ভারত

পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে এক অজানা সৈনিকের তীর কীভাবে ভারতের ইতিহাস বদলে দিয়েছিল জানেন?

রাজেশ রায়:– ইতিহাস বইয়ে সবাই পড়েছেন ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা হয় বাবর। উজবেকিস্থান থেকে বাবর ভারতে এসেছিল। বাবরের পর তার ছেলে হুমায়ুন এবং হুমায়ুনের পর তার ছেলে আকবর ভারতে রাজত্ব করে। এই ভাবে একটি চেন সিস্টেম চলতেই থাকে। কিন্তু এরই মাঝে একজনের নাম করা দরকার সম্রাট হেমু, হয়ত ইতিহাস বইয়ে কদাচিৎ পড়ে থাকবেন এনার নাম। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধে যদি একটু পরিস্থিতি পাল্টে যেত তাহলে আজ ভারতের ইতিহাস অন্য হত। আজ আমরা ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট হেমুর ব্যাপারেই আলোচনা করব। একজন সাধারন পরিবারের ছেলে হয়ে ভারতের সম্রাট হয়ে ওঠার কাহিনী আলোচনা করব। তবে খুবই দুভার্গ্য ছিল ওনার, পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে যদি হেমু জিতে যেতেন তাহলে আজ ভারতে আকবরের শাসন কোনওদিন হতই না। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে কোন এক অজানা সৈনিকের দ্বারা চালিত একটি তীর কীভাবে ভারতের ইতিহাস বদলে দিল সেই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করব।

১৪৯৪ সাল আসতে আসতে বাবর পুরো উজবেকিস্থান দখল করে নেয়, এরপর আরও দক্ষিনে তার সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। ১৫০৪ সালে বাবরের পুত্র হুমায়ুনের জন্ম হয়। এরপর বাবর পাকিস্তান হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ১৫৩০ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয় যার পর বাবর দিল্লিতে মুঘল সাম্রাজ্যের শুরু করে। কিন্তু দিল্লি দখল করে বেশীদিন রাজত্ব করতে পারেনি বাবর কারন দিল্লি দখলের চার বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় বাবরের, এরপর সিংহাসনে বসে হুমায়ুন। কিন্তু এই সময় ১৫৪০ সালে বিহারে শেরশাহ সুরি নামে একজন ভারত বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকে। শেরশাহ সুরি একজন আফগানি যে ভারতের পূর্বভাগকে নিয়ন্ত্রন করত। বাবরের মৃত্যুর পর যে পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি হয়েছিল তা সামলানোর জন্য যোগ্য ছিল না হুমায়ুন যার জন্য শেরশাহ সুরি দিল্লি আক্রমন করে এবং হুমায়ুন পরাজিত হয়ে পাকিস্তান পালিয়ে যায়, সেখানেও তাকে তাড়া করে শেরশাহ, বাধ্য হয়ে হুমায়ুন আফগানিস্তানে পালিয়ে যায়। ১৫৪২ সালে হুমায়ুনের ছেলে আকবরের জন্ম হয়। হুমায়ুন ভাবছিল ভারতে বোধহয় দীর্ঘদিন রাজত্ব করবে শেরশাহ কিন্তু একটি রাজপুত দুর্গ আক্রমন করতে গিয়ে হঠাৎই মারা যায় শেরশাহ। এর ফলে দিল্লিতে যে বিশাল পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি হয় তা পূরন করা সম্ভব হয় নি। এই সুযোগে হুমায়ুন দিল্লি আক্রমন করে পুনরায় মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু হুমায়ুন ও বেশীদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৫৫৬ সালে হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সে আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব গ্রহন করে। ঠিক এই সময়ই উদ্ভব হয় হেমুর। হেমু বলতে গেলে সুরি সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিল। আসলে এই সুরি সাম্রাজ্যে ছিল শেরশাহের। শেরশাহের মৃত্যুর পর সুরি সাম্রাজ্যে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে যখন সবাই লড়াই করছিল ক্ষমতা দখলের জন্য তখন হেমু সুরি সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে দিল্লি আক্রমন করে। শুরু হয় আকবর ও হিমুর মধ্যে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ। সম্রাট হেমুর ব্যাপারে যদি একটু বলা যাক। ১৫০১ সালে রাজস্থানের মাচেরি অফ আলওয়ার নাম গ্রামে হেমুর জন্ম হয়, তার পুরো নাম ছিল হেম চন্দ্র। তবে ওনার সঠিক নাম ও জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।  ছোট থেকেই ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তিনি। তাঁর পিতা পুরান দাস বৃন্দাবনের বল্লভা সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। বর্তমান হরিয়ানার রেওয়ারি থেকে হিন্দি, সংস্কৃত, আরবি ও পার্সিয়ান শিক্ষা গ্রহন করেন তিনি। আসলে জন্ম রাজস্থানে হলেও খুব কম বয়সেই পরিবারের সাথে তিনি রেওয়ারি চলে আসেন। সেসময় হরিয়ানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়ীক পথ ছিল। ইরান, আফগানিস্তান সহ মধ্য এশিয়া থেকে বানিজ্য হত এপথে। 

