পৃথিবী

আজও রেষ রয়ে রয়ে গেছে। কেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব গোটা পৃথিবীতে রয়ে গেছে?

বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ টপিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে মারক দুই যুদ্ধ হিসাবেই পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় দেড় কোটির ও বেশী প্রায় এক কোটি সত্তর লক্ষ মানুষ মারা গেছিল যার মধ্যে প্রায় ষাঠ লক্ষই ছিল সাধারণ মানুষ। তখনকার দিনে এখনের মত এত বিশাল জনসংখ্যা ছিল না নাহলে আরও বেশী মানুষ মারা যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কে বলা হয় দি এন্ড অফ অল ওয়ার বা সব যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলেছিল এবং সব চুক্তি মিলিয়ে আরও এক বছর অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ প্রায় পাঁচ বছর হয়েছিল বলাই যায়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কেই আজ আলোচনা করব।

১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যা শেষ হয়েছিল ১৯১৮ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দুটি পক্ষ ছিল অ্যালায়েড ফোর্স ও সেন্ট্রাল ফোর্স। অ্যালায়েড ফোর্সে ছিল ব্রিটেন, ইটালি, জাপান, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ভারত, সার্বিয়া সহ আরও অনেক দেশ যাদের মধ্যে মূলত চারটি সুপার পাওয়ার ছিল আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স তবে ১৯১৭ সালে রাশিয়া যুদ্ধ থেকে বেড়িয়ে যায় তার পেছনেও গল্প ছিল পরে বলব। সেন্ট্রাল ফোর্সে ছিল জার্মানি, তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য, বুলগেরিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারত সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিল। ভারতের প্রায় ১৩ লাখ সেনা লড়াই করেছিল যে যুদ্ধে মোট প্রায় ষাঠ লাখ সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয় এবং ৭০ লাখ সেনা আহত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটেন নিজে খুব ছোট্ট দেশ ছিল কিন্তু সেসময় গোটা বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃত ছিল। যদি ১৯১৪ সালে ইউরোপের ম্যাপ দেখেন দেখবেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া – হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও অটোম্যান পুরো মধ্য ইউরোপীয়ান দেশ ছিল, বিশেষ করে জার্মানির সমস্যা বেশী ছিল কারন জার্মানির পূর্বদিকে ছিল রাশিয়া ও পশ্চিমদিকে ছিল ফ্রান্স সুতরাং জার্মানিকে দুই দিকেই যুদ্ধ করতে হচ্ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই অস্ট্রিয়া – হাঙ্গেরি কে ভেঙ্গে দুটি দেশ তৈরি করে দেওয়া হয় অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে অনেক কারন ছিল, প্রথমত ১৮৭১ সাল থেকে জার্মানির সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হওয়া। এই সময় অটোমান সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৪ শতকে স্থাপিত হওয়া অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল। এর আগে ছিল রোমান সাম্রাজ্য। কিন্তু বিংশ শতাব্দী আসতে আসতে অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। ইউরোপের বলকান অঞ্চল যার মধ্যে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া যারা অটোমানের অধীনে ছিল তারা বিদ্রোহ ঘোষনা করে। এই সময়ে ইউরোপ জুড়ে পাওয়ার ব্যালেন্স ও অস্ত্র প্রতিযোগীতা শুরু হয়। পাওয়ার ব্যালেন্স মানে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা যেমন ফরাসি সম্রাট ১৭৯৯ সালে পুরো ফ্রান্সের ক্ষমতা পেয়ে যায় তখন তাকে আটকাবার জন্য ব্রিটেন সমস্ত ইউরোপীয় দেশের সাথে মিলে যুদ্ধ করে। 

ইউরোপ জুড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান, রাশিয়ার মত বড় বড় সাম্রাজ্য গুলোর মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগীতা শুরু হয়। সেইসময় ইতিমধ্যে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে যায় যার জন্য সব দেশ নতুন নতুন অস্ত্র বানাতে তৈরি করে। দ্বিতীয়ত এশিয়া জুড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্সের সাম্রাজ্য ছিল এবার ইউরোপীয়ান শক্তি গুলোর নজরে ছিল আফ্রিকা। আফ্রিকায় কে কত এলাকা দখল করতে পারবে সেই নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ বাকী দেশ গুলো। যেমন রাশিয়া চাইছিল ব্ল্যাক সী তীরবর্তী এলাকা গুলো দখল করতে কারন সেখান দিয়ে তাদের বানিজ্য হত কিন্তু এই এলাকা গুলো আবার অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। 

