পৃথিবী

ইসলাম থেকে হিন্দু ধর্মে ইন্দোনেশিয়ার এই ক্ষমতাবান মহিলা

নিউজ ডেস্কঃ এই বছরের ২৬শে অক্টোবর ইন্দোনেশিয়াতে বালির সিঙ্গারাজা শহরে সুকমাবতী সুকর্ণপুত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম থেকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হন। কে এই সুকর্ণপুত্রী? তিনি ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সুকর্ণো এবং তার তৃতীয় স্ত্রী ফাতমাবতীর কন্যা। সেই সঙ্গে তিনি আবার সেখানকার পঞ্চম রাষ্ট্রপতি মেগাবতী সোয়েকারনো পুত্রীর বোনও বটে।  দেশের এতো হাই প্রোফাইল এক ব্যক্তিত্ব ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় স্বাভাবিক ভাবেই তা সাড়া জাগিয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে।

তার হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত কিন্তু একদিনের নয় বরং তার দিদা ইদা আয়ু নয়োমান রাই শ্রীমবেন ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে। তাছাড়া সুকর্ণপুত্রী এর আগেও বিভিন্ন সময় বেশ কিছু হিন্দু অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন এমনকি অতীতে হিন্দু ধর্মীয় গুরুদের সাথে বিভিন্ন সময় ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেও দেখা গেছে তাকে। তার ধর্মান্তরিত হওয়ার এই সিদ্ধান্তকে ভাই গুন্টুর সোয়েকর্ণপুত্র, গুরুহ সোয়েকর্ণপুত্র এবং বোন মেগাবতী সোয়েকর্ণপুত্রী পুরোপুরি সমর্থন করেছেন।  এমনকি তার সন্তান মুহাম্মদ পুত্র পারভিরা উতামা, প্রিন্স হারিও পান্ড্রাজর্ণ সুমৌত্রা জীবননেগারা এবং গুস্তি রাদেন আয়ু পুত্রী সিনিওয়াতিও তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।

ইন্দোনেশিয়া এখন বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসাবে পরিচিত হলেও এক সময় এই দ্বীপরাষ্ট্রে হিন্দু ধর্মের এক বিশাল প্রভাব ছিল।  প্রথম খ্রিস্টপূর্বাবব্দের শুরুতে জাভা এবং সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জে প্রথম হিন্দু ধর্মের আগমন ঘটে। তারপর ১৫ শতক পর্যন্ত আগুনের বেগে ইন্দোনেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এই ধর্ম। তবে, ইসলামের আগমনের পরে হিন্দু ধর্মের প্রভাব ক্রমে হ্রাস পাওয়ায় এই দেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু, আজও ইন্দোনেশিয়ার বহু হিন্দু রাজা জয়াবায়া, পুরোহিত সাবদাপালনের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করে আশায় দিন গুনছে।

কে এই হিন্দু পুরোহিত শব্দপালন? এবং কি ই বা ছিলো তার ভবিষ্যদ্বাণী?

ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য মাজাপাহিতের রাজা পঞ্চম ব্রাবিজয়ার দরবারের এক জ্ঞানী পুরোহিত ছিলেন শব্দপালন। দেশে ইসলাম ধর্মের প্রভাব বাড়লে ১৪৭৮ সালে ব্রাবিজয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এতেই রুষ্ট হতে পুরোহিত শব্দপালন রাজাকে অভিশাপ দেন। ভবিষ্যৎবাণী করেন, ঠিক ৫০০ বছর পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির সময় পুনরায় ফিরে আসবেন তিনি। শপথ নেন তিনি ঠিক ইসলামের কবল থেকে দ্বীপপুঞ্জকে মুক্ত করে হিন্দু জাভানিজ ধর্মের গৌরব পুনরুদ্ধার করবেন।

কল্পবৃষ অনুসারে, শব্দপালন বলেছিলেন, “আমি রাণীর এবং জাভার সমস্ত ডাং হায়াং (দেবতা এবং আত্মা)এর দাস। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জাভানি রাজাদের সেবক আমি।  এর আগে ২০০০ বছর ধরে, তাদের ধর্ম কখনো পরিবর্তিত হয়নি। পৃথিবীতে আমার জন্ম জাভানি রাজার বংশধরদের সেবা করতে। কিন্তু, এখানেই আমার যাত্রার ইতি। আমি পুনরায় আমার সৃষ্টির মূলে ফিরে যাচ্ছি। আমি প্রার্থনা করি আমাদের রাজার মতি দ্রুত ফিরে আসুক এবং তিনি যেনো জানতে পারেন যে ৫০০ বছর পর আমি আবার জাভাতে হিন্দু ধর্ম পুনরুদ্ধার করব।”

তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “ প্রভু, আপনাকে বুঝতে হবে, আপনি যদি ইসলামে ফিরে যান তবে আপনার সন্তানদের জীবনে অভিশাপ লাগবে, জভি জাতিকে জাভা ছেড়ে যেতে হবে এবং জাভানিজদের পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের অনুসরণ করতে হবে।  কিন্তু একদিন, পুনরায় পৃথিবী একজন বিজ্ঞ জাভানিজ দ্বারা পরিচালিত হবে।”  বিচ্ছেদের আগে, সাবদাপালন রাজাকে সতর্ক করেছিলেন, “আজ থেকে ৫০০ বছর পর আমি পুনরায় ফিরে আসব এবং জাভার আধ্যাত্মিকতা পুনরুদ্ধার করব।  যারা প্রত্যাখ্যান করবে তারা বিলীন হয়ে রাক্ষসদের খাদ্য হবে। যতক্ষণ না সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ হবে ততক্ষণ আমি সন্তুষ্ট হব না।”

ইন্দোনেশিয়ার জনগণকে তার পুনরুত্থান সম্পর্কে সতর্ক করার সময়, তিনি আরো বলেন, “যখন মাউন্ট মেরাপি থেকে অগ্ন্যুৎপাত  শুরু হবে এবং এর লাভা এবং ছাই দক্ষিণ-পশ্চিমে পড়তে আরম্ভ করবে, তখন মনে করবে এটাই আমার ফিরে আসার সংকেত”।  মজার বিষয় হল, ১৯৭৮ সালে, এই দ্বীপে আধুনিক এক মন্দিরের নির্মাণ শেষ হলে অনেক মুসলমান পুনরায় হিন্দু ধর্মে রুপান্তরিত হয় আর ঘটনাচক্রে সেমেরু পর্বতও বিস্ফোরিত হয় সেই সময়। ফলত, অনেক হিন্দু সেই সময় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলো যে শব্দপালনের ভবিষ্যতবাণী সত্য হতে চলেছে।

এবার আসা যাক রাজা জয়ভায়ার ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে

জয়ভায়া ১১৩৫ থেকে ১১৪৭ সিই পর্যন্ত কেদিরি রাজ্যের শাসক ছিলেন। তার রাজত্বকালে পূর্ব জাভা রাজ্যে প্রচুর সমৃদ্ধি ঘটে। শুধু সুশাসক হিসাবে নয় বরং ভবিষ্যৎবাণী করতে পারার জন্যেও লোকে তাকে প্রচন্ড সম্মান করতো। তিনি এমন একটি সময়ে দ্বীপে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিলেন যখন গোটা দেশ এক সংঘাতের সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।  তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলি আজও আধুনিক ইন্দোনেশিয়ায় সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রাখে।  জয়ভায়া হিন্দু সাহিত্যকে যেমন সমীহ করতেন তেমন বাকি কবিদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

তার রাজত্বকালে, জাভার লোকেরা বিশ্বাস করত হিন্দু শাসকরা ছিলেন স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার। জয়ভায়া নিজেও নিজেকে হিন্দু দেবতাদের একজন বলে দাবি করে পুরোনো ওই বিশ্বাসগুলোকেই বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। সেই সময়কার বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ অনুসারে, হিন্দু রাজাকে ঈশ্বর ব্রহ্মার প্রপৌত্র হিসাবে সমাদৃত করা হতো।  জয়াভায়া ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এক স্তবক লিখেছিলেন, যা ‘সেরাত জয়াভায়া’ নামে পরিচিত। জানলে অবাক হবেন এর প্রাচীনতম অনুলিপিটি ১৮৩৫ সালে প্রথম বার অনুবাদ করার আগে পর্যন্ত শুধুমাত্র মৌখিক আবৃত্তির মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মধ্যে চলে এসেছে।

তার বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীগুলির মধ্যে একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের জাভায় দীর্ঘকাল ধরে উপনিবেশ স্থাপন করা। অবাক করার মতো বিষয় হলো তার মৃত্যুর প্রায় ৪০০ বছর পর জাভা সত্যিই ১৫৯৫ সালে ডাচদের দখলে চলে যায়। জয়ভায়াও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ‘হলুদ-চামড়ার মানুষ’ সাদা চামড়ার মানুষদের কাছ থেকে দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা যখন ইন্দোনেশিয়া আক্রমণ করে ডাচ ঔনিবেশিকতার অবসান ঘটালে এই ভবিষ্যৎবাণীও সত্য হয়ে ওঠে। এই হিন্দু শাসকের আরেক ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো যে হলুদ চামড়ার মানুষরা বেশিদিন এই দ্বীপে শাসন চালাতে পারবে না। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি মিথ্যা প্রমাণিত হলেও বাকি দুটি ভবিষ্যৎবাণী মাইল যাওয়ায় অনেকের মধ্যেই বিশ্বাস জন্মায় যে তিনি সত্যিই ঈশ্বর বিষ্ণুর পুনর্জন্ম ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.