স্পেশ টেকনোলজিতে পৃথিবীর প্রচুর দেশকে পেছনে ফেলতে চলেছে ভারতবর্ষ
আজ বিশ্বের বড় বড় শক্তিশালী দেশ গুলো স্পেশ টেকনোলজিতে বিনিয়োগ করছে। এই মহূর্তে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী মহাকাশ সংস্থা আমেরিকা নাসা। তবে ভারতের মহাকাশ সংস্থা ইসরো কোন অংশে কম নয়। ইসরো একটি অটোরিক্সার থেকেও কম খরচে মঙ্গলযান মঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যেতে মঙ্গযানের প্রতি কিলোমিটারে ৭ টাকারও কম খরচ হয় যা একটা রেকর্ড। বর্তমানে ইসরো আরও একটি অসাধারন প্রজেক্টে কাজ করছে যার নাম রিইউসেবল লঞ্চ ভ্যেইকল টেকনোলজি বা আরএলভিটি। এর নাম শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে এলন মাস্কের কথা। কারন এলন মাস্কও এই ধরনের টেকনোলজির উপর কাজ করছে। কিন্তু ইসরো একটু আলাদা ধরনের প্রজেক্টে কাজ করছে যা সফল হলে স্পেশ টেকনোলজিতে ভারত অনেক এগিয়ে যাবে। এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
প্রথমেই জানা যাক রিইউসেবল রকেট টেকনোলজি কী? ধরুন কেউ হাওড়া থেকে ট্রেনে দিল্লি যাচ্ছে। তাহলে সেই ট্রেন ব্যাক্তিটিকে দিল্লিতে নামিয়ে দিয়ে আবার সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবুনতো যদি এমন হত যে ট্রেন একবার দিল্লি যাবার পর আর তাকে পুনরায় ব্যাবহার করা সম্ভব হত না বরং আবার নতুন ট্রেন তৈরি করতে হবে যাত্রার জন্য তাহলে কেমন হত!! এরকম হলে কত খরচ বেড়ে যেত এবং একদিনে কত ট্রেন অতিরিক্ত তৈরি করতে হত। এবার আপনারা বলবেন এমন আবার হয় নাকী!! দেখুন এতদিন ধরে মহাকাশ যাত্রার ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়ে আসছে। পৃথিবী থেকে মহাকাশে যখনই কোন রকেট পাঠানো হয় তখন সেটা আর পুনরায় ব্যাবহার করা যায় না। পৃথিবী থেকে মহাকাশে যখনই কোন মহাকাশযান পাঠানো হয় তখন একটি রকেট তার সাথে যুক্ত করে পাঠানো হয়। রকেট পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বলের বিরুদ্ধে মহাকাশযানকে মহাকাশে নিয়ে যায় এবং তারপর রকেট আলাদা হয়ে যায়। এরপর এই রকেট সাধারনত সমুদ্রে ভেঙ্গে পড়ে। এই রকেটকে আর কোনও কাজে ব্যবহার করা যায় না। এর ফলে প্রত্যেক মিশনের জন্য নতুন করে রকেট তৈরি করতে হয়। এতে খরচ এবং সময় দুই বেশী লাগে। এই জন্য মানুষ্যজাতি এবং অনেক দেশই মহাকাশ গবেষনার জন্য বেশীদূর এগোতে পারেনি। এভাবেই সব চলছিল এবং সবাই ভেবে এটাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে এক ব্যাক্তি স্পেস টেকনোলজিতে বিপ্লব এনে দেয়।
বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি এলন মাস্ক ২০০২ সালে স্পেসএক্স নামে একটি মহাকাশ সংস্থা তৈরি করে এবং রিইউসেবল রকেট তৈরি করা হয়। স্পেসএক্সের ব্যাপক সাফল্যা এটা প্রমান করে দেয় যে রিইউসেবল রকেট কতটা দরকারী। ইসরোর টেকনোলজি সম্পর্কে জানার আগে এলন মাস্কের রকেট টেকনোলজি সম্পর্কে একটু জানা যাক। ভারত থেকে পূর্ব দিকে এগোলে আসে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর, যার দুটি ভাগ আছে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এবং দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগর। অস্ট্রেলিয়ার আশেপাশে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরে একটি বিশেষ জায়গা আছে যার নাম পয়েন্ট নিমো। ল্যাটিন ভাষায় নিমো শব্দের অর্থ নো ওয়ান। এই জায়গাটিকে স্পেসক্রাফট সেমিটারি বলা হয়। সোজা কথায় বললে মহাকাশ থেকে কোন রকেট বা স্যাটেলাইটের ধ্বংসস্তূপ এখানেই ফেলা হয়। ইসরো যে জিএসএলভি রকেটে করে স্যাটেলাইট পৌঁছায় ৩৪০০০ কিলোমিটার উপরে পৃথিবীর কক্ষপথে, তার তিনটি স্টেজ আছে। মানে তিনভাবে ফুয়েল ভর্তি থাকে। প্রথম অংশের ফুয়েল শেষ হয়ে গেলে সেই অংশ আলাদা হয়ে যায়, আবার দ্বিতীয় অংশের ফুয়েল আলাদা হয়ে গেলে সেই অংশ আলাদা হয়ে যায় এবং শেষে থাকে শুধু স্যাটেলাইট। এভাবে পৃথিবী থেকে পাঠানো রকেট সিস্টেমের ৮০-৯০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়৷ এবং এর বেশীরভাগ অংশ এই পয়েন্ট নিমোতেই পড়ে। স্পেসএক্স ঠিক করে যদি এমন ধরনের রকেট তৈরি করা সম্ভব হয় যা পুনরায় ব্যাবহার করা যাবে তাহলে অনেক খরচ বেঁচে যাবে। মূলত প্রথমে স্পেস এক্সের লক্ষ ছিল অন্য গ্রহে বসতি স্থাপনের জন্য বিশেষ রকেট তৈরি করা। এলন মাস্ক এর জন্য মঙ্গল গ্রহকে বেছে নেয়। কিন্তু কীছুদিন পরেই এলন মাস্ক বুঝতে পারে বর্তমান রকেট টেকনোলজিতে এটা সম্ভব নয়।
এলন মাস্ক বলেছেন যে বিমানের মতন যদি কেউ পুনরায় ব্যাবহারযোগ্য রকেটের ব্যবহার শিখে যায় তাহলে মহাকাশযাত্রার খরচ অনেক কমে যাবে। এখন এক কেজি বস্ত মহাকাশে পাঠাতে খরচ ২০,০০০ ডলার, তাহলে কল্পনা করুন একটি মহাকাশযান পাঠিয়ে অভিযান করতে কত খরচ হতে পারে। প্রথম কয়েক বছর রিইউসেবল রকেট তৈরিতে কোন সাফল্য পায়নি স্পেসএক্স। বারবার বিভিন্ন প্রোটোটাইপ ব্যার্থ হয়ে যাচ্ছিল। সেসময় বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানী এলন মাস্কের এসব কর্মকান্ডকে পাগলামি বলেছিল। কিন্তু ডিসেম্বর, ২০১৫ তে স্পেসএক্সের তৈরি ফ্যালকন ৯ রকেট লঞ্চের পর পুনরায় জমিতে ল্যান্ড করে আার সাথে সাথে ইতিহাস রচনা হয়ে যায়। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ফ্যালকন ৯ কে লঞ্চের পর আটলান্টিক মহাসাগরে একটি ড্রোন জাহাজের উপর ল্যান্ড করানো হয়। স্পেসএক্স তার এই ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে প্রচুর উপার্জন করে। নাসাও এখন তার অনেক মিশন স্পেসএক্সের মাধ্যমেই করে।
