চীন

মুহূর্তের মধ্যে গোটা এশিয়াকে বিপদে ফেলতে পারে চীনের স্ট্রাটেজি

রাজেশ রায়:- প্রাচীন চীনের এক বিখ্যাত মিলিটারি স্ট্রাটেজিস্ট সুন জু, যিনি বলতেন জলের ধর্ম সবসময় উচ্চ জায়গা ছেড়ে নীচের দিকে বয়ে চলে। যখন কোন ড্যাম ভেঙে যায় তখন জলের বিশাল প্রবাহ প্রচন্ড শক্তিতে প্রায় সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। সুন জুর বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনীকেও ঠিক এমন হওয়া উচিত। শত্রুর উপর তখন আক্রমন করা উচিৎ যখন শত্রু কল্পনাও করতে পারবে না এবং প্রথম আক্রমনেই শত্রুকে পরাস্ত করা দরকার। সুন জু কয়েক শতাব্দী আগেই জল ও সেনাবাহিনীর মধ্যে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে চীনকে দেখে মনে হচ্ছে চীন যেন সুন জুর সেই নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। সম্প্রতি রিপোর্ট অনুযায়ী তিব্বতে চীন বিভিন্ন নদীর উপর একের পর এক ড্যাম তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে যুদ্ধ জলকে কেন্দ্র করে হবে। সুতরাং চীনের এই একের পর এক ড্যাম তৈরির ফলে দক্ষিন এশিয়া সহ দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় কৃষিকাজ সহ জলের সমস্যা তৈরি হতে পারে যা সম্পূর্ণ এলাকার অর্থনীতিতে সমস্যা তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞরা একে চীনের হাইড্রো ওয়েপনস স্ট্রাটেজি বলছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম বসবাসযোগ্য বাসভূমি তিব্বত উপত্যকা যা বর্তমানে চীনের নিয়ন্ত্রনে। পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা জলের জন্য তিব্বত থেকে সৃষ্টি হওয়া নদী গুলোর উপর নির্ভর করে। তিব্বতের বড় বড় বরফের গ্লেসিয়ারে প্রচুর পানীয় জলের ভান্ডার রয়েছে যার জন্য আন্টাকটিকা ও আর্টিকের পর তিব্বত কে পৃথিবীর তৃতীয় মেরু বা ওয়ার্ল্ড কাওয়াতে টাওয়ার বলে। তিব্বত থেকে এশিয়ার দশটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর সৃষ্টি হয়েছে। সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, ইয়াংতে, মিকং, ইরায়ডে, সালউইন, ইয়োলো সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদী এখান থেকেই উৎপন্ন হয়েছে যা নীচের ১৮ টি দেশের প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষের প্রয়োজনীয় জলের প্রধান উৎস। এইসব অঞ্চলের শিল্প ও কৃষিকাজের প্রধান উতস এই সব নদী গুলো। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাই হয়ে আসছিল। ১৯৫১ সালে চীনের কমিউনিস্ট দল তিব্বতকে দখল করে নেয়। এজন্য চীনকে আপার রিপেরিয়ান দেশ বলে। নদী যেখান থেকে উৎপত্তি হয় তাকে আপার রিপেরিয়ান দেশ এবং নদী যেসব দেশের উপর দিয়ে বয়ে যায় তাকে লোয়ার রিপেরিয়ান দেশ বলে। চীনের মত বিশ্বের কোন দেশের কাছে এত বড় সুবিধা নেই, যে এত গুলো মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রন করার। চীন এবার সে সুযোগটাই নিয়ে তিব্বতকে ওয়েপনাইজড করতে চলেছে। আগেই বলেছি তিব্বত সবচেয়ে উচ্চ উপত্যকা। সমুদ্রপিষ্ট থেকে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত তিব্বতের নদী গুলো যখন তীব্র গতিতে নীচে আছড়ে পড়ে তখন প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয় এই শক্তিকেই কাজে লাগনোর চেষ্টা করছে চীন। ইতিমধ্যে গত কয়েক দশকে চীন প্রায় ৮৭,০০০ ড্যাম তৈরি করেছে। ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী চীনে প্রায় ৩৪১ মিলিয়ন কিলোওয়াট হাইড্রো পাওয়ার জেনারেশন ক্যাপাসিটি রয়েছে কিন্তু তিব্বতে এর পরিমান মাত্র ১.৭৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট। চীন এর পরিমান দ্রুত বৃদ্ধি করছে। এই মহূর্তে ড্যাম তৈরি করতে চীনের গতির ধারে কাছে নেই কেউ একে ড্যাম রাশ বলে। ২০৬০ এর মধ্যে চীন লক্ষ্য নিয়েছে কার্বনের পরিমান শূন্যতে নামিয়ে আনবে যার জন্য চীন দ্রুত গতিতে হাইড্রো পাওয়ারের উপর কাজ করছে। জিও স্ট্রাটেজিস্ট ব্রাহ্মা চ্যালেনির বক্তব্য অনুযায়ী চীনের এই ড্যাম নির্মানের জন্য এশিয়ায় ভবিষ্যতে জল সংকট তৈরি হতে পারে কারন চীন এই ড্যাম গুলোর মাধ্যমে নদীর গতিপথ ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। চীন ড্যামে জল আটকে রেখে নীচের দেশ গুলোতে কৃত্রিম খরা কিংবা বর্ষার সময় অতিরিক্ত জল ছেড়ে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে কিংবা নদীর জলকে ইচ্ছে করে দূষিতও করতে পারে। এর আগে চীন এমন করেছেও। ২০১৭ সালে ব্রহ্মপুত্রের সিয়াং নদীর জল হঠাৎই কাদাযুক্ত কালো হয়ে যায় যাতে ভারগের সিয়াং ভ্যালিতে কৃষিকাজ ও মাছ চাষের সমস্যা তৈরি হয়। চীনের বক্তব্য ছিল এটা ভূমিকম্পের জন্য হয়েছে কিন্তু পরে বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে চীন ব্রহ্মপুত্র নদীতে টানেল তৈরি করছে যার জন্য এমন হয়েছে। এবার আরও একটা উদাহরন দেওয়া যাক মেকং খরা। তিব্বত থেকে উৎপত্তি হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ন নদী হল মেকং। যা দক্ষিন পশ্চিম চীন হয়ে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম হয়ে দক্ষিন চীন সাগরে মিশেছে। প্রায় ৪,৫০০ কিলোমিটার লম্বা এই নদীর উপর প্রায় ৬০ মিলিয়ন লোক নির্ভরশীল। 

