ভারত

আমেরিকা, ফ্রান্সের মতো প্রথম বিশ্বের প্রথম সারির দেশ গুলি ভারতবর্ষের সাথে বন্ধুত্ব এবং চুক্তি করার পেছনে কি কারন রয়েছে জানেন?

রাজেশ রায়:— কিছুমাস আগে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভারত সফরে এসেছিলেন। আপনারা হয়ত ভাবছেন এটা তো পুরোনো খবর কেন বলছি?? ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ব্যাপারে আলোচনা করব না আজ। আজ আমরা জানব কেন বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলো ভারতের প্রতি এত আগ্রহী। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ২+২ বৈঠক হয়েছে যাতে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের প্রমান করে। এদিকে রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধেও দুই পক্ষই ভারতের সমর্থন চেয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটি কথা আছে বন্ধুত্ব হোক বা শত্রুতা কোনটাই স্বার্থ ছাড়া হয় না। তাই আজ আমরা এটা জানব আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জাপানের মত বড় বড় শক্তিশালী দেশ গুলো ভারতের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে সে ব্যাপারে।

গত কয়েক বছর ধরে বিদেশনীতির কারনে বিশ্বে ভারতের প্রভাব বেড়েছে। তবে এটা আজ থেকে নয় সেই প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। সিন্ধু সভ্যতার সময়ে ভারত মিশর ও মেসোপোটেমিয়ার সাথে বানিজ্য করত। রোমান সাহিত্যিক প্লিনি ৭৭ সিই তে বলেছিলেন বিশ্বের সমস্ত সোনা ভারতে এসে জমা হয়। অর্থাৎ ভারত সেসময় বিশ্বের অনেক দেশের সাথে বানিজ্য করত। ভারত মশলা, হীরে সহ অনেক জিনিস রপ্তানি করত বদলে সোনা ও রুপো নিত। এজন্য ভারতকে সোনে কী চিড়িয়া বলা হত। সেই প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত আসে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে গ্রীস থেকে মেগাস্থিনিস আসে। এরপর চীন থেকে রাজদূত ভারতে আসে। ভারত থেকেও রাজদূত অনেক দেশে যায়। তবে ভারতের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বৈদেশিক আক্রমন ও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে মুসলিম শাসকরা একের পর এক আক্রমন করতে থাকে। ১৬ শতকে পর্তুগীজরা ভারতে আসে। সেসময় পর্তুগিজ ও ব্রিটিশদের অভিযোগ ছিল ভারতে তাদের রুপো ও সোনা চলে যাচ্ছে কারন ভারতীয় জিনিস সেসময় জগত বিখ্যাত ছিল। তবে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর তুলনামূলক কম খরচে মেশিনে তৈরি জিনিসের সাথে ভারতের মানুষের হাতে তৈরি জিনিস পাল্লা দিতে পারে না। আবার এই সময় ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল যার জন্য ভারতের বৈদেশিক নীতি ব্রিটিশরা ঠিক করত। ভারত ব্রিটিশদের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ভারতের জন্য ব্রিটিশরা রাশিয়া ও ফ্রন্সের সাথে যুদ্ধও করেছিল। এতো গেল ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু তথ্য। 

স্বাধীনতার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ভারতের জন্য নন অ্যালায়েনমেন্ট ও পঞ্চশীল নীতি যুক্ত করে। নন অ্যালায়েনমেন্টের অর্থ হল কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকা। ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে ভারত ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয়তাবাদ কে সমর্থন করেছিল, সেসময় ইন্দোনেশিয়া নেদারল্যান্ডস এর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হতে চাইছিল। ভারত আফ্রিকাতেও জাতীয়তাবাদ মুভমেন্ট কে সমর্থন করছিল। এইসময় এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশের কাছে ভারত একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে পরিনত হয়েছিল। এটা তো গেল ভারতের বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক আলোচনা। এবার জানা যাক বর্তমানে বিভিন্ন দেশ কেন ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চাইছে। 

শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলিই নয় বরং বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোও ভারতের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রাখছে। এর কারন গুলো একে একে জানা যাক। ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার জন্য স্ট্রাটেজিক্যালি ও ইকোনমিক্যালি দুটো গুরুত্বপূর্ণ কারন রয়েছে। যদি ডেমোগ্রাফির কথা বলা হয়, তাহলে ভারতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি যার ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম অর্থাৎ ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। যার জন্য ভারতের বাজার বিশাল, সেজন্য বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের বড় বড় সংস্থাগুলি ভারতের প্রতি আগ্রহী। এশিয়ার আরও একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ চীন কিন্ত ভারতের তুলনায় চীনে উৎপাদন খরচ, শ্রমিকের খরচ বেশী তাছাড়া ভারতের বিনিয়োগ নীতি খুবই সরল যার জন্য সবাই ভারতের প্রতি আগ্রহী। স্ট্রাটেজিক্যালি ভারতের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরের প্রায় মাঝে অবস্থিত ভারত। এই ভারত মহাসাগর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যের জন্য কাারন বিশ্বের মোট তেল বানিজ্যিের ৮০ শতাংশ এখান দিয়েই হয়। ভারত মহাসাগর ভূমধ্যসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের বানিজ্যপথ কে সংযুক্ত করে। ভারত মহাসাগরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চোক পয়েন্ট রয়েছে যেমন মালাক্কা প্রনালী, হরমুজ প্রণালী ও বাব এল মানদেব, এগুলো ভারত খুবই সহজে তাদের নেভির মাধ্যমে নজরে রাখতে পারে। সুতরাং ভারতের সাথে সম্পর্ক ভাল রাখার অর্থ ভারত মহাসাগরে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা। তাছাড়া চীনের বিরুদ্ধে ভারত মহাসাগরে ভারতের তুলনায় শক্তিশালী দেশ আর একটাও নেই। সেইজন্য আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ভারতের সাথে যৌথভাবে কোয়াড জোট গঠন করেছে যাতে চীনের উপর ভারত মহাসাগরে নজর রাখা যায়। এছাড়াও জাপান, আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সাথে ভারত মহাসাগরে রীতিমতো সামুদ্রিক এক্সারসাইজ যেমন মালাবার এক্সারসাইজ, ভরুনা এক্সারসাইজ হয়। এছাড়া দক্ষিন চীন সাগরে আশিয়ান দেশ গুলোর সাথে চীনের বিরোধীতা রয়েছে। ভারত এক্ষেত্রে আশিয়ান দেশ গুলোকে সমর্থন করছে।