একটি ফ্যালকন ৯ রকেট তৈরিতে খরচ মোটামুটি ৫৪ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মতন। একবার ফ্যালকন-৯ এর ফ্লাইটে ২ লাখ ডলারের তরল জ্বালানি লাগে। স্পেসএক্সের এই রকেট পুনরায় ব্যাবহার করা যায় যার কারনে নতুন করে ৩৫০ কোটি টাকা দিয়ে রকেট তৈরি করতে হয় না। যে দেশ বা সংস্থা স্যাটেলাইট পাঠাতে চায় তারা শুধু জ্বালানির দাম দেয়। সাধারনত যেকোনও রকেটে তিন স্টেজ থাকে। তবে ফ্যালকন ৯ এ দুটি স্টেজ রয়েছে। স্পেস এক্স প্রথম স্টেজকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনে। ইসরোর জিএসএলভি রকেট প্রথম স্টেজে ১০০ শতাংশ জ্বলানী শেষ হবার পর আলাদা হয়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়ে যায়। কিন্তু ফ্যালকন -৯ তার প্রথম স্টেজে ৫-১০ শতাংশ জ্বালানী বাঁচিয়ে রাখে এবং ধীরে ধীরে পৃথিবীতে ফিরে আসে। তবে এটা মোটেও সোজা কাজ নয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন ক্ষেত্রে প্রবেশের পর নিরাপদে ল্যান্ড করা অনেকটাই কঠিন, তবে স্পেসএক্স এই টেকনোলজি তৈরি করে ফেলেছে। এলন মাস্ক জানিয়েছে এভাবেই তারা একদিন মঙ্গলেও বসতি স্থাপনের চেষ্টা করবে। স্পেসএক্সের মতন চীনের লিংকস্পেস সংস্থা আরএলভি-টিভি নামক রিইউসেবল রকেট তৈরির চেষ্টা করছে যদিও তারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। চীনের পশ্চিম কুইনঘাই প্রদেশে ৩০০ মিটার ওড়ার পর এই রকেট ল্যান্ড করানো হয়। আইস্পেস নামে আরও একটি চাইনিজ সংস্থাও রিইউসেবল রকেট তৈরির চেষ্টা করছে। এই ধরনের রকেট তৈরির ফলে মহাকাশ গবেষনার খরচ অন্তত ৭০ শতাংশ কমে যাবে!!
এবার জানা যাক ইসরোর রিইউসেবল টেকনোলজি প্রজেক্ট সম্পর্কে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে স্পেসএক্স যখন আটলান্টিক মহাসাগরের ড্রোন জাহজে ফ্যালকন ৯ কে ল্যান্ড করাচ্ছিল তখন ইসরো একটি টেস্টের প্রস্ততি নিচ্ছিল। এর একমাস পর মে মাসে ইসরো রিইউসেবল লঞ্চ ভ্যেইকল টেকনোলজি ডেমনস্ট্রেটর বা আরএলভি- টিডি। এবার জানা যাক ইসরোর এই টেকনোলজি এলন মাস্কের থেকে কী করে আলাদা। ভারত আসলে রিইউসেবল স্পেস শাটল তৈরি করছে। স্পেস শাটল প্রথম আমেরিকাই তৈরি করে। ১৯৮১ সাল থেকে আমেরিকা স্পেস শাটল মহাকাশে পাঠাচ্ছে। একটি রকেটে করে স্পেস শাটল মহাকাশে পাঠানো হয় এবং সেখানে মিশন শেষ করে এটি এরোপ্লেনের মতন মাটিতে ল্যান্ড করে। এমনই এক স্পেস শাটল দুর্ঘটনায় মারা যান কল্পনা চাওলা। ২০১১ সালে আমেরিকা স্পেস শাটল ব্যাবহার বন্ধ করে দেয়। রাশিয়াও বুরান নামে একটি স্পেস শাটল তৈরি করেছিল কিন্তু কীছু লঞ্চের পর রাশিয়াও এর ব্যাবহার বন্ধ করে দেয়। মোট কথা ২০১১ এর পর স্পেস শাটল ব্যাবহার বন্ধ হয়ে যায় পুরো। তবে এবার মনে হতে পারে আমেরিকা, রাশিয়া যেখানে বন্ধ করে দিয়েছে সেখানে ভারত এধরনের টেকনোলজি কেন তৈরি করছে!
