মাঝে মধ্যেই কেন চীনের সাথে ঝামেলা হচ্ছে ভারতবর্ষের?
নিউজ ডেস্কঃ চীন ভারতের বিবাদ কি নিয়ে? কখনও ভেবে দেখেছেন? অর্থাৎ হটাৎ হটাৎ কেন চীনের সাথে ভারতের এই ঝামেলায় জড়িয়ে পরা? চীন ভারত বিবাদে বেশ কিছু দিক আছে যেগুলো প্রশ্ন আকারে সামনে উঠে আসছে। আর সব থেকে বড় প্রশ্ন মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন হঠাৎ কিছু দিন অন্তর অন্তর ভারত চীন বিবাদ হচ্ছে। কখনও ভারতের সাথে ধস্তাধস্তি কখনও বা মারপিট। কিন্তু এর কারন কি ভারতের মিলিটারি ডেভেলপমেন্ট? নাকি অন্য কিছু?
না অবশ্যই মিলিটারি ডেভেলপমেন্ট নয়। আর তার কারন হল বর্ডার ইনফ্রাস্ট্রাক্চার ডেভেলপমেন্ট। এই বিষয়ে বর্তমান সরকার বড় প্রশংসার অধিকার।
1962 সালে ভারত চীন যুদ্ধে ভারতের হেরে যাওয়ার কারন কখনই ভারত বা চীনের শক্তির তারতম্য ছিল না। ছিল দুই দেশের চিন্তাভাবনার পার্থক্য। চীন যখন তিব্বত থেকে ভারতের ওপর ঝাপিয়ে পরেছিল তখন ভারতের সেনাবাহিনী নিজের সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে যথেষ্ট প্রতিরোধ প্রথমিক ভাবে গড়ে তোলে। কিন্তু খুব তারাতারি প্রয়োজন পরে বিমানবাহিনীর। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বিমানবাহিনী ব্যবহারে ছাড়পত্র দিতে অস্বিকার করে। আর বিমানবাহিনীর বোম্বার গুল ভারতীয় সেনাকে ব্যপক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সুযোগটি হারায়। কারন ভারতীয় অঞ্চল গুলিতে বায়ুর ঘনত্ব ছিল বেশি। স্বাভাবিক ভাবে ভারতীয় বিমানবাহিনী অনেক বেশি লোড নিয়ে উড়তে পারতো। আর অনেক বেশি ফুয়েল বহন করতে সক্ষম ছিল। অন্যদিকে তিব্বতের অঞ্চলো বায়ুর ঘনত্ব অত্যন্ত কম হওয়ায় চীনের বিমানগুলি “এ্যস্থিমা” রোগে আক্রন্ত ছিল। সামান্য লোড বেশি হলে হাপাতে হাপাতে বিমান রানওয়েপে পরতো। সেই সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রতিদিন যত অর্ডিন্যন্সের বর্ষন চীনের ওপর করতে পারতো চীন তার ১/৪ অংশ করতে সক্ষম ছিলনা এমটাই মত সামরিক বিশেষজ্ঞদের।
বিমানবাহিনীর ব্যবহারে ছাড়পত্র না আসার শুধু যে বোম্বিং বন্ধ হয়েছিল তা নয়। ভারতীয় সেনা সামান্য রসদ টুকু পায়নি। কারন সেই সময় আমাদের বর্ডারে কোনো রোড কনস্ট্রাক্সান হয়নি। ফলে ল্যন্ডের মাধ্যমে ভারতের বহু বর্ডারে রসদ পৌছায়নি।
শুধু তাই নয় তারপর বহু বছর এই বর্ডারে পরিকাঠামো উন্নয়নে কোনো জোড় দেয় নি সরকার। তার কারনটা ছিল অত্যন্ত হাস্যকর। তৎকালীন সরকাররা ভাবতো ভারত যদি বর্ডারে রাস্তা নির্মান করে তবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি চীন আরও দ্রুত ঢুকে আসবে ভারতবর্ষের পথ ব্যবহার করে। অর্থাৎ দেশের সেনার ওপর কোনো ভরসাই ছিলনা।
