পৃথিবী

এক ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য একশো বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা চলেছিল রোমে। অবাক করা ইতিহাস

বলা হয় মানুষের লোভের কোনো শেষ নেই, বিশেষ করে বিশ্বে এমন কিছু বড় সংস্থা আছে যারা তাদের লাভের জন্য সব সীমা অতিক্রম করতে পারে। যেমন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল বানিজ্য করতে, ভারতে তাদের লাভও হচ্ছিল প্রচুর কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের লোভ এতটা বৃদ্ধি পায় যে তারা সেনাবাহিনী গঠন করে ভারত দখল শুরু করে। সাধারন মানুষের উপর নৃশংস অত্যাচার করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের লভ্যাংশ বাড়িয়েছে ভারতে। কোনও একটি রাবার ব্যান্ড নিয়ে অতিরিক্ত টান দিতে থাকলে সেটা একসময় ছিঁড়ে যায়, ঠিক তেমনি কোনও রাজা বা কোনও সংস্থা অতিরিক্ত লাভের জন্য যখন সাধারন মানুষের উপর অতিরিক্ত অত্যাচার করে তখন একসময় সাধারন মানুষেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় ও মানুষ বিদ্রোহ শুরু করে। আবার কখনও ভালো ব্যক্তিও ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যেতে পারে যার ফল ভোগ করে সমগ্র দেশের মানুষ। ঠিক এমনই এক ঘটনা ঘটে রোমান সাম্রাজ্যে যখন এক ব্যক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন রোমান সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।

১৩৩ বিসিতে রোমান সাম্রাজ্যের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক ব্যক্তি ছিল যার নাম টাইবেরিয়াস গ্রাকাস। তার দাদু পাবলিয়াস আফ্রিকানাসের নাম রোমে খুব বিখ্যাত ছিল কারন পাবলিয়াস রোমান সাম্রাজ্যের হয়ে হ্যানিবেল বার্কাকে পরাজিত করেছিল। হ্যানিবেল একজন শক্তিশালী সামরিক জেনারেল ছিল কিন্তু তাকে পরাজিত করেছিল পাবলিয়াস আফ্রিকানাস। সুতরাং যথেষ্ট ধনী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান ছিল এই টাইবেরিয়াস গ্রাকাস, এমনকী উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী পরিবারেই বিবাহ করেছিল সে। একবার রোমান সাম্রাজ্যের স্পেন অভিযানের সময় অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হয় টাইবেরিয়াস গ্রাকাসকে। সেই অভিযানে টাইবেরিয়াসের নিজের এক আত্মীয় মারা যায়। সেসময় স্পেনের স্থানীয় উপজাতিদের সাথে একটি চুক্তি করে স্পেনে আটকে পড়া রোমান সেনাদের ফিরিয়ে এনেছিল টাইবেরিয়াস। রোমে সেসময় টাইবেরিয়াস যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল কিন্তু রোমের সেনেট টাইবেরিয়াসের করা চুক্তির বিরোধীতা করে চুক্তি বাতিল করে দেয়। এই ঘটনার পরেই রোমের সেনেটের সাথে শত্রুতা শুরু হয় টাইবেরিয়াসের। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে সেনেট খুব শক্তিশালী ছিল। ল্যাটিন শব্দ সেনেক্স থেকে সেনেট শব্দটি এসেছে যার অর্থ বয়স্ক মানুষ। 

খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে সেনেট প্রথম তৈরি হয় রোমে। রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক রোমুলাস সেনেট তৈরি করে, সেসময় রোমের অভিজাত বর্গের একশো জন সদস্য ছিল সেনেটের। পরবর্তীকালে সেনেটের সদস্য সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায় এবং এই সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তিনশোতে। রোমের অধিকাংশ ভূসম্পত্তি এই সেনেটের সদস্যদের হাতেই ছিল। রোমের বেশীরভাগ পরিবারের তরুনরা সেসময় রোমান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করতো। পরিবারের যুবক যখন সেনাবাহিনীতে চলে যেত তখন তাদের জমিতে চাষ করবার জন্য তেমন কেউ থাকতো না, যার জন্য জমির কর ক্রমশ বৃদ্ধি পেত এবং সেনেটের অনেক সদস্য তখন সেসব জমি দখল করে নিত। যখন কোনও যুবক সেনাবাহিনীতে কর্তব্য পালন করে ফিরে আসতো তখন চাষ করার জন্য তার কাছে জমি থাকতো না যার জন্য তাকে বাধ্য হয়ে শহরে গিয়ে কাজ করতে হত। টাইবেরিয়াস গ্রাকাস এসব লক্ষ্য করে, তিনি বুঝতে পারেন সেনেট অন্যায় করছে।