তাছাড়া সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন ঝামেলায় যেভাবে আমেরিকা ইউক্রেন থেকে সরে গেছে সেক্ষেত্রে আশিয়ান দেশ গুলো শুধু আমেরিকার উপর নির্ভর করে থাকতে পারছে না। এজন্য দেশগুলো ভারতকে বিকল্প হিসাবে দেখছে। ডেমোগ্রাফি ও স্ট্রাটেজিক দিকের পর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারন তা হচ্ছে অর্থনৈতিক। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগের ডাটা অনুযায়ী ২০৩১ এ ভারতের জিডিপি হতে চলেছে ৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলার যা ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিনত করবে। তাছাড়া আগেই বলেছি ভারতের বিশাল বাজার যার জন্য বিদেশি দেশ গুলো এখানে বিপুল বিনিয়োগ করছে। গত ২২ মার্চ জাপান জানিয়েছে আগামী পাচ বছরে তারা ভারতে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভারত সফরে এক বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারীতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ভারতে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি করেছে। ভারতে এত বিনিয়োগের প্রধান কারন এখানকার পরিবেশ। দেখুন সৌদি আরব, কাতার সহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে এদের তুলনায় ভারতের প্রভাব বেশী কারন মধ্যপ্রাচ্যে প্রায়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা যায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর আজ পর্যন্ত ভারতে কোনদিন সেনা অভ্যুত্থান হয়নি কিন্তু আশেপাশের দেশ গুলোতে রীতিমতো সামরিক শাসন ছিল। যারজন্য গোটা বিশ্বের কাছে একটি শক্তিশালী গনতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পরিচিত ভারত। এই জন্য আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপীয়ান দেশ গুলো ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। 

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই মহূর্তে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নেতা যার জন্য ভারতের প্রভাব রয়েছে বিশ্বে। তাছাড়া কোন দেশের অভিবাসী সেই দেশের বিদেশ নীতির উপর একটি বড় প্রভাব ফেলে। তথ্য অনুযায়ী গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৩২ মিলিয়ন ভারতীয় বাস করে, এছাড়াও ভারতীয় বংশদ্ভূত লোক গোটা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০০ টি রাজনৈতিক দলের বড় বড় পদে ভারতীয় অভিবাসীরা রয়েছে। আমেরিকা ও ভারতের সিভিল নিউক্লিয়ার চুক্তির পেছনেও এই অভিবাসীদের বড় ভূমিকা ছিল। কানাডার রাজনীতিতে ভারতীয়দের বড় ভূমিকা রয়েছে। এই মহূর্তে বিশ্বের অনেক দেশের ক্ষমতায় ভারতীয় বংশদ্ভূত লোক রয়েছে। যেমন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিও কোস্টা, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রভীন যুগনানুথ, গুয়ানার রাষ্ট্রপতি ইরফান আলি। ভারতের বিভিন্ন ধর্মের এবং বিভিন্ন জাতির লোক বাস করে যার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে এই কারনে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভারতের প্রাচীনকাল থেকেই সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের একটি নীতি রয়েছে যা বলে বসুন্ধরা কুটুম্বক, যার জন্য লাতিন আমেরিকান দেশ হোক, আফ্রিকান দেশ হোক কিংবা ইউরোপীয়ান দেশ সবাই ভারতকে গুরুত্ব দেয়। ভারতের নেবারহুড ফাস্ট নীতি অনুযায়ী নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ কে ভারত প্রচুর সাহায্য করে। 

২০২২-২৩ এ আফগানিস্তান কে ভারত ২০০ কোটি টাকার সাহায্য দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কাকে ভারত এক বিলিয়ন ডলার লোন দিয়েছে। নেপাল ভূমিকম্প থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার সুনামিতে ভারত যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ভারতের এই মানবিক দিকের জন্য ভারতের সাথে সম্পর্ক মজবুত রয়েছে প্রায় সব দেশেরই।

ভারত সরকার বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব বাড়াতে একাধিক পদক্ষেপ নিচ্ছে যেমন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, মেক ইন ইন্ডিয়া নীতি, কোয়াডের মতন গ্রুপ তৈরি, সাগর প্রজেক্ট। তাছাড়া সবসময় ভারত যুদ্ধ নয় শান্তির পক্ষেই কাজ করেছে। যার জন্য আমেরিকা, রাশিয়া সহ বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.