চীনের হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ব্যর্থ। ভারতবর্ষ কি শিক্ষা নিচ্ছে?
রাজেশ রায়:- যেকোনও দেশের শক্তির ভিত্তি হচ্ছে তার অর্থব্যাবস্থা এবং এই অর্থব্যাবস্থা মজুত করবার জন্য সবচেয়ে দরকারী হচ্ছে বানিজ্য সঠিক ভাবে করা। বানিজ্যের জন্য সবচেয়ে দরকারী হচ্ছে পরিবহন ব্যাবস্থা সহজ করা। সহজের অর্থ যাতে পন্য পরিবহন কম সময়ে হয় এবং এতে খরচ কম হয়, তবেই বানিজ্যে লাভের সম্ভবনা আরও বাড়বে। চীন এব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। চীন গোটা দেশ জুড়ে হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করছিল। যাকে বুলেট ট্রেন বলা হয়। কিন্তু চীনের এই পদক্ষেপ বুমেরাং হয়ে গেছে অর্থাৎ চাইনিজ অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এবার আপনাদের অনেকেরই মনে হবে, ভারতও তো বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট শুরু করেছে। মুম্বাই আমেদাবাদ বুলেট ট্রেন প্রজেক্ট যা ২০২৩ সালে সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও করোনা মহামারীর কারনে ২০২৮ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে। এখানে একটা কথা ভাবার মতন যে ভারত-কে কী চীনের থেকে কীছু শিক্ষা নেওয়া উচিৎ!
বুলেট ট্রেন যখন বলা হবে তখন এটি আসে হাইস্পিড রেলওয়ে বা এইচএসআরের অধীনে। সাধারনত ঘন্টায় ২০০-৪০০ কিলোমিটার গতিতে যাওয়া ট্রেনকে হাইস্পিড রেলওয়ে বলে। বিশ্বে যত দৈর্ঘ্যের হাইস্পিড রেলওয়ে লাইন আছে তার তিনভাগের দুইভাগই চীনে আছে, দ্বিতীয় স্থানে আছে জাপান। জাপানের তুলনায় চীনের হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ১০ গুন বেশী। বিশ্বের সবচেয়ে দামী হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক চীনেরই। ২০২১ পর্যন্ত চীনে প্রায় ৪০,০০০ কিলোমিটার হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। স্বভাবতই মনে হবে তাহলে তো চীনের এই মডেল খুবই উন্নত ও লাভজনক। কিন্তু এটাই ভুল ধারনা, সবচেয়ে বেশী নেটওয়ার্কের মানে এটা নয় যে এটা লাভজনক। চীনের হাইস্পিড ট্রেনের ব্যাপারে বলতে গেলে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৯০ সালে তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট ডেং জিওপিং, যাকে আধুনিক চীনের স্থপতি বলা হয়, জাপান সফরে যান। সেখানে তিনি জাপানের হাইস্পিড রেলওয়ে দেখে প্রভাবিত হন। জাপানে বুলেট ট্রেনকে সিনকানসেন বলা হয়। সেসময় চীনের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এতটা উন্নত ছিলনা। সেসময় চীনের রেলের গড় গতি ছিল ৪৮ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। সেসময় লোক ট্রেনের বদলে বিমান অথবা রাস্তায় যাওয়া বেশী পচ্ছন্দ করত। ডেং জিওপিং এটা পরিবর্তনের কথা ভাবলেন। চীনের বুলেট ট্রেন নেটওয়ার্ক দেখলে দেখবেন চীনের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিকে কেন্দ্র গুলো যেমন সেনজেং, বেজিং, সাংহাই বুলেট ট্রেন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু চীনে এই মহূর্তে যতটা হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক আছে তার তুলনায় অনেক বেশী লাইন নির্মান শুরু করেছে চীন। ঠিক এখানেই সমস্যা তৈরি হয়েছে, ছোট ছোট শহরে এই ট্রেনে লাভ তেমন হচ্ছে না এবং বিপুল পরিমান ইউয়ান খরচ হয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত চীনের কারেন্সিকে ইউয়ান বলে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাইস্পিড টেলওয়ে রুট ও চীনেই, বেজিং থেকে হংকং পর্যন্ত।
এবার জানা যাক চীনের এই হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ব্যর্থ কেন হচ্ছে?
১) চীনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বুলেট ট্রেনের বিশেষ লাইন তৈরি নিয়ে। বুলেট ট্রেন সাধারনত একটি বিশেষ ধরনের লাইনে চলে যা দেখতে সাধারন ট্রেন লাইনের মতই। এই ট্রেন গুলোর গতি হচ্ছে প্রায় ৩০০-৪০০ কিলোমিটার কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চীন একটি বিশেষ ধরনের বুলেট ট্রেন দেশে এনেছে যার নাম ম্যাগলেভ ট্রেন, জাপান, জার্মানি এই টেকনোলজি তৈরি করেছে। ম্যাগলেটিভ লেভিয়েশন থেকে এই নাম এসেছে। সাধারন ট্রেনে চাকা থাকে কিন্তু এই ম্যাগলেভ ট্রেনে চাকা থাকে না। প্রবল চৌম্বকীয় শক্তির মাধ্যমে ট্রেনটি মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে উঠে যাতায়াত করে। এই ট্রেন গুলির গতি প্রায় ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশী। এই প্রযুক্তিতে খরচ অনেক বেশী। যদিও সাধারন ট্রেনের মত চাকা না থাকায় ঘর্ষন জনিত কোনও সমস্যা হয় না তবুও এই ধরনের প্রযুক্তি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। সবচেয়ে বড় কথা চীন নিজে এই প্রযুক্তি তৈরি করেনি। চীন জার্মানির থেকে এই ধরনের ট্রেন কিনেছে। ২০০০ সালের দিকে চীনের সাংহাই মিউনিসিপ্যাল সরকার এই ট্রেন কেনা ঠিক করে জার্মানির থেকে যা সাংহাই শহর ও বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করে যা প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্ব। জার্মানি বিক্রি করেছে কিন্তু কোন প্রযুক্তি দেয়নি চীনকে। গোটা দেশ জুড়ে ম্যাগলেভ ট্রেন চালু করতে গিয়ে চাইনিজ রেলওয়ের প্রচুর দেনা হয়ে গেছে।
২) লোক কম হওয়ায় বুলেট ট্রেন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চীনের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র যেমন বেজিং, সাংহাই এসব জায়গায় বুলেট ট্রেন প্রকল্পে কোন সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু যখন এটি ছোট কোন শহরে শুরু করা হচ্ছে তখনই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এবার একটা কথা বলুন বুলেট ট্রেন তৈরি করা হয়েছে যদি তাতে লোকই কম হয় তাহলে তা থেকে লাভ হবে না স্বাভাবিক। এই ঘটনা বোঝা যায় জন ঘনত্ব দিয়ে। প্রতি কিলোমিটারে কতজন যাত্রী এটি ব্যবহার করছে তাকে জন ঘনত্ব বলা হয়। যেমন ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী বেজিং থেকে সাংহাই ১৩১৮ কিলোমিটার পথে একবছরে প্রতি কিলোমিটারে ৪৮ মিলিয়ন লোক এটি ব্যবহার করে। কিন্তু যখন লানজাও উরুকমির মাঝো ১৭৭৬ কিলোমিটার যেতে এখন ট্রেন তৈরি করা হয় তখন এখানে প্রতি কিলোমিটারে ২.৩ মিলিয়ন করে যাত্রী হয়। জাপানের থেকে চীনের হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক অন্তত দশ গুন বেশী কিন্তু জপানের হাইস্পিড রেলওয়েতে জন ঘনত্ব ৩৪ মিলিয়ন প্রতি বছর যা চীনের তুলনায় দ্বিগুন। কারন গড়ে চীনে প্রতি কিলোমিটারে লাইনে জন ঘনত্ব ১৭ মিলিয়ন।
৩) চীন ম্যাগলেভ ট্রেন তৈরি করতে গিয়ে সাধারন বুলেট ট্রেন তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে। সমস্ত মানুষের পক্ষে ম্যাগলেভ ট্রেন ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না কিন্তু তাদের জন্য অন্য কোনও ট্রেনও মজুত নেই। যার জন্য একটা বড় সংখ্যক মানুষ বাধ্য হয়ে রোড ব্যবহার করছে।