টাইবেরিয়াস তখন একটি সংগঠন বা ট্রিবিউন তৈরি করে যেখানে সে নিজে এবং আরও একজন লোক ছিল। এই সংগঠন রোমের সাধারন জনতার জন্য তৈরি করা হয় যেখানে সাধারন মানুষ এই ট্রিবিউনের জন্য দুজন লোককে নির্বাচন করে। নির্বাচিত দুজন ব্যক্তি জন প্রতিনিধি হিসাবে সেনেটে গিয়ে সাধারন জনতার দাবী রাখতো। টাইবেরিয়াস গ্রাকাস প্রথমেই সেনেটে একটি ভূমি সংস্কার আইনের প্রস্তাব রাখে। এই আইন অনুযায়ী রোমের একজন ব্যক্তি কতটা জমি রাখতে পারবে নিজের অধীনে তার একটা সীমা ঠিক করা ছিল। কিন্ত এই আইন পাশ হলে সবচেয়ে বেশী অসুবিধায় পড়ত রোমের সেনেটের সদস্যরা কারন তারা অনৈতিক ভাবে প্রচুর জমি অধিগ্রহন করে রেখেছিল। এই কারনে তারা এই আইন পাশ করতে দেয়নি। তবে দমে না গিয়ে টাইবেরিয়াস গ্রাকাস পুনরায় একটি ভিন্ন প্রস্তাব রাখে তাহল রোমান সাম্রাজ্য যখন কোনও নতুন জায়গা দখল করবে সেখানকার ভূমি সেনেট সদস্যরা প্রথমে পাবেনা বরং সাধারন রোমান সেনারা আগে সেই ভূমির অংশ পাবে। কিন্তু এখানেও সেনেট বিরোধীতা করে। তবে এবার রোমের সাধারন মানুষ টাইবেরিয়াসকে সমর্থন করে। যার জন্য সেনেটের সদস্যরা সরাসরি টাইবেরিয়াসের প্রস্তাবের বিরোধীতা না করে টাইবেরিয়াসের ট্রিবিউনের অন্য একজন জন প্রতিনিধি মার্কাস অক্টাভিয়াসকে তাদের পক্ষে নিয়ে আসে এবং মার্কাস এই বিলের বিরোধীতা করে। টাইবেরিয়াস বুঝে যায় এভাবে তার সব প্রস্তাবের বিরোধীতা হবে, সেকারনে টাইবেরিয়াস রোমের সাধারন মানুষকে নিয়ে রীতিমতো হরতাল শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যাতে দাঙ্গা শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। প্রবল জন বিক্ষোভ দেখে সেনেট বাধ্য হয়ে টাইবেরিয়াসের প্রস্তাবিত বিল পাশ করায় তবে এই বিলের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় অনেক কম অর্থ মঞ্জুর করে সেনেট যাতে জমি হস্তান্তর পুরো পক্রিয়ায় অনেক দেরী হয় এবং জনতা টাইবেরিয়াসের উপর ক্ষুব্ধ হয়। এই ঘটনার কিছুমাস পর রোমের রাজার মৃত্যু হয় এবং রাজার অধীনে থাকা বিশাল জমির মালিকানা সেনেট গ্রহন করবার চেষ্টা করে কিন্তু এখানে সেনেটকে বাধা দেয় টাইবেরিয়াস। রাজার জমি রোমের গরীব জনতা ও সেনার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়ার ঘোষনা করে টাইবেরিয়াস। সেসময় রোমে টাইবেরিয়াসের জনপ্রিয়তা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে টাইবেরিয়াস চাইলে বিশাল বিদ্রোহ করে সেনেটের পতন ঘটাতে পারতো যার কারনে সেনেটের সদস্যরা পর্যন্ত ভয় খেত টাইবেরিয়াসকে। কিন্তু ক্ষমতার লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়, ঠিক এটাই হয় টাইবেরিয়াসের সাথে। টাইবেরিয়াস রাজার বিশাল ভূসম্পত্তি জনগনের মধ্যে ভাগ করে না দিয়ে নিজের অধীনে রেখে দেয়। এই ঘটনায় সেনেটের বাকী সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয় এবং তারা জনগনকে টাইবেরিয়াসের বিরুদ্ধে বোঝাতে শুরু করে। কিন্তু জনগনের টাইবেরিয়াসের প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিল যে তারা টাইবেরিয়াসের বিরুদ্ধেই যায়নি। টাইবেরিয়াস যে ট্রিবিউন গঠন করেছিল তাতে দুজন সদস্যের কার্যকালের মেয়াদ ছিল এক বছর। টাইবেরিয়াস এক বছর পর পুনরায় নির্বাচনে দাঁড়ায় এবং এবারে টাইবেরিয়াস জানায় ট্রিবিউনের নির্বাচনে শুধু একজনই নির্বাচিত হতে পারবে দুজন নয়। টাইবেরিয়াস আগেই মার্কাস অক্টাভিয়াসকে ট্রিবিউন থেকে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগে বের করে দিয়েছিল। ইসরায়েলে যেমন নিয়ম আছে প্রত্যেক নাগরিককে বাধ্যতা মূলক ভাবে কয়েকবছর সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হবে, ঠিক তেমনি সেসময় রোমে নিয়ম ছিল প্রত্যেক পুরুষকে সেনাবাহিনীতে কিছু সময়ের জন্য কাজ করতে হবে। 