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ইসরোর স্পেস শাটল আমেরিকার থেকেও উন্নত হবে। আমেরিকার স্পেস শাটল টেকনোলজি বিংশ শতাব্দীর কিন্তু ইসরোর টেকনোলজি আরও অ্যাডভান্সড একবিংশ শতাব্দীর। স্পেসএক্স যেখানে শুধু রকেটের প্রথম স্টেজ বাঁচানোর চেষ্টা করে সেখানে ইসরো গোটা মহাকাশযানই পুনরায় ব্যাবহারযোগ্য করার চেষ্টা করছে, এই অংশ আরও বেশী দামী। এই স্পেস শাটল স্যাটেলাইটকে মহাকাশে প্রতিস্থাপন করে পৃথিবীতে ফিরে এসে রানিওয়েতে বিমনাের মতন ল্যান্ড করে। এবার আপনাদের মনে হতে পারে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা বোধহয় খুবই সোজা! মহাকাশ থেকে কোন মহাকাশযান যখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে তখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষন শক্তির জন্য মহাকাশযানটির গতি অস্বাভাবিক বেড়ে যায় এবং বায়ুমন্ডলে ঘর্ষনের ফলে মহাকাশযানটির তাপমাত্রা ৩০০০-৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে যায়। এই বিশাল তাপমাত্রা সহ্য করবার জন্য স্পেস শাটলে বিশেষ ধাতু, কোটিং ব্যবহার করা হয় এবং শাটলটির গতি ও দিল নিয়ন্ত্রন করবার জন্য বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করা দরকার যা শাটলটিকে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই রানওয়েতে ল্যান্ড করাবে। এই ধরনের সুপার অ্যাডভান্সড টেকনোলজি তৈরিতে সময় লাগে এবং অনেক টেস্ট দরকার।
জীববিজ্ঞান এবং ফার্মা ক্ষেত্রে অনেক পরীক্ষা করার জন্য জিরো গ্রাভিটি দরকার, এর জন্য মহাকাশ সবচেয়ে ভালো। এরজন্য স্পেস শাটলের দরকার হবে। মহাকাশে এখন যেসব স্যাটেলাইট আছে তা একটু খারাপ হলেই বাধ্য হয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে হয়। কিন্তু স্পেস শাটল তৈরি হলে এই স্যাটেলাইট পৃথিবীতে এনে ঠিক করে আবার পাঠিয়ে দেওয়া যাবে মহাকাশে। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হবার কথা। তবে ইসরোর এত ভাল প্রজেক্ট নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ইসরো যখন এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করবে ততদিনে আমেরিকা, চীন অনেক এগিয়ে যাবে। স্পেসএক্স ২০৩০ এর মধ্যে মঙ্গলে বসতি স্থাপনের লক্ষ নিয়েছে। দেখুন স্পেসএক্সের মালিক এলন মাস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি তার পয়সার অভাব নেই, চীনও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভারতের তুলনায় পাঁচগুন শক্তিশালী। সেই তুলনায় অনেক কম বাজেট নিয়েও ইসরো যেসব সফলতা অর্জন করেছে তা প্রশংসনীয়। তবে ভারত সরকারের সবচেয়ে ভাল পদক্ষেপ হচ্ছে ২০২০ সালের জুন মাসে ভারতীয় মহকাশ গবেষনা ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা গুলোকে প্রবেশাধিকার দেওয়া, এতে অদূর ভবিষ্যতে ভারতে একটি শক্তিশালী স্পেস রিসার্চ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে।