কলকাতার হলদিয়া বন্দরে কেন ব্যবসা করতে চাইছে নেপাল?
ভারত ও নেপাল সীমান্ত সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ বলা হয়। নেপাল ও ভারত সীমান্ত ১৭৭০ কিলোমিটার লম্বা যা ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ও নেপালের মধ্যে সুগোলি চুক্তি অনুযায়ী ঠিক করা হয়েছিল। লিপুলেখ থেকে শুরু হয়ে এউ সীমান্ত সারদা নদী হয়ে এগিয়ে গেছে। উত্তরাখন্ডের পিথোরাগড়, চম্পাবত এবং উধমসিং নগর জেলার সাথে নেপালের সুদুর পশ্চিম প্রদেশের মধ্যে ২৭৫ কিলোমিটার জলসীমান্ত রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ও নেপালের লুম্বিনী প্রদেশের মধ্যে ৫৫১ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। এরপর বিহারের পশ্চিম চম্পারন, পূর্ব চম্পারন, মধুবনি, সীতামারি, কিষানগন্জ, সুপোল ও আরারিয়া জেলার সাথে নেপালের লুম্বিনী, গান্ডকী, বাগমতী, মাধেশ প্রদেশ ও প্রদেশ নং ১ এর মধ্যে ৭২৬ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের উত্তর দিনাজপুর ও দার্জিলিং এর সাথে নেপালের ১০০ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে এবং সিকিমের সাথে ৯৯ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। নেপাল ও ভারতের এই সীমান্ত পুরো মুক্ত। দুই দেশের লোকেদেরই দুই দেশে যেতে কোনও ভিসা পাসপোর্ট লাগে না। তবে নেপালের সাথে সীমান্ত নিয়ে ভারতের দুটি জায়গায় বিবাদ রয়েছে। প্রথমটি উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলায় কালপানি অঞ্চল নিয়ে। সুগোলি চুক্তি অনুযায়ী এখানের কালি নদী দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারন করেছে, এই নিয়েই ঝামেলা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সুস্তা অন্চল। বিহারের পশ্চিম চম্পারন জেলায় গন্ডকী নদীর দিক পরিবর্তনে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে তবে এগুলো কোনও বড় সমস্যা নয়। নেপালের ৬০ শতাংশ বানিজ্য হয় ভারতের হলদিয়া ও বিশাখাপত্তনম বন্দর দিয়ে। সম্প্রতি ভারত ও নেপালের মধ্যে কাশী ও গন্ডকী নদী নিয়ে আলোচনা চলছে কারন এই নদীপথ ব্যাবহার করে নেপাল হলদিয়া বন্দরে তার রপ্তানি দ্রব্য পৌঁছাতে চাইছে।
নেপালের মতন আরও একটি শান্তিপূর্ণ সীমান্ত হচ্ছে ভারত ভুটান সীমান্ত। ভুটানের শুধু ভারত ও চীনের সাথেই সীমানা আছে। তবে চীনের সাথে সীমন্ত নিয়ে ঝামেলার জন্য একমাত্র ভারতের মাধ্যমেই ভুটান বাকী বিশ্বের সাথে যুক্ত। ভারত ও ভুটানের মধ্যে ৬৯৯ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত আছে। সিকিমে ভারত ও ভুটানের ৩২ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। পশ্চিমবঙ্গের কালিংপং, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার সাথে ভুটানের ১৮৩ কিলোমিটার লম্বা সীমনা আছে। আলিপুরদুয়ারের জৈনগাও থেকে দক্ষিন পশ্চিম ভুটানের ফুন্টশোলিং পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা আছে। এখান দিয়েই ভারত ও ভুটানের বেশীরভাগ বানিজ্য হয়। আসামের কোকড়াঝাড়, বক্সা, চিরাংক এবং উদালকুড়ি জেলার সাথে ভুটানের ২৬৭ কিলোমিটার সীমনা আছে। আসামের এইসব জেলা বড়োল্যান্ড অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, যার সাথে ঐতিহাসিক ভাবেই ভুটানের সুসম্পর্ক আছে। অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং এবং পশ্চিম কামিং জেলার সাথেও ভুটানের সীমান্ত রয়েছে। এখানে তাওয়াংচু এবং নামজাংচু নদীর সঙ্গম থেকে উত্তরদিক পর্যন্ত ভারত ভুটান সীমান্ত রয়েছে। এখানে ভুটানের ২১৭ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে যা বেশীরভাগই বন জঙ্গল ও পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। নেপালের মত ভুটান ভারত সীমান্তও মুক্ত, মানে ভিসা পাসপোর্ট লাগে না।
ভারতের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪০৯৬ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত আছে যা বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত। বাংলাদেশের রাজসাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিং, খুলনার সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরামের সীমান্ত রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল নিয়ে আগে সমস্যা ছিল। ভারতে ৫১ টি এবং বাংলাদেশে ১১১ টি ছিটমহল ছিল। দীর্ঘদিন নিয়ে এসব অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ঝামেলা ছিল। এখানকার লোকেরা ভারত বা বাংলাদেশের কোন দেশেরই নাগরিকত্ব পাচ্ছিলনা। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের মে মাসে এই সমস্যার সমাধান হয়। ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত শুরু হয় সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ অরন্যে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা এবং বাংলাদেশের খুলনা জেলার হুগলী, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর মিলনস্থলে ১০০০০ স্কোয়ার কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এই সুন্দরবন। ভারতের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলের তুলনায় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে জনঘনত্ব অনেক বেশী। কলকাতা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে পেট্রোপোল সীমান্ত এশিয়ার অন্যতম ব্যাস্ততম সীমান্ত। এখান দিয়েই ভারত বাংলাদেশের বেশীরভাগ বানিজ্য হয়। পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের প্রায় ২২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিন দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের সাথে বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে। এছাড়াও ৬০০ কিলোমিটার নদীপথে সীমানও রয়েছে। আসামের সাথে বাংলাদেশের সীমান দুটি সেক্টরে রয়েছে। ধুবড়ি ও দক্ষিন সালমারা মানকাচর জেলায় ১৩৪ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে, যার মধ্যে ২০ কিলোমিটার ব্রহ্মপুত্র নদীর সাথে রয়েছে এবং কাচার ও করিমগঞ্জ জেলার সাথে ১৪৭ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহের সাথে ভারতের মেঘালয়ের ৪৪৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত আছে বাংলাদেশের। ত্রিপুরার মোটামুটি সব জেলার সাথেই বাংলাদেশের সীমান্ত আছে। মিজোরাম ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩১৮ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। তবে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত বিশেষকরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত পাহাড়া দেওয়া সবচেয়ে বেশী কঠিন বিএসএফের। কারন এই অঞ্চলে জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশী। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া থেকে ১০০ মিটার দূরে জনবসতি শুরু হয় কিন্তু ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে একেবারে গায়ে গায়ে সব গ্রাম, জনবসতি রয়েছে। একজন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ প্রচুর হয়, চোরাকারবারিদেরও রাজত্ব এখানে। ১৯৯৯ এ কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে প্রথম বাস সার্ভিস শুরু হয় এবং ২০০১ সালে ঢাকা আগরতলার মধ্যে আরও একটি বাস সার্ভিস শুরু হয়। দেশভাগের আগে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে অনেক রেলওয়ে লাইন ছিল কিন্তু এখন তিনটি ট্রেন রয়েছে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে। কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস, কলকাতা ও খুলনার মধ্যে বন্ধন এক্সপ্রেস এবং জলপাইগুড়ি ও ঢাকার মধ্যে মিতালি এক্সপ্রেস।
মায়ামারের সাথেও ভারতের সীমানা রয়েছে। ইন্দো মায়ানমার সীমান্ত ১৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা। ভারতের অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরের সাথে মায়ানমারের কাচিন, চিন ও সাগিং প্রদেশের সীমানা রয়েছে। ইন্দো মায়ানমার সীমান্ত খুবই বিপদজনক কারন এখানে প্রচুর জঙ্গল রয়েছে। এই এলাকায় প্রায়ই চীন সমর্থিত কীছু উগ্রবাদী সংস্থা ঝামেলা করে। এই এলাকা দিয়ে ড্রাগস পাচার হয়। তাছাড়া মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের লোকেরা এই অঞ্চলের মাধ্যমে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। যার জন্য ভারত ও মায়ানমারের উভয় দেশের সেনাবাহিনীই এই অঞ্চলে যৌথভাবে নজর রাখে। কুটনৈতিক ভাবে মায়ানমারের সাথে ভারতের এতটাই ভাল সম্পর্ক রয়েছে যে ভারতীয় সেনা মায়ানমারে ঢুকে জঙ্গীদের হত্যা করে আসে। ইন্দো মায়ানমার সীমান্তে অনেক উপজাতি সম্প্রদায় রয়েছে যেমন নাগা, চীন, কুকি, মিজো। দুই দেশের আইন অনুযায়ী সীমান্তের কাছাকাছি উপজাতিরা সীমান্তের দুই দিকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত কোন ভিসা, পাসপোর্ট ছাড়াই যেতে পারবে, একে ফ্রী মুভমেন্ট বলা হয়।জানেন কী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভারতবর্ষেরই? দ্বিতীয় খণ্ড