তৃতীয়ত এই সময় ইউরোপ জুড়ে গোপন বন্ধুত্ব তৈরি হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ট্রিপিল এন্টাত ও ট্রিপিল এলায়েন্স। ট্রিপিল এন্টাতে যুক্ত ছিল রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং ট্রিপল অ্যালায়েন্সে যুক্ত ছিল ইটালি, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া – হাঙ্গেরি। ইটালি প্রথমে সেন্ট্রাল ফোর্সেই ছিল কিন্তু ১৯১৫ সালে অ্যালায়েড ফোর্সে যোগদান করে। এই ইটালিই আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানের সাথে অ্যালায়েড ফোর্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এই সব জোট তৈরি হয়েছিল যদি কোনও দেশ কাউকে আক্রমণ করে তাহলে অন্য দেশগুলো তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। স্পেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ার মত দেশগুলো প্রথমে নিরপেক্ষ ছিল কিন্তু পরে এরাও যুদ্ধে যোগ দেয়। চতুর্থত আগেই বলেছি এইসময় অটোমান সাম্রাজ্যেে ভাঙন শুরু হয়। পুরো বলকান এলাকা রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রীস অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এদের সাহায্য করে রাশিয়া। রাশিয়া ও অটোমানদের শত্রুতা বহু পুরোনো, অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে উভয়ের মধ্যে। 

১৯১২ সাল থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যে দুটি বলকান যুদ্ধ হয়। প্রথম বলকান যুদ্ধ হয় ছয় মাসের এবং দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ হয় এক মাসের। বলকান যুদ্ধে পুরো বলকান এলাকা অটোমানদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। এইসময় একটি ছোট দেশ বসিনিয়া কে নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। সেই সময় বসিনিয়া অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অধীনে যায়। কিন্তু বসিনিয়ার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির উপর। এবার বলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হঠাৎ কী করে শুরু হল। এই সময় অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির যুবরাজ আর্খ ডিউক ফারদিনান্দ বসিনিয়ার রাজধানী সারাজেভো যায়। ডিউকের লোকেরা তাকে বারন করেছিল বসনিয়া যেতে কারন সেখানে ঝামেলা হচ্ছিল। ডিউক ফারদিনান্দ কোনও কথা না শুনেই বসনিয়া চলে আসেন। বসনিয়াতে তখন ব্ল্যাক হ্যান্ড নামে একটি সংগঠন বসনিয়ার স্বাধীনতার জন্য দাবী করছিল। এরা অস্ট্রিয়া – হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ছিল। ব্ল্যাক হ্যান্ড কে সমর্থন করত সার্বিয়া এবং সার্বিয়া কে সাপোর্ট করত রাশিয়া কারন সার্বিয়া তে স্লাভিল জাতির লোক বসবাস করে এবং রাশিয়াতেও স্লাভিক আছে, এছাড়াও অস্ট্রিয়া – হাঙ্গেরি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের বন্ধু, যারা আবার রাশিয়ার শত্রু। সুতরাং শত্রুর শত্রু আমার মিত্র এই নীতি অনুযায়ী রাশিয়া সার্বিয়া সহ বসিনিয়াকে সাহায্য করত। 

১৯১৪ সালের ২৮ জুন আর্খ ডিউক ফারদিনান্দ বসিনিয়ার রাজধানী সারাজোভাতে পৌছালে প্রথমে তাদের উপর বোম্ব অ্যাটাক হয় কিন্তু কোনওরকমে তারা বেঁচে যায় কিন্তু এরপরেই ব্ল্যাক হ্যান্ডের এক সদস্য ১৯ বছর বয়সী গ্যাব্রিলো প্রিন্সেপ ডিউক ফারদিনান্দ ও তার স্ত্রী সোফিকে হত্যা করে দেয়। এই ঘটনা তৎকালীন সময়ে বিশ্বরাজনীতে বড় পরিবর্তন তৈরি করে দেয়। কারন এই ঘটনায় অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির ব্যাপক বদনাম হয়। অস্ট্রিয়া সাহায্য চায় জার্মানির কারন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও ইটালির মধ্যে ট্রিপল অ্যালায়েন্স ছিল অর্থাৎ কেউ কাউকে আক্রমন করলে অন্য বাকী দেশগুলো তাদের সাহায্য করবে। সেইসময় জার্মানি বিশাল শক্তিশালী দেশ ছিল। জার্মানির রাজা কাইজার উইলিয়াম ২ ১৯১৪ সালের ৫ জুলাই অস্ট্রিয়াকে পূর্ন সমর্থন দেয় এবং সেনা দেয়। যার বলে অস্ট্রিয়া সার্বিয়া কে স্যারেন্ডারের আদেশ দেয় এবং পুরো ঘটনায় জড়িত লোকেদের শাস্তির ব্যাবস্থা করার আদেশ দেয়। সার্বিয়া অসম্মত হয়। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়া কে আক্রমন করে। এরপর সার্বিয়া সাহায্য চেয়ে বসে রাশিয়ার কাছে। রাশিয়া সার্বিয়া কে সমর্থন জানায় কারন রাশিয়া চাইতই যাতে অটোম্যান এলাকার নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্ল্যাক সীর তীরবর্তী এলাকা দখল করা যায়। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথমে জড়ায় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি বনাম রাশিয়া ও সার্বিয়া। এরপর একে একে সব দেশ জড়াবে বলছি। এটা তো সবে জুলাই। নভেম্বর আসতে আসতে গোটা বিশ্ব এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

