশ বেশী গতিতে সৌর বিদ্যুৎ ইনস্টলের প্রজেক্ট করে চলেছে। ২০২২ এর ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী ভারত ৫০ গিগাওয়াট সোলার এনার্জি তৈরির মাইলস্টোন স্পর্শ করেছে। ২০৩০ এর মধ্যে ভারত লক্ষ্য নিয়েছে ৫০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপন্ন করার, এরে মধ্যে বায়ু বিদ্যুৎ, জল বিদ্যুৎ, নিউক্লিয়ার এনার্জি সবই আছে। ৫০০ গিগাওয়াটের মধ্যে শুধু ৩০০ গিগাওয়াট শক্তিই সোলার এনার্জির মাধ্যমে উৎপন্ন করার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। এই মহূর্তে সোলার এনার্জি তৈরিতে ভারত বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে ৭০৯.৬৮ গিগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ তৈরি হয় যার ৬.৫ শতাংশ ভারত তৈরি করে। করোনা মহামারীতে ভারত সহ গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে যা বিগত ৩০ বছরেও হয়নি। সোলার এনার্জি ভারতের মজবুত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছে। আত্মনির্ভর ভারত হওয়ার ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুত ভারতকে কীভাবে সাহায্য করবে?
অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী ভারতের শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য সোলার এনার্জি সেক্টর খুবই উপযোগী। যতবার ভারতের আর্থিক ব্যবস্থা একটু দুর্বল হয়েছে যেমন ১৯৩০, ১৯৯১, ২০০৮ তখনই বিভিন্ন নীতিতে অর্থনীতি পরিবর্তনে জোর দেওয়া হয়েছে, তবে একটা ব্যাপার সমান ছিল সব সময়ই তা হল ফসিল ফুয়েলের উপর জোর দেওয়া। তবে নতুন আর্থিক মডেল বলে পুনব্যাবহার যোগ্য শক্তির উপরে জোর দিতে হবে যাতে ইকোনমি বুস্ট হবে। বিশ্বের বহু উন্নত দেশই বর্তমানে গ্রীন এনার্জি বা পুন ব্যবহারযোগ্য শক্তির উপরে জোর দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া গত বছরই গ্রীন এনার্জি চুক্তি করেছে। ভারত নিজেও গ্রীন এনার্জির ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে। আগেই বলা হয়েছে ভারতের লক্ষ্য ২০৩০ এর মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট গ্রীন এনার্জি তৈরি করা যার মধ্যে শুধু ২০২২ এর মধ্যেই ১৭৫ গিগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন হবে যার ১২০ গিগাওয়াট সোলার এনার্জি এবং ৬০ গিগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ থেকে আসবে।
কিন্ত এখানে একটা বড় সমস্যা আছে। ভারত এখনও পর্যন্ত ৫০ গিগাওয়াট যে সৌর বিদ্যুৎ তৈরি করেছে তার ৪২ গিগাওয়াটই এসেছে গ্রাউন্ড মাউন্টেড ফটোভোল্টিক থেকে অর্থাৎ কোন একটি বড় ফাঁকা জায়গায় অনেক সোলার প্লেট একসাথে স্থাপন করে তার মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তি সাপ্লাইয়ের মাধ্যমে, ৬.৪৮ গিগাওয়াট এসেছে রুফ টফ অর্থাৎ ঘরের ছাদে থাকা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে এবং বাকী ১.