ভারত

পৃথিবীর সবথেকে বড় সোলার পার্ক তৈরি হতে চলেছে ভারতবর্ষের কোথায়?

আজ গুজরাট ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী রাজ্য যেখানে গ্রীন এনার্জির জন্য আরও অনেক প্রজেক্টে কাজ হচ্ছে। গুজরাটের রাজ্য সরকারের মতে গুজরাটে সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের কারনে অপ্রচলিত শক্তি উৎস থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৮,৪৬৬ মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬১,৪৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এজন্য গুজরাটে প্রচুর সৌর বিদ্যুৎ প্রজেক্ট চলছে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢোলেরা সোলার পার্ক। 

আমেদাবাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে ঢোলেরাতে স্মার্ট সিটি তৈরির পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এখান থেকে ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ২০০৯ সালে ঘোষিত ভারতের প্রথম বিশ্বজনীন গ্রীনফিল্ড প্রজেক্ট ঢোলেরা স্মার্ট সিটির অংশ এটি। ২০২২ এর মধ্যে ভারতের ১৭৫ গিগাওয়াট শক্তি উৎপন্নর জন্য এই প্রজেক্ট গুরুত্বপূর্ণ। মে, ২০১৮ তে নতুন অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রক এই প্রজেক্টের অনুমোদন দেয়। ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ এ এই প্রজেক্টে ফেজ-১ তৈরির অনুমতি পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে ভারত সরকার ডেভলপমেন্ট অফ সোলার পার্কস এন্ড আল্ট্রা মেগা সোলার পাওয়ার প্রজেক্টের আওতায় গুজরাটে ১৪,৩৭৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ নেয়। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে গোটা ভারতে ৩৭,৭৭১ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে যার ৩৮ শতাংশই গুজরাটে তৈরি করা হবে। ভারত আপাতত ৪০ গিগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চাইছে। গুজরাটে যেসব সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে ঢোলেরা সোলার পার্ক যার ফেজ ১ এ ১০০০ মেগাওয়াট এবং ফেজ ২ এ ৪০০০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন করা হবে এছাড়া জিআইপিসিএল আরই পার্কে ৬০০ মেগাওয়াট, জিএসইসিএল আরই পার্কে ৩৩২৫ মেগাওয়াট এবং এনটিপিসি আরই পার্কে ৪৭৫০ মেগাওয়াট এবং রাধনেসাদা সোলার পার্কে ৭০০ মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন করা হবে। ভারতের অন্যতম বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোলার পার্ক ঢোলেরা সোলার পার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ইতিমধ্যেই এর জন্য গুজরাটে ১১,০০০ হেক্টর জমি দেওয়া হয়েছে যা অপ্রচলিত শক্তি উৎসের জন্য ভাল জায়গা বলে মান্য করা হচ্ছে। 

ঢোলেরা সোলার পার্ককে গুজরাট সরকারের অধীন গুজরাট উর্জা নিগম লিমিটেড বা জিইউভিএনের দ্বারা পাবলিক প্রাইভেট মডেলে তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রজেক্টে গুজরাটের ছয়টি বড় বড় সংস্থা যুক্ত আছে। ১) গুজরাট পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড বা জিপিসিএল ২) গুজরাট উর্জা নিগম লিমিটেড বা জিইউভিএন। ৩) গুজরাট ইলেকট্রিক ট্রান্সমিশন কর্পোরেশন বা জিইটিসিও ৪) সোলার এনার্জি কর্পোরেশন লিমিটেড বা এসইসিআই ৫) সেন্ট্রাল ট্রান্সমিশন ইউনিট বা সিটিইউ ৬) পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া। ১১,০০০ হেক্টর জায়গার উপর ২৫,০০০ কোটি টাকা বাজেটে ৫০০০ মেগাওয়াটের সোলার পার্ক তৈরি করা হবে যেখানে ১.৬ মিলিয়ন সোলার পিভি প্যানেল, ৫০০০ সেন্ট্রাল ইনভার্টার ও প্রায় ২৫,০০০ কিলোমিটার ডিসি কেবল ইনস্টল করা হবে। এই ঢোলেরা অঞ্চল দিয়ে পাঁচটি নদী লিলকা, উটাভালি, কেরি, পেদালিও এবং সুখবাদর প্রবাহিত হয়ে খাম্বাত উপসাগরে পড়েছে। যার জন্য এই অঞ্চলকে কোস্টাল রেগুলেশন জোন -১ বা সিআরজেড-১ বলা হয়। সিআরজেড -১ সেসব অঞ্চলকে বলা হয় যেসব এলাকা নদীর নিম্ন অববাহিকা ও উচ্চ জোয়ারের মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থিত।

উপকূল অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের জন্য এসব জায়গাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। এই অঞ্চলের একদিকে নদী থাকায় এখামে সোলার পার্ক তৈরির জন্য বিশেষ উপাদান ও তার রক্ষণাবেক্ষনে খরচও প্রচুর হবে যা বাজেট বেড়ে যেতে পারে। ঢোলেরা সোলার পার্কের এলাকা ঢোলেরা স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন বা ডিএসআইআরের কাছেই। এই ডিএসআইআরকে এখনও পর্যন্ত ভারত সরকারের সবচেয়ে বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট বলা হচ্ছে যা ভবিষ্যতে বিশ্বের উৎপাদন ও বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে। 

