ভারতবর্ষকে শায়েস্তা করতে কি ছক চীনের?
নিউজ ডেস্কঃ এশিয়ায় একাধিপত্য বজায় রাখতে ভারতকে বরাবরই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে এসেছে চিন। পথের কাঁটা ভারতকে শায়েস্তা করতে চীনের হাজার কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হলো নিঃসন্দেহে ১৯৮৮ সালের ২৭ জুন ক্লিনটন এবং জিয়াং জেমিনের মধ্যে হওয়া শীর্ষ বৈঠকটি। বৈঠকের শেষে এই দুই রাষ্ট্রনেতা দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যৌথ ভাবে একটি স্বতন্ত্র বিবৃতি জারি করেছিলেন। যা ভারতের কাছে ছিলো না একেবারেই গ্রহণযোগ্য। চিন ও আমেরিকার এই বৈঠক ভারতকে ততটা তাতিয়ে তোলেনি যতটা না এই বিবৃতিতে লেখা শব্দগুলি করেছিলো। কিন্তু, কি এমন লেখা ছিলো এই বিবৃতিতে? সহজ ভাবে বলতে গেলে যুগ্ম এই বিবৃতিতে বলা হয়েছিলো যে আমেরিকানরা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারতের বদলে চীনের ওপরেই একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা চাপাচ্ছে। এর আগেই অবশ্য ৩ জুন হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে হোয়াইট হাউস প্রেস কর্পস-এ মন্তব্য রাখার সময় ক্লিনটন নিজেই প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ন ভাবে চীনের ওপরেই। নিক্সন যে খানিকটা চিনের দিকে ঝুঁকতে আরম্ভ করেছেন তা নিয়ে ভারতীয় কূটনীতিকদের মনে আর সন্দেহ ছিল না কোনো। ফলে, ভারত এই গোটা ঘটনাটিকে চিন ও আমেরিকার এক নতুন অংশীদারিত্বের সূচনা হিসাবেই গণ্য করেছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক বড়সড় ধাক্কার সম্মুখীন হয় এই সময়। যার ফলে, বেইজিং-এ ভারত ও আমেরিকার দূতাবাসের মধ্যে এক বড়ো ধরনের যোগাযোগের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় এবং একই সাথে ১৯৯৪ সালের ৩ জুলাই চিনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিম সাসের দ্বারা আয়োজিত বার্ষিক চতুর্থ জুলাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটিকেও ভারতীয় কূটনীতিকরা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায়।
ঠিক এরকমই এক মুহুর্তে চীন তাদের প্রথম ভুলটি করে বসে। তারা ধরেই নিয়েছিল যে আমেরিকার সাথে চিন এক মধ্যস্থতায় যখন আসতে পেরেছে তখন মার্কিন সরকার ভারত সম্পর্কে চিনা নীতিই অন্ধ ভাবে অনুসরন করবে। বাস্তবে অবশ্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্লিনটন তার ডেপুটি সেক্রেটারি স্ট্রোব ট্যালবটকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ন্যাশ্যানাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সরকারের একজন বর্ষীয়ান সদস্য যশবন্ত সিংয়ের সাথে আলোচনায় বসার জন্য। এই গোটা ঘটনাটাই অবশ্য বহুদিন ধরেই একেবারে অজানা ছিলো চীনের। ক্লিনটন প্রশাসন সেই সময় বাজপেয়ীর যে চিঠি ফাঁস করেছিলো, তার খসড়া অনেক দিন আগেই তৈরি করা হয়েছিলো অত্যন্ত সাবধানতার সাথে। এর আগে বাজপেয়ীর তৈরি এক দল আমেরিকানদের সম্পর্কে তাদের নিজস্ব মূল্যায়নের পর উপসংহারে পৌঁছেছিল যে ভারত পরমাণু পরীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে আমেরিকার কাছ থেকে যেরকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে তা মোটেই ভারত সম্পর্কে আমেরিকার চূড়ান্ত অবস্থান হবে না। ভারত পরমাণু অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলে ভারতের ওপর আমেরিকার তরফ থেকে কোনো বাঁধা নিষেধ চাপবে কিনা তা নিয়ে সঠিক এক ধারণা গঠনের জন্য বাজপেয়ী স্বয়ং ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ফ্রাঙ্ক উইজনারের ওপর ব্যক্তিগত ভাবে তদন্ত শুরু করেছিলেন। তৎকালীন বিজেপি নেতারা, ক্ষমতায় নতুন হলেও দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রাজনীতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির সূক্ষ্মতাটা বেশ ভালোই বুঝতেন।