ছোটবেলা থেকেই কুস্তি ও ঘোড়ায় চড়তে ওস্তাদ ছিলেন হেমু। গুরুত্বপূর্ন ব্যাবসা পথ হওয়ায় রেওয়ারি তে তিনি অনেক কিছু শিখেছিলেন যেমন কামানের তোপ কী করে তৈরি করা যায়, পর্তুগীজ প্রযুক্তি সহ অন্যান্য অস্ত্র তৈরির পদ্ধতি। ভারতে যুদ্ধে কামানের প্রথম ব্যবহার বাবর করলেও, সঠিক উপায়ে তোপ তৈরিতে এবং বিশেষ করে ডিফেন্স ফ্যাক্টরি প্রথম হেমুই তৈরি করে ভারতে। হেমু মুঘল সাম্রাজ্যে থাকলেও কোনওদিন মুঘলদের অধীনে কাজ করেননি বরং তিনি পূর্বদিকে সুরি সাম্রাজ্যের অধীনে কাজ শুরু করেন, একজন হিন্দু হওয়া সত্বেও প্রতিভার কারনে হেমু ধীরে ধীরে সুরি সাম্রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। ১৫৪৫ সালে শেরশাহের মিত্যুর পর তার ছেলে ইসলাম শাহ নতুন রাজা হয়। রাজা হয়েই তিনি হেমুকে দিল্লি বাজরের নিরাপত্তা প্রধান নিয়োগ করেন। হেমু সুরি সাম্রাজ্যের হয়ে ২২ টি যুদ্ধ করেন এবং প্রত্যেকটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ইসলাম শাহকে পাঞ্জাব দখল করতে সহায়তা করে হেমু। ১৫৫২ ও ১৫৫৩ সালে পাঞ্জাব ও দিল্লি পরিচালনার দায়িত্ব হেমুর উপর দেওয়া হয়।

১৫৫৫ সাল আসতে আসতে হেমু সেনা নিয়ে দিল্লি সীমান্তে উপস্থিত হয়। আগ্রা দখল করে সেখানে রাজত্ব শুরু করে হেমু। এই আগ্রা দখল নিয়ে যুদ্ধ হয় মুঘল ও হেমুর মধ্যে। যাকে তুঘলকাবাদের যুদ্ধ বলা হয়। এতে মুঘলদের পরাজিত করে হেমু।

এইসময় হেমু নিজেকে ভারতের সম্রাট ঘোষনা করে নিজের নাম দেয় সম্রাট হেমু বিক্রমাদিত্য। দিল্লিতে হুমায়ুনের সাথে হেমুর যুদ্ধ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু নিজের লাইব্রেরিতে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় হুমায়ুনের যার জন্য আকবর রাজা হয় এবং এই সময় আকবরের জেনারেল ছিল বৈরাম খান। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হবার আগে হরিয়ানা থেকে সম্রাট হেমুর সেনার জন্য আসা তোপ গুলোকে দখল করে নেয় বৈরাম খান, যা অনেক বড় দুর্ভাগ্য ছিল হেমুর জন্য। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের ময়দান থেকে আকবর কে কয়েক কিলোমিটার দূরে প্রায় হাজর সেনা দ্বার বিশেষ ভাবে ঘিরে রাখা ছিল এবং প্রয়োজনে আকবরকে আফগানিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল কারন বৈরাম খান নিজেও নিশ্চিত ছিল না যুদ্ধে জেতার ব্যাপারে। যুদ্ধে প্রথম থেকেই হেমুর সেনার সামনে মুঘল সেনা দাঁড়াতে পারছিল না। ক্রমশ পিছু হটতে থাকে বৈরাম খান। কিন্তু হঠাৎই এক অজানা সেনার ছোড়া তীরে এসে লাগে হেমুর এবং ঘটনাস্থলেই বীরগতি প্রাপ্ত হন তিনি। রাজা মারা যেতেই সেনা দুর্বল হয়ে পড়ে। এভাবে জিতে যাওয়া যুদ্ধ হেরে যায় হেমু। মৃত্যুর পর হেমুর মৃতদেহ থেকে মাথা কেটে আফগানিস্তানে পাঠানো হয় এবং তার দেহ দিল্লির রাস্তায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। হেমুর গোটা পরিবারের উপর অত্যাচার শুরু হয়। হেমুর বাবাকে হত্যা করা হয়। দীর্ঘদিন ইতিহাসে সম্রাট হেমুর ব্যাপারে কীছু আলোচনা করা হয় নি তবে ইদানীং এব্যাপারে মানুষ কৌতুহল শুরু করেছে। উত্তর প্রদেশ সরকার ও হরিয়ানা সরকার গর্বের সাথে হেমুর নাম তাদের সিলেবাসে রেখেছে। হেমু কয়েক সপ্তাহের জন্য দিল্লি দখল করে তাতে শাসন ও করেছিলেন। বারবার ইতিহাস বই পড়তে পড়তে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে বারবার বাইরে থেকে লোক এসে ভারতে আক্রমন করছে, ভারতের নিজস্ব কোনও শাসক ছিল না। দেখুন মরাঠা, রাজপুত শক্তি তো ছিলই তবে সম্রাট হেমুর কৃতিত্ব কোনও অংশে কম নয়, একজন সাধারন ঘরের ছেলে হয়ে ভারতের সম্রাট হয়ে ওঠার কাহিনী সত্যিই অসাধারন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.