এমনকি বাজপায়ি সরকারও এবিষয়ে উদাসীন ছিল। কিন্তু ২০১৪সাল থেকে যে বৈদ্যুতিক বেগে কাজ শুরু হয় তা এক একথায় চীনের কাছে ৩৩,০০০ ভোল্টের শকের থেকে কম কিছু ছিল না।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বর্ডার রোড এবং অন্যান্য স্ট্রেটেজিক পরিকাঠামো উন্নয়নে ঝাপিয়ে পড়ে মোদী সরকার। বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলে যেভাবে কাজ হয়েছে তা কল্পোনার অতীত। ইউপিএ এর আমলে যেখান উত্তর পূর্বের অঞ্চলে 0.6 কিমি রাস্তা প্রতিদিন তৈরি হত সেখানে 2014 সালের পর থেকে 1.5কিমি তৈরি হওয়া শুরু হল। 2009 থেকে 2014 সালের মধ্যে ইউপি আমলে যেখানে 1079.25 কিমি রাস্তা তৈরি হয়েছিল সেখানে 2014 থেকে 2019 সালে ভারতের উত্তর পূর্বে মোট রাস্তা তৈরি হয়েছে 2731 কিলোমিটার। মূলত ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া এবং বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন এই কাজ করতে সফলতা অর্জন করে। এর মধ্যে সবথেকে বেশি রাস্তা পরিকাঠামোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে আসামে 1011 কিলোমিটার। অরুণাচল প্রদেশ 851 কিলোমিটার এবং মণিপুরে 373 কিলোমিটার রাস্তা সম্পন্ন হয়েছে। মিজোরামে 233কিমি, মেঘালয়ে 205কিমি, ত্রীপুরা 196কিমি, সিকিম 105কিমি ও নাগাল্যন্ডে সব থেকে কম 67কিমি রাস্তা তৈরি হয়েছে।
এরপর অতিরিক্ত 12 হাজার কিলোমিটার রাস্তা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে তৈরি করার জন্য ভারত সরকার 1 লক্ষ 90 হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। শুধু 2019 সালে সারা ভারতে মোদি সরকার 60 হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে সবথেকে বেশি চীনের কাছে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডোকলামের কাছে ভারতের 19.72 কিলোমিটার রাস্তা। যা এক কথায় চীনের একাধিপত্যের ওপর এক বিরাট চ্যলেঞ্জ। এর নাম ভিম-বেস ডোকালা রোড। এই বেস ভারতকে সব থেকে বড় সুবিধা দিয়ে থাকে চীনের বিরুদ্ধে। কারন এখনে পুরো ভৌগলিক সুবিধা ভারতের অধীন। এই রোড নির্মানের আগে এই বেসে লজিস্টিক সাপোর্ট পৌছাতে ৭ঘন্টা লাগতো। রোড নির্মানের পর তার এখন ৪০মিনিটে থেমেছে।
শুধু 2019 সালে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশান ভারত-চীন সীমান্তে 19 টি এয়ারফিল্ড এবং দুটি খুবই কঠিন টানেলের কাজ সম্পন্ন করেছে যা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে চলেছে আগামীকালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময়।
এছাড়াও হিমাচল প্রদেশের পৃথিবীর দীর্ঘতম মাউন্টেন টানেল তৈরি করছে ভারতের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন মোট দৈর্ঘ্য 8.8 কিলোমিটার। এটি তৈরিতে খরচ পরছে 4,000 কোটি টাকা। প্রতিদিন 3000গাড়ি ও 1500 ট্রাক এর মধ্যে দিয়ে 85কিমি প্রতিঘন্টার গতীতে যায়। বছরের অর্ধেকের বেশি সময় লেহ তে বরফ থাকে। তাই উত্তরের এই অঞ্চল গুলির সাথে রোডের সংযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই এই টানেল ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ বজায় রাখবে। লেহ এর সাথে লাদাখের যুক্ত হওয়া এই টানেল ভারতের সেনাবাহিনীর জন্য এক আশির্বাদ।