তৎকালীন সরকার সেই সময় ভারতের বিরুদ্ধে চীনের ওঠানো মামলাগুলিকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে সাহায্য নেয় ১৯৬৪ সালের চিনা প্লেবুক থেকে বেছে নেওয়া উপাদানগুলোর। চীনের রাষ্ট্রপতি সিনহুয়া-ও ১৯৬৪ সালের ১৬ই অক্টোবর তার দেওয়া একটি বিবৃতিতে ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলা এক পারমাণবিক হুমকির কথা ঘোষণা করেছিলেন (তাদের ক্ষেত্রে হুমকিটা আসছিলো অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে) এবং একই সাথে অন্যের অর্থাৎ পশ্চিম জার্মানের ‘রিভাঞ্চিস্টদের’ হাতে পারমাণবিক অস্ত্র হস্তান্তরের কথাও বলেছিলেন। ভারতের তৎকালীন সরকার ও মূল্যায়নের পর আন্দাজ করেছিলো যে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড়ো দ্বিধার সৃষ্টি করবে।
একদিকে,ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো কড়া প্রতিক্রিয়া না জানালে তা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক পারমাণবিক অপ্রসারণ প্রচেষ্টার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে, অপরদিকে তাদের বেশি কঠোর প্রতিক্রিয়া আবার ক্লিনটনের ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক জোরদার করার পরিকল্পনাকে ব্যাহত করতে পারে। তাই ক্লিনটন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সময়, পারমাণবিক ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার প্রস্তাবও পেশ করেছিলেন। বাজপেয়ী সেই সময় ক্লিনটনের আলোচনার প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে আলোচনার জন্য নিযুক্ত করেন যশবন্ত সিংকে। আমেরিকান নেগোসিয়েটর স্ট্রোব ট্যালবটকে স্মরণ করতে হয়েছিলো যে তিনটি মহাদেশের সাতটি দেশের মোট দশটি স্থানে যশবন্ত সিং এর সাথে চৌদ্দবার দেখা করেছিলেন তিনি। আমেরিকানদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য সত্যিই সেই সময় সিংয়ের চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি আর কেউ ছিলেন না। পরবর্তীকালে যশবন্ত সিং, তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি ভালো ভাবেই অবগত ছিলেন যে ক্লিনটনের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হতে বাকি ছিলো মাত্র তিন বছরেরও কম সময়। ফলে, ওই সীমাবদ্ধতাকেই যথাসম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করে তিনি NPT এবং CTBT-এর মূল অবস্থানগুলি স্বীকার না করে আমেরিকার বিধি নিষেধের জাল থেকে ভারতকে বের করে আনার চেষ্টা শুরু করেন। উল্লেখ্য, এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি বুশ ক্ষমতায় আসার পর সম্পন্ন হলেও তার কৃতিত্ব নেহাত কম ছিলো না।
ইতিমধ্যে, ১৩ই মে এবং ৩ জুলাই প্রথম দুটি শুনানি শেষ হওয়ার পর ১৯৯৮ সালের ১৩ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার তৃতীয় শুনানি চালু হয়। ভারতের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা এই কাহিনী ততদিনে ওয়াশিংটনের অন্যান্য মহলেও পৌঁছাতে শুরু করে দিয়েছিলো, বিশেষত ক্যাপিটল হিলে। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নরেশ চন্দ্র সেই সময় কংগ্রেসনাল আইলের উভয় পক্ষে থেকেই কাজ করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে হেনরি কিসিঞ্জারের মতো কূটনৈতিক দ্রষ্টাদের সাথে যুক্ত হয়ে বৈঠকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন। তিনি যুক্তি দেন দীর্ঘমেয়াদী ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষাগুলি আদপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো খবর, এশিয়ায় এতে শক্তির সামঞ্জস্য বজায় থাকবে। নরেশ চন্দ্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ওয়াশিংটনে ভারতের জন্য এক বড়সড় জয় এনে দেয়। সেই সঙ্গে এটি তখন আমেরিকার বিরোধী দল রিপাবলিকানদের পরমাণু ইস্যুতে ডেমোক্রেটিক পার্টির থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখার একটি পথ খুলে দেয়। ট্যালবট পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন যে ক্যাপিটল হিলে আমেরিকার দুই রাজনৈতিক দলই তখন এক ভারতপন্থী মনোভাব নিয়ে চলছিলো ফলে, পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্লিনটনের প্রশাসনের জন্য বেশ মুশকিল হয়ে উঠেছিলো।