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ইন্জিনিয়ারিং সংস্থা হ্যালক্রো গ্রুপ এর ডিজাইন করেছে এবং এর কাজ করছে লার্সেন এন্ড টিউব্রো। ২০৪০ এর মধ্যে এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হবে। এটি একবার সম্পন্ন হলে ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র হবে এটি। এবার ঢোলেরা সোলার পার্কের ইনফ্রাস্ট্রাকচার সম্পর্কে একটু বলা যাক। ১১,০০০ হেক্টরের এই জায়গা ৩০ বছরের জন্য ১০,০০০ টাকা প্রতি হেক্টর লিজে দেওয়া হয়েছে। পুরো সোলার পার্ককে ১১ টি সাব ডিভিসনে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি ডিভিশনে ১০০ মেগাওয়াট, ১৬০ মেগাওয়াট ও ২০০ মেগাওয়াটের ২৭ টি প্লট থাকবে। এই প্রজেক্ট তৈরিতে পরিবেশের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। পুরো ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট দুটি ধাপে সম্পন্ন হবে। ফেজ-১ এ গুজরাট পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড বা জিপিসিএল দ্বারা ৫০০০ কোটি টাকার বাজেটে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে এবং ফেজ-২ তে সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বা এসইসিআই দ্বারা ২০,০০০ কোটি টাকার বাজেটে ৪০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হবে।

ফেজ-১ এ উৎপন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে গুজরাট এনার্জি ট্রান্সমিশন কর্পোরেশন লিমিটেড বা জিইটিসিও এবং ফেজ-২ এ উৎপন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া বা পিজিসিআইএল। এই সোলার পার্কে উৎপন্ন বিদ্যুৎকে মাটির নীচে ৪৯ কিলোমিটার লম্বা, ৩৩ কিলোওয়াট এক্সএলপিই কেবল ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেটওয়ার্ক দ্বারা একটি সাবস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখান থেকে পিজিসিআইএলের স্টেশনে নিয়ে আসা হবে। এক্সএলপিই বা ক্রস লিঙ্কড পলিয়েথিলিন কেবেলের মাধ্যমে এই বিদ্যুৎের ভোল্টেজ দুইবার পরিবর্তন করা হবে। প্রথম সাবস্টেশনে এর ভোল্টেজ ৩৩ কিলোভোল্ট থেকে ২০০ কিলোভোল্ট করা হবে এবং পিজিসিআইএলের কেন্দ্রে ২০০ কিলোভোল্ট থেকে ৪০০ কিলোভোল্ট করা হবে, এর জন্য পাওয়ার জেনারেটর ও ট্রান্সফর্মার ইনস্টল করা হয়েছে। এই ট্রন্সফর্মারের মাধ্যমে বেশি দূরত্বে কম খরচে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব হয়। মাটির নীচে এই সিস্টেমে যাতে জল না লাগে সেজন্য বিশেষ জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বহন করার ওয়ারহেড ট্রান্সমিশন টাওয়ার গুলোকে বিশেষভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে ১৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা হাওয়ার বেগ সহ্য করতে পারে।

এবার এই সোলার পার্কের ফটোভোল্টিক টেকনোলজি সম্পর্কে একটু বলা যাক। ঢোলেরা সোলার পার্কে পলি ক্রিস্টেলাইন সিলিকন টেকনোলজি যুক্ত ফটোাবোল্টিক শেল ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি খুবইই উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি যাতে এগুলো অত্যন্ত খারাপ আবহওয়া এমনকী বন্যাতেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। তবে ঢোলেরা সোলার পার্ক যতবড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট ঠিক ততবড়ই বিতর্ক তৈরি হয়েছে এটি নিয়ে। গুজরাট উর্জা বিকাশ নিগম লিমিটেড বা জিইউভিএনএল দ্বারা এই প্রজেক্টের জন্য ২০১৯ সাল থেকে অনেকবার টেন্ডার ডাকা হয়েছে। যাতে টাটা পাওয়ার, ওটু পাওয়ার, ভেনা এনার্জি, রিনিউ পাওয়ারের মতন সংস্থা অংশ নিয়েছিল এবং লেটার অফ অ্যাওয়ার্ড বা এলওএ পাওয়া সত্বেও তাদের বিড বাতিল করে দেওয়া হয়। এলওএ একটি চিঠি যাতে বিডারের অফার স্বীকার করে তাকে ন্যায্য মূল্যে কাজ দেবার জন্য বলা হয়। এই টেন্ডারে প্রতি ইউনিট তৈরিতে ২.৭৫ টাকা বিড রাখা হয়েছিল যা পরে ২.২৯ টাকা প্রতি ইউনিট করা হয়। ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট পুনরায় টেন্ডারের মাধ্যমে এই প্রজেক্টে একটি ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য আগের দর প্রতি ইউনিট ২.২৯ টাকা থেকে পরিবর্তন করে ২.৭৮ টাকা করা হয়। এরপর এলওএ হয় কিন্তু এর দুমাস পরেই বাকী প্রজেক্টের জন্য ইউনিট প্রতি ১.৯৯ টাকা রাখা হয় মূল্য, যার জন্য পূর্বের এলওএ বাতিল করে দেওয়া হয়। ততদিনে ওটুর মতন সংস্থা জমির জন্য ৯৭ কোটি টাকা দিয়েও দিয়েছিল গুজরাট সরকারকে এবং রক্ষনাবেক্ষনের জন্য প্রতি বছর ২৮ কোটি টাকার চুক্তিও করেছিল যা প্রতিবছর ৫ বছর করে বাড়ত। এলওএ বাতিল হওয়ায় ওটু প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে অভিযোগ জানায় এব্যাপারে। তবে এই বিতর্ককে বাদ দিলে ঢোলেরা সোলার পার্ক ভারতের গ্রীন এনার্জির জন্য সত্যিই বড় পদক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.