৪) এই প্রজেক্টে খরচ অত্যন্ত বেশী, প্রযুক্তি বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে এবং নিরাপত্তা জনিত সমস্যা রয়েছে। এই ধরনের ট্রেন গুলোতে প্রচুর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তি উৎপন্ন হয় যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। তাছাড়া এই প্রজেক্টে পরিবেশের জন্যও ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশের কথা এলেই সবাই ভাববেন হয়ত গাছ কেটে রেললাইন তৈরি করছে চীন! কিন্তু তা নয়, আসলে লোক ট্রেনে যেতে না পেরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে এবং ট্রাক ব্যবহার করছে লোক বেশী যার কারনে দূষন বেশী হচ্ছে।
৫) চীনের রেলওয়ে বিরাট গোপন লোনের ফাঁদে পড়েছে। গোপন লোন বলা হচ্ছে কারন চীনের রেলওয়ে চীনেরই অন্য সরকারি সংস্থার কাছ থেকে লোন নিয়েছে প্রচুর, বাইরের কোন দেশের কাছ থেকে লোন নেয়নি। এরকম অবস্থায় সার্বিক ভাবে চীনের উপর কোন বিদেশী লোন দেখাবে না কিন্তু একটি সরকারি সংস্থা যখন আরেকটি সরকারি সংস্থার থেকে লোন নেয় তাহলে দেশের অর্থনীতির উপরই চাপ বাড়ে। ২০০৯ সালে চীনের উহান ও গুয়াংঝাও এর মধ্যে প্রথম দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের বা ৯৬৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক শুরু হয়। ২০১৮ সালে চীনের প্রায় ৬০ শতাংশ হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্কই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। চীনের চেংদুতেই ক্ষতি হয় ১.৮ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৫-২০ তে চীন যেমন তার হাইস্পিড রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ৯১ শতাংশ বাড়িয়েছে তেমন পাল্লা দিয়ে চীনের রেলওয়ের লোন বেড়েছে। চীনের বর্তমানে ৪০,০০০ কিলোমিটার উচ্চ গতির রেলওয়ে আছে, ২০২৫ এর মধ্যে আরও ৫০,০০০ কিলোমিটার লাইন তৈরির কথা এবং ২০৩৫ এর মধ্যে আরও ৭০,০০০ কিলোমিটার লাইন তৈরির লক্ষ নিয়েছিল চীন কিন্তু সেপ্টেম্বর, ২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী চীনের রেলওয়ের লোন প্রায় ৫.৫৭ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ৮৫০ বিলিয়ন ডলার। যার কারনে একাধিক লাইনে উচ্চ গতির রেল নেটওয়ার্ক তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে চীন। বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ঝাও ঝিয়ান বলেন প্রতি কিলোমিটার উচ্চ গতির রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে প্রায় ১২০-১৩০ মিলিয়ন ইউয়ান খরচ, এই হিসাবে ৩০,০০০ কিলোমিটার লাইন তৈরিতেই খরচ প্রায় ৩.৬ ট্রিলিয়ন ইউয়ান। এই বিপুল অর্থের জন্য চাপ বেড়েছে চীনের অর্থনীতির উপর।
৬) চাইনিজ রেলওয়ে তাদের এই প্রজেক্টে রীতিমতো বন্ড দিয়ে বিনিয়োগ আনে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে লকডাউনে ট্রেনের ব্যবহার তেমন না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা লাভ পায় নি এবং এই জন্য নতুন বিনিয়োগ আসা বন্ধ হয়ে গেছে।
৭) দুর্ঘটনা একটা বড় সমস্যা চীনের রেলওয়েতে। ২৩ জুলাই, ২০১১ তে দুটি চাইনিজ বুলেট ট্রেনের সংঘর্ষে ৪০ জন মানুষ মারা যায় এবং ১৯২ জন আহত হয়। একে ১৯৯৮ এর জার্মানি এবং ২০১৩ সালে স্পেনে রেল দুর্ঘটনার পর বিশ্বের তৃতীয় ভয়ঙ্কর হাইস্পিড ট্রেন দুর্ঘটনা বলা হয়।