৪৮ গিগাওয়াট এসেছে আরও বিশেষ কিছু উপায়ে। সোলার এনার্জি তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী উপযোগী উপায় বলা হয় ঘরের ছাদে সোলার প্যানেলে স্থাপনের মাধ্যমে কারন এতে এনার্জির অপচয় কম হয়। গ্রাউন্ডে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে যে সৌর বিদ্যুৎ পাওয়া যায় তাতে শক্তির অনেক অপচয় হয়। কারন কোন ফাঁকা জায়গায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপন্ন সৌর বিদ্যুৎ কোম্পানির মাধ্যমে ট্রান্সফরমার হয়ে ঘরে যেতে যেতে অনেকটাই এনার্জি নষ্ট হয়। এছাড়াও ফাঁকা জায়গায় উৎপন্ন সোলার এনার্জি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে একটি বিশাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার দরকার যা অত্যন্ত ব্যায়বহুল তুলনামূলক ভাবে প্রত্যেক ঘরের ছাদে প্যানেল বসানোর মাধ্যমে অনেক কম খরচে বেশী শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব।
তাই রুফ টপ সিস্টেম সবচেয়ে ভাল কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি।
কেনো রুফ টপ সিস্টেমে ভারত পিছিয়ে আছে এখনও? আগেই বলা হয়েছে ২০২১ এ ভারত ৬.৪৮ গিগাওয়াট রুফ টপ সোলার এনার্জি তৈরি করেছে এবং ২০২২ এর মধ্যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ৪০ গিগাওয়াট এনার্জি তৈরির। সংখ্যাটা এত কম হবার পেছনে প্রধান দায়ী ফাইন্যান্সিং সিস্টেম। বড় বড় জায়গায় সোলার প্যানেল তৈরিতে সহজেই লোন পাওয়া যায় কিন্তু ঘরে বা ছোট ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে এই সিস্টেম ইনস্টল করতে খুব কম লোনই পাওয়া যায়। এছাড়াও বিদ্যুৎ কোম্পানি গুলো এই সিস্টেম ইনস্টল ও মিটারিং এর ব্যাপারে ততটা আগ্রহ দেখায় না।
২০১৯-২০ তে ভারতের মোট পাওয়ার জেনারেশন ছিল ১৩৯০ বিলিয়ন ইউনিট যার মধ্যে মাত্র ৫০ বিলিয়ন ইউনিট সোলার এনার্জির বা প্রায় ৩.৬ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের গতি কিছুটা হলেও আস্তে হচ্ছে। এরজন্য জমির সমস্যাও বড় দায়ী। জমির দাম অত্যন্ত বেশী, তাছাড়া অনেক সময় বড় বড় জায়গায় সোলার প্যানেল ইনস্টলের ক্ষেত্রে অনেক সময় পরিবেশ নিয়েও সমস্যা দেখা যায়, বিভিন্ন সংস্থা বাধা দেয়। এসব কারনেই সরকারের বিশেষ ছাড় থাকা সত্বেও কম খরচে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে। তবে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে যার প্রধান হচ্ছে প্রোডাকশন ইউনিট। সোলার এনার্জির জন্য দরকারী অংশ যেমন সোলার শেল, সোলার প্যানেল ভারতে উৎপাদনের হার কম। ৩১ মার্চ, ২০২১ এর তথ্য অনুযায়ী ভারত ৩ গিগাওয়াট ক্যাপাসিটির সোলার শেল এবং ৮ গিগাওয়াট ক্যাপাসিটির সোলার প্যানেল তৈরি করে। ২০২১-২২ এ ভারত চীন থেকে ৭৬.৮৭ বিলিয়ন ডলারের সোলার শেল ও মডিউল আমদানি করেছে যা ভারতে ব্যবহৃত সোলার এনার্জি সিস্টেমের ৭৮.