অন্যদিকে ভুপেন হাজারিকা ব্রীজের নির্মান ছিল আরও একটা মাথা ব্যাথার কারন চীনের জন্য। এই 9.76 kilometres এর ব্রীজ T-72 এর মত ট্যাঙ্ক গুলি বহনে সক্ষম। এই ব্রীজ হওয়ার আগে যেখানে পুরো পথ অতিক্রম করতে সেনাবাহিনীর 8 ঘন্টা লাগতো সেখানে এখন দুই ঘন্টা লাগে।
এছাড়াও আরও অনেক কাজ হয়েছে যা হয়তো বলা সম্ভব নয়। অনেকের মতে এত রাস্তা এবং ব্রিজ টানেল বানিয়ে কি হবে যদি ভারতের কাছে অস্ত্র না থাকে? কিন্তু ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। ব্যাপক পরিমাণে অস্ত্র থাকলেও আপনি কিছু করতে পারবেন না যদি সেগুলি আপনি প্রয়োজনে ব্যবহার করার জায়গায় নিয়ে না যেতে পারেন।
আগে চীন ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকতো কিন্তু রাস্তা ঠিক না থাকার অভাবে ভারতীয় সেনা সেই জায়গায় দ্রুত গিয়ে চীনকে পিছনে ফেলতে পারত না কিন্তু আজকে সেই সমস্যা নেই ভারতের বিভিন্ন অংশে ব্যাপকভাবে রড কনস্ট্রাকশন হওয়ায় ভারতীয় সেনা সেইসব অঞ্চলে দ্রুত পৌঁছাতে পারছে এবং চীনকে যথোপযুক্ত উত্তর দিতে পারছে। ভারতের লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ভারতের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে উন্নত হওয়ায় ভারত খুব দ্রুত প্রতিটি জায়গায় স্টেপ নিতে পারছে এবং এটা চীনের সবথেকে বড় রাগ ভারতের বিরুদ্ধে। আর এটাই কারণ যে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত চীনের বিবাদ তুঙ্গে উঠেছে। এমনকি বর্তমান বিবাদের সূত্রপাত এর থেকে হয়।
পাহাড়ি অঞ্চলের হিমালয় পর্বত কেটে ভারত যে ধরনের রাস্তা গত কয়েক বছরে নির্মাণ করেছে যা কোন দেশের পক্ষেই হয়তো সম্ভব হতো না। চীন কখনও কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি এইসব অঞ্চলে ভারত এই ধরনের স্ট্র্যাটেজিক রোড বানাতে সক্ষম হবে।
শুধু রোড বা ব্রিজ নয় এয়ারফিল্ড বানানোর ফলে ভারতের এয়ার কানেক্টিভিটি ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। এর ফলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দ্রুত বিভিন্ন এলাকায় রসদ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয় এবং প্রয়োজনে ফাইটের এয়ারক্রাফট ডেপ্লয় করতে পারেন।
উত্তর-পূর্বের রোড কনস্ট্রাকশনের এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে যা ভবিষ্যতেও করা হবে। অবশ্যই ভারতীয় বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে মোদি সরকার এখনও অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে কিন্তু মোদি সরকার যে ধরনের অঞ্চলগুলিতে এখন উন্নয়নের কাজ করছে সেই অঞ্চলগুলির উন্নয়ন সত্যিকারের প্রয়োজন ছিল।
মিলিটারি ডেভেলপমেন্ট আরো 5 বছর হয়তো এইভাবে চলবে কিন্তু একবার রোড কনস্ট্রাকশন বর্ডার এলাকায় শেষ হলে ভারত 30 বছরের জন্য নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে এমনটাই মত একাধিক বিশেষজ্ঞের।