চীনের দেশীয় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কারনে কেন চিন্তা বাড়ছে ভারতবর্ষের?
রাজেশ রায় :— প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে যুদ্ধের কলা কৌশল বদলে গেছে। বর্তমানে পঞ্চম প্রজন্মের হাইব্রিড যুদ্ধে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যে কোনও দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অ্যাসেট। যে দেশের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যত শক্তিশালী হবে সেই দেশ শত্রুর হাত থেকে ততবেশী সুরক্ষিত থাকবে। এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম শত্রুর যুদ্ধবিমান, মিসাইল, ড্রোনের হাত থেকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়। এই মহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু দেশ হচ্ছে পাকিস্তান ও চীন। পাকিস্তানের থেকেও চীনের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রস্তত রাখাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শত্রুর মোকাবিলা করবার আগে তার ক্ষমতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে ভালভাবে জানা দরকার। আজ চীনের এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ও তার দুর্বলতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মূলত তিন ধরনের প্রধান এয়ারডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে চীনের এফ এম-৩০০০, এইচ কিউ -৯ এবং এইচ কিউ – ২২. একে একে জানা যাক। সম্প্রতি রাশিয়া থেকে এস ৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছো চীন তবে এই সিস্টেম ভারতেরও আছে। তাই আজ চীনের নিজস্ব তৈরি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সম্পর্কেই বলব।
এফ এম ৩০০০ :—- ২০১৪ সালে ১২ নভেম্বর চীনের দশম আন্তর্জাতিক এরোস্পেস এক্সপো তে জুহাই এয়ার শো তে এই সিস্টেম প্রথম জনসমক্ষে আনে চীন। মিডিয়াম ও শর্ট রেঞ্জের এই এয়ারডিফেন্স সিস্টেম কে রাশিয়ার ভিটয়াজ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের নকল বলা হয়। এটি একসাথে ৩২ টি টার্গেটকে ডিটেক্ট করতে সক্ষম এবং ৮ টি টার্গেটকে ধ্বংস করতে সক্ষম। টার্গেটকে ডিটেক্ট করার চার সেকেন্ডের মধ্যে এটি অ্যাক্টিভ হয়ে যায়। একটি ৬×৬ ট্রাকে আটটি মিসাইল টিউব থাকে। মোটামুটি ভাবে যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে এর রেঞ্জ ৩০ কিলোমিটার এবং মিসাইলের ক্ষেত্রে এর রেঞ্জ ২০ কিলোমিটার বলা হচ্ছে। ভূমির পাশাপাশি চাইনিজ নেভিও এই সিস্টেম ব্যবহার করে। চীনের টাইপ ০৫২ ডি ডেস্ট্রয়ারে এই সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে। তবে এফ এম ৩০০০ এর রেঞ্জ খুবই কম যার জন্য একে যুদ্ধ জাহাজে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। টাইপ ০৫২ ডেস্ট্রয়ারে যে সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে এফ এম ৩০০০ এন, এটি নেভির জন্য তৈরি করা হয়েছে যা ডেস্ট্রয়ারের এইচ টি-১ ই ইউনিভার্সাল ভারটিক্যাল লঞ্চ সিস্টেমে ইনস্টল করা হয়েছে। এফ এম ৩০০০ এন এর রেঞ্জ ৪৫ কিলোমিটার। এফ এম ৩০০০ যেখানে আটটি টার্গেট কে ধ্বংস করতে সক্ষম সেখানে এফ এম ৩০০ এন ১৬ টি টার্গেট কে ধ্বংস করতে সক্ষম।
এইচ কিউ ২২ :— দ্বিতীয় প্রজন্মের এইচ কিউ ১২ মিসাইল থেকে এইচ কিউ ২২ তৈরি করা হয়েছে। চাইনিজ এরোস্পেসের জিয়ানগানান স্পেস ইন্ডাস্ট্রি তে এটি তৈরি করেছে। ২০১৬ এর এক এয়ারশো তে চীন এটি জন সমক্ষে আনে। এর এক্সপোর্ট ভার্সনের নাম এফ কে -৩. আমেরিকার প্যাট্রিয়ট ও রাশিয়ার এস-৩০০ এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের সমতুল্য বলা হয় একে যদিও এস -৩০০ এর তুলনায় এর রেঞ্জ কম। চীন দাবি করে এই সিস্টেম নাকী স্টেলথ টার্গেটকেও ধ্বংস করতে সক্ষম তবে চীন দাবি করলেও এর টেকনোলজি সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে তৈরি চীনের এইচ কিউ ২ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে রিপ্লেস করবার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। এইচ কিউ ২২ এর রেঞ্জ ১৭০ কিলোমিটার, এটি ক্রুজ মিসাইল, ব্যালেস্টিক মিসাইল, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, কমব্যাট ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি একসাথে বারোটি মিসাইল লঞ্চ করতে সক্ষম যা ছয়টি টার্গেটকে এক সাথে ধ্বংস করতে সক্ষম। তবে মাল্টিপল ফায়ার মোডে ৩৬ টি টার্গেটের জন্য ৭২ টি মিসাইল লঞ্চ করতে সক্ষম। এর এক্সপোর্ট ভার্সন এফকে-৩ এর রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার যা আসল ভার্সন থেকে ২০ কিলোমিটার কম। সাধারনত এইচ কিউ ২২ এর গতি ম্যাক ৬, তবে এর দুটি নতুন ভার্সনের উপর কাজ চলছে। এইচ কিউ ২২ বি, যার রেঞ্জ বেড়ে ২০০ কিলোমিটার হবে এবং গতি হবে ৮ ম্যাক, এটি অলরেডি ২০২১ এ চূনের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষা মূলক ভাবে এবং এইচ কিউ ২২ সি, যার রেঞ্জ বেড়ে হবে ২৫০ কিলোমিটার এবং গতি হবে ১০ ম্যাক। ২০২০ সালে সার্বিয়া প্রথম কোনও ইউরোপীয়ান দেশ যারা এই সিস্টেম কেনে। গত ৯ এপ্রিল চীনের একটি জিয়ান ওয়াই ২০ ট্রান্সপোর্ট বিমান এই সিস্টেম সার্বিয়ায় পৌঁছে দেয় এবং ৩০ এপ্রিল সার্বিয়ান মিলিটারি এর ছবি প্রকাশ করে। চীন ভারতের লাদাখের কাছে সীমান্তে এই সিস্টেম মোতায়েন করেছে। সার্বিয়া ছাড়াও থাইল্যান্ড, মায়ানমার, তুর্কমেনিস্তান এই সিস্টেম ব্যবহার করে।
এইচ কিউ ৯ :— চীনের নিজের তৈরি সবচেয়ে অ্যাডভান্সড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হল এই এইচ কিউ ৯. চীনের দাবি অনুযায়ী লং রেঞ্জ সিস্টেম অ্যান্টি ব্যালেস্টিক ও অ্যান্টি স্যাটেলাইট রোলেও ব্যাবহার করা সম্ভব। এটি তৈরি করেছে চাইনিজ এরোস্পেস সায়েন্স এবং ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন। তবে এটা মোটেও চীনের নিজস্ব প্রযুক্তি