এরপর যুদ্ধে জার্মানি একের পর এক ভুল করতে থাকে। রাশিয়াকে যুদ্ধে নামতে দেখে জার্মানি ভেবে বসে ফ্রান্স ও হয়ত তাদের আক্রমণ করে বসবে কারন রাশিয়া, ফ্রান্সোর মধ্যে জোট ছিল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী ফ্রান্সের ইচ্ছেই ছিলনা যুদ্ধ করবার কিন্ত জার্মানির ভুলে ফ্রান্স জড়িয়ে পড়ে। জার্মানির ফিল্ড মার্শাল ভন আলফ্রেড ভন সেলিফেন ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনা বানায় তার পরিকল্পনা ছিল ফ্রান্স যুদ্ধে জড়াবার আগেই ফ্রান্স দখল করে নেওয়া। একে সেলিফেন প্ল্যান বলা হত। জার্মানি ফ্রান্সকে আক্রমণের আগে ২ আগস্ট বেলজিয়াম কে বলে তাদের সেনাবাহিনীর যাবার পথ দিতে কিন্তু বেলজিয়াম মানা করে দেয় যার জন্য ১৪ আগস্ট জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করে বসে। তখন ফ্রান্স জার্মানির পরিকল্পনা সম্পর্কে বুঝতে পারে ফলে ফ্রান্স যুদ্ধ শুরু করে দেয়। এদিকে বেলজিয়ামের সাথে ব্রিটেনের জোট ছিল ফলে বেলজিয়ামকে বাঁচাতে ব্রিটেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ২ নভেম্বর আসতে আসতে অটোমান সাম্রাজ্য ও যুদ্ধে যোগ দেয়৷ ইটালি কিন্ত এখনও নিরপেক্ষ ছিল। সেন্ট্রাল ফোর্সের মিত্র হয়েও ইটালি তখনও যুদ্ধে যোগ দেয় নি। ২৮ জুলাই যুদ্ধ শুরু হয়ে ২ নভেম্বর আসতে আসতে রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, সার্বিয়া বনাম অটোমান সাম্রাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ এমন ভয়ানক শুরু হয় যে উভয় পক্ষের শুধু মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউই জিতছে না। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় একটা নতুন রণনীতি দেখা যায় গ্রাউন্ডে প্রায় ২-৩ কিলোমিটার লম্বা লম্বা টানেলের মত তৈরি যাকে ট্রেঞ্চ বলে। যত সৈন্য লড়াই করত যুদ্ধের সময় তারা এখানেই থাকত। কারন টানেলের উপর উঠলেই শত্রুর মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এরকম প্রচুর টানেল তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধের প্রথমে জার্মানি এক তরফা জিতছিল। জার্মানি একের পর এক জায়গা দখল করে বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্সের দিকে এগিয়ে যচ্ছিল। ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ব্যাটেল অফ মারনে হয় যেখানে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সেনার সাথে জার্মানির সেনাবাহিনীর বিশাল লড়াই হয়। কারন ততদিনে ফ্রান্স তাদের দশ লক্ষ সেনা মোতায়েন করে ফেলেছিল এবং ব্রিটেন তাদের সাথ দেয়। এইসময় জার্মানি রাশিয়ার পশ্চিম ভাগ দখল করে নেয়। রাশিয়ার ভেতর এই সময় জার নিকোলাস ২ এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চলছিল। লোক চাইছিল যাতে রাশিয়া যুদ্ধে যোগ না দেয় কারন রাশিয়ার ভেতর ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক ও খাদ্য সমস্যায় জর্জরিত হয়ে গেছিল। যার জন্য ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ঘটে এবং লেলিন ক্ষমতায় আসে। লেলিন এসেই রাশিয়াকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বাইরে নিয়ে আসে। এই লেলিনকে সাহায্য করত জার্মানি কারন জার্মানি চাইছিল রাশিয়া যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেড়িয়ে যায়। রাশিয়াই সর্ব প্রথম সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯১৭ সালে রাশিয়াই প্রথম দেশ হিসাবে বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেড়িয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথম থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল জার্মানি কিন্তু যখন আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয় তখন পরিস্থিতি বদলে যায়। আমেরিকা প্রথমে যুদ্ধে যোগ দেয়নি কারন বরাবর আমেরিকার নীতি থাকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে উভয় দিকেই অস্ত্র বিক্রি করে প্রচুর পয়সা কামানো। আমেরিকা এখনও তাই করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আমেরিকা তাই করেছিল।