১৩ জুলাই তৃতীয় বৈঠক চলাকালীন, সিনেটর স্যাম ব্রাউনব্যাক তার সহকারী সেক্রেটারি ইন্ডারফার্থকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে চীন সম্পর্কে ভারতের কোনো রকম নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ রয়েছে কিনা! এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ১৩ মে প্রাথমিক সাক্ষ্য দেওয়ার সময় অত্যন্ত সন্তর্পনে তিনি এই বিষয়টিকে নিশব্দে লুকিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাউনব্যাক বলেন যে তিনি এবং তার সহকর্মী সেনেটর চার্লস এস রব, ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কানাঘুষোয় জানতে পেরেছেন যে দক্ষিণ এশিয়ায় জিয়াং- ক্লিনটনের যৌথ বিবৃতি এবং চীন সম্পর্কে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবেদনশীলতার অভাব ভারতকে ভীষণই চিন্তিত করে তুলেছে। এই ঘটনাই ইন্ডারফার্থকে তার পুরোনো অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। তিনি সর্বসমুক্ষে জানান: ‘আমরা কখনো বলিনি যে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে চীনকে ব্যবহার করা উচিত আর না তো এই কথাতে বিশ্বাস করি আমরা।” ইন্ডারফার্থ সাক্ষী দেওয়ার সময় দাবি করেছিলেন যে আমেরিকা চীনের সাথে আলোচনার টেবিলে বসেছিলো বলেই তারা ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে রাজি হয়েছিলো। কিন্তু, পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে চীনের সাথে আমেরিকা আলোচনায় বসেছিলো ঠিকই কিন্তু, চিন সরাসরি ভারতের সাথে কথা বলার কোনোরকম প্রতিশ্রুতি দেয়নি বরং চিন খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের বলা যাবতীয় কথা শুনেছিল।
সত্যি কথা বলতে, ইন্ডারফুর্থ এর দাবি অনুযায়ী চিন যতই মনোযোগ দিতে কথা শুনুক না কেনো শেষ অব্দি তারা কিন্তু কাজে ঠিক উল্টোটাই করে দেখিয়েছিলো। তারা ভারতকে আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে যে কোনো ভাবে এক আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রাখার জোরদার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। সম্ভবত এখানেই চিন ভারত সম্পর্কে মার্কিন নীতি বুঝতে ভুল করে ফেলেছিলো। ১৯৯৫ সালে এনপিটি পর্যালোচনায় সাফল্য এবং ১৯৯৬ সালে সিটিবিটি নিয়ে আলোচনার সময় আমেরিকার সাথে চীনের বৈঠক সফল হওয়াতে তারা সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলো যে প্রসারণের বিষয়টি আমেরিকার কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি সফল ভাবে শেষ করতে চীনের কথা মেনে তারা ভারতকে শাস্তি দিতেও পিছুপা হবে না। ভারতের প্রতি চীনের অবজ্ঞা সেই বৈঠকে ছিলো পরিষ্কার। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেনি যে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা আমেরিকাকে সামরিক ভাবে বিচলিত করলেও ক্লিনটনের প্রশাসন মনে প্রাণে চাইছিলো ভারতের সাথে গণতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব পুনরুজ্জীবিত করতে। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখতে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছিলো আমেরিকার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন সম্ভবত অনুমান করেছিল যে ভারত এশিয়ায় চীনাদের জন্য কখনই একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হবে না এবং এই ধারণাটিই ক্লিনটন-জিয়াং জেমিন শীর্ষ সম্মেলনের পরে আমেরিকা সমরকে চীনের নীতিকে ভুল পথে চালিত করে।