৬ শতাংশ। চীন থেকে এত দামী সিস্টেম ক্রয় করা হয় কারন ভারতের তুলনায় চীন থেকে কম দামে পাওয়া যায়। সুতরাং ভারতের এখানে দরকার একটি সারকুলার ইকোনমি মডেল। যার মধ্যমে নষ্ট হয়ে যাওয়া সোলার প্যানেলকে ফেলে দেবার বদলে রিসাইকিলিং এর মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যায়। তবে ভারত টার্গেট নিয়েছে ২০৩০ এর মধ্যে ৪২ বিলিয়ন ডলারের সোলার সিস্টেম দেশেই তৈরি করার। ২০৩০ এর মধ্যে ভারত ৩৪,৬০০ মেট্রিক টন সোলার প্যানেল নষ্ট করবে, এই বিশাল পরিমান জিনিসকে নষ্ট করার বদলে যদি পুন ব্যাবহার যোগ্য করে তোলা যায় তাহলে গোটা সিস্টেমে দাম কমবে। আন্তর্জাতিক রিনিউএবেল এনার্জি এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের সোলার শেল নষ্ট হয়। বর্তমানে একমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন সোলার শেলের পুনরায় ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের কাছে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে ২০১৫ সালে ভারত ও ফ্রান্স যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সোলার অ্যালায়েন্স তৈরি করেছে বা আইএসএ তৈরি করেছে। এই আই এস এর প্রধান কার্যালয় হরিয়ানার গুরগাও এ। এখনও পর্যন্ত ১২০ টি দেশ এর সদস্য। জাতিসংঘের পর সবচেয়ে বড় সংগঠন এই আইএসএ। আইএসএ কে ব্যবহার করে ভারত আরও উন্নত সিস্টেম, বিনিয়োগ সহ বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে পারে। এর পাশাপাশি সরকার ও ব্যাঙ্কিং সংস্থা গুলিকে যৌথভাবে রুফ টপ সিস্টেম ইনস্টলেশনের জন্য ফাইন্যান্সিং ব্যাপারে বিশেষ পরিকল্পনা আনতে হবে।
সোলার এনার্জির মাধ্যমে আত্মনির্ভর ভারত তৈরিতে ছয়টি বড় সুবিধা হবে।
১) কাজের সুযোগ বৃদ্ধি:– সোলার এনার্জি সেক্টরে দক্ষ, অর্ধ দক্ষ, অদক্ষ সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে গ্রীন এনার্জি সেক্টরে ১১ মিলিয়ন কর্ম সংস্থান হয়েছে।
২) গ্রাম অঞ্চলের উন্নতি:– গ্রাম অঞ্চলে সোলার এনার্জি সেটআপের মাধ্যমে অনেক কোম্পানি ইনফ্রাস্ট্রাকচারে উৎসাহিত হবে যার ফলে শহর এলাকার সাথে গ্রামের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমবে। স্থানীয় মানুষদের রোজগার বাড়বে।
৩) বিদ্যুতের খরচ কমবে ও
৪) তেল উৎপাদনকারী দেশ গুলোর উপর নির্ভরতা কমবে :– ভারত পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হয়েও এনার্জির জন্য বাইরের দেশের উপর নির্ভর করতে হয়। ২০১৩ সালে আমরা যা কয়লা আমদানি করতাম বর্তমানে প্রায় তার দেড় গুনের বেশী আমদানি করি। যদি তেলের হিসাব ধরা হয় তাহলে ভারত বছরে প্রায় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারের তেল আমদানি করে। যদি ভবিষ্যতে কোন কারনে এনার্জি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় ব্যাপক অরাজকতা তৈরি হয়ে যাবে। তাই গ্রীন এনার্জি তৈরি করলে কোন দেশের উপর নির্ভর করতে হবে না। এরফলে অনেক খরচ বাচবে, যার জন্য বিদ্যুৎ খরচ কম হবে।
৫) ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মানে সুবিধা:– একটি থার্মাল বা হাইড্রাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মানে ৩৬-৫৪ মাস সময় লাগে কিন্তু একটি ৫০০ মেগাওয়াটের সোলার এনার্জি সেন্টার তৈরিতে ১৮ মাস সময় লাগে। উপরন্তু সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি থার্মাল বা হাইড্রাল পাওয়ার প্ল্যান্টের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম খরচ হয়।
৬) পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে এবং জীবনযাত্রার মান বাড়বে।