টাইবেরিয়াস নির্বাচনের প্রচারে ঘোষনা করে সে আবার ক্ষমতায় এলে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক কাজ করার সময়কালকে কমিয়ে আনবে এবং প্রত্যেক সেনাকে বিনামূল্যে জমি দেওয়া হবে। টাইবেরিয়াসের এই প্রচারের পর তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। সেনেটাররা বুঝতে পারে টাইবেরিয়াসকে এবার থামাতে হবে। নির্বাচনের দিন টাইবেরিয়াসকে সেনেটাররা গোপনে হত্যা করে এবং তার মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয় যাতে কেউ জানতে না পারে। কিন্তু টাইবেরিয়াসকে হত্যার কথা সমগ্র রোমে ছড়িয়ে পড়ে, পুরো রোমে রীতিমতো দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। সেনেটাররা এতটাই ভয় খেয়ে যায় যে তারা উন্মত্ত জনতাকে শান্ত করতে টাইবেরিয়াস গ্রাকাস যে সব আইন আনার প্রস্তাব দিয়েছিল সেই সমস্ত বিল পাশ করায় তারা, যার মধ্যে ভূমি সংস্থার বিলও ছিল যাতে একজন রোমান ব্যক্তির জমির পরিমান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। টাইবেরিয়াস গ্রাকাস বেঁচে থাকতে যা করতে পারেনি, তার মৃত্যুর পর সেসবই ধীরে ধীরে সম্পূর্ন হয়। এই সমস্ত আইনের কারনে ধীরে ধীরে সেনেটের ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে রোমে, কারন এইসব বিলের মূল লক্ষ্যই ছিল সেনেটের ক্ষমতা কমানো ও প্রশাসনে জনতার ক্ষমতা বৃদ্ধি। টাইবেরিয়াস গ্রাকাসের মৃত্যুর কারনে পরবর্তী একশো বছর রোমে কোনও স্থায়ী সরকার ছিলনা। এরপর জুলিয়াস সিজার নামে এক ব্যক্তি জনগনের সাহায্যে সেনেটকে ভেঙে দেয় এবং নিজেকে রোমের শাসক ঘোষনা করে, রোমে শুরু হয় জুলিয়াস সিজারের শাসন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.