১৯১৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের অনুরোধ সত্বেও আমেরিকা যুদ্ধে আসে নি। কিন্তু এই সময় জার্মানির সাবমেরিন যাদের ইউবোট বলা হত তারা আমেরিকার বানিজ্যিক জাহাজে লুকিয়ে আক্রমন করত এবং ডুবিয়ে দিত এতে অনেক আমেরিকান মারা যেত। ১৯১৭ সালে এমনই এক আমেরিকান জাহাজে জার্মান ইউবোট আক্রমণ করে জাহাজটি নিউ ইয়র্ক হয়ে লিভারপুল যাচ্ছিল। এতে ১২৮ জন আমেরিকান নাগরিক মারা যায়। জার্মানি এবার বুঝতে পারে অনেক বেশী হয়ে যাচ্ছে কারন আমেরিকা একবার যুদ্ধে এলে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। এইজন্য জার্মানির রাজা কাইজার উইলিয়াম ২ ততকালীন রাষ্ট্রপতি হুড্রো উইলসন কে চিঠি লিখে ক্ষমা চায় কিন্তু এরপরে আবার ও  আমেরিকার জাহাজ ডুবিয়ে দেয় জার্মান ইউবোট। এবার জার্মানি একটা পরিকল্পনা করে তারা ভাবে আমেরিকা যুদ্ধে জড়াবে না তখনই যখন আমেরিকা নিজে অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাস্ত থাকবে। এই জন্য জার্মানি গোপনে চিঠি লেখে আমেরিকার শত্রু দেশ মেক্সিকো কে, যে আমেরিকা আক্রমণের জন্য। আমেরিকা ও মেক্সিকোর শত্রুতা অনেক পুরোনো। মেক্সিকান যুদ্ধের পর আমেরিকা মক্সিকো থেকে ক্যালিফোরনিয়া, নেভেদা, টেক্সাস দখল করে নেয়। ১৯১০ -২০ পর্যন্ত মেক্সিকো তে চলছিল গৃহযুদ্ধ।

জার্মানির মেসেজ পাবার আগেই সেই মেসেজ ডিকোড করে ফেলে আমেরিকা এবং জার্মানির পরিকল্পনা ধরে ফেলে। যারজন্য হুড্রো উইলসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য  ১৯১৭ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্রের প্যাকেজ নেয় এবং আমেরিকা যুদ্ধে অংশ নেয়। আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেবার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। মোটামুটি এক বছরের মধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনা জার্মানির অবস্থা খারাপ করে দেয়। সমস্ত লড়াইয়ে অ্যালায়েড ফোর্সের কাছে হেরে যায় জার্মানি। দ্বিতীয় মারানের যুদ্ধে ৮৫,০০০ আমেরিকান সেনা, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সেনা যৌথভাবে মাত্র তিনদিনে জার্মানি কে পরাজিত করে বেলজিয়াম ছাড়া করায়। ১৯১৮ সালের নভেম্বর আসতে আসতে অবশেষে সেন্ট্রাল ফোর্সের পুরোপুরি পরাজয় ঘটে। শেষ হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই লুকানো ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ।

একাধিক রিসার্চ পেপার এবং বিশ্লেষণের ভিত্তির উপর আমাদের এই লেখা। একাধিক মতামত রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যদিও।

Leave a Reply

Your email address will not be published.