২০১৯ সালে হঠাৎই এসব দেশে মেকং নদীর জল সরবরাহ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায় বিগত ১০০ বছরের মধ্যে জলস্তর সবচেয়ে নীচে নেমে যায়। যার ফলে কম্বোডিয়া, লাওসা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। থাইল্যান্ডের চিনি ও ভিয়েতনামের চাল চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানের মাছের উপর নির্ভরশীল ৮০ শতাংশ মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীন জানায় কম বৃষ্টিপাতের জন্য এমন হয়েছে কিন্তু স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে নদীতে জলের পরিমান একই ছিল। আসলে চীন মেকং নদীর উপর প্রায় ১১ টি ড্যাম তৈরি করেছে এবং আরও তিনটি তৈরি করবে। যারজন্য চীন ইচ্ছে করে জলের প্রবাহ আটকে দিয়ে সেই জলেকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে এবং কৃত্রিম খরা তৈরি করেছে। এইসব দেশ গুলো চীনের মত অর্থনৈতিক ভাবে ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী নয় বলে কিছু বলতে পারে নি। আসলে চীন এই সমস্ত দেশের জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে দেশ গুলোর অর্থনীতি সহ কুটনৈতিক ভাবে দেশগুলোকে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে চাইছে। এমন উদাহরণ অনেক আছে। আচ্ছা তিব্বত থেকে উৎপন্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী ব্রহ্মপুত্রের কথা বলা যাক। ব্রহ্মপুত্র তিব্বতে মাউন্ট কৈলাশের ইয়াংসি গ্লেসিয়ার থেকে উৎপন্ন হয়েছে যাকে তিব্বতে ইয়ারলাং সাংপো বলা হয়। তিব্বতের পূর্ব দিকে নামচা বারওয়া  হয়ে এই নদী ভারতের অরুনাচল প্রদেশ হয়ে আসাম এবং বাংলাদেশ হয়ে বাংলার খাড়িতে এসে মিশেছে। ব্রহ্মপুত্র নদী ২৮৮০ কিলোমিটার লম্বা যার ১৬২৫ কিলোমিটার তিব্বতে, ৯১৮ কিলোমিটার এবং ৩৩৭ কিলোমিটার বাংলাদেশ দিয়ে গেছে। এই নদী ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ৩০ শতাংশ শুদ্ধ জল এবং ৪৪ শতাংশ হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্টর জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল, এছাড়াও ভারত ও বাংলাদেশের ১৪০ মিলিয়ন লোক এই নদীর উপর নির্ভরশীল। ১৯৮৬ সালে আলাস্কাতে এক বৈঠকে এই নদী নিয়ে প্রথম কথা ওঠে, চীন তাদের দক্ষিন ভাগে এই নদীর জলকে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে ২০০৯ সাল থেকে এই নদীর উপর চারটি ড্যাম তৈরি করা হয়েছে এবং আরও ১২ টি ড্যাম নির্মানের কাজ চলছে। বলা হচ্ছে চীনের এই হাইড্রো ওয়েপনস স্ট্রাটেজি সবচেয়ে বেশী চিন্তার কারন ভারতের জন্য কারন তিব্বত থেকে উৎপন্ন হওয়া অনেক নদীই ভারতের উপর দিয়ে গেছে। ভারতের সাথে চীনের ডোকলাম ঝামেলার পর চীন ব্রহ্মপুত্র নদীর কোন হাইড্রো জিওলজিকাল ডাটা ভারতের সাথে শেয়ার করে নি যার জন্য আসামে সেসময় বন্যা হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ও নদীর জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল কিন্তু ভারত তার বিদেশনীতিতে জলকে কোনওদিন ওয়েপনস হিসাবে ব্যবহার করে নি যার জন্য পাকিস্তানের মতন চির শত্রু দেশের সাথেও ভারতের নির্দিষ্ট জল চুক্তি আছে। আসলে জলের সমস্যা চীনে বহু দিনের। চীনের মাও জেদং থেকে শুরু করে শী জিনপিং সবার কথাতেই এই জল সমস্যার ব্যাপার প্রকাশ পেয়েছে। ২০০৭ সালে চাইনিজ কমিউনিস্ট দলের মন্ত্রী সুশেং ওয়াং জানিয়ছিল তাদের প্রতি বিন্দু জলের জন্য লড়াই করতে হয় না হলেই মরতে হবে। গত এক দশকে চীনের প্রায় ৩৫০ লেকের জল শুকিয়ে গেছে। ২০০৭ সালে জলের জন্য চীনের প্রায় ২২.৯ মিলিয়ন লোক অন্য জায়গায় বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। জলের সমস্যা গোটা এশিয়ান অঞ্চলেই সবচেয়ে বড় সমস্যা হতে চলেছে আগামী দিনে। জলকে এশিয়ার নতুন তেল বলা হচ্ছে। চীনের এই হাইড্রো ওয়েপনস স্ট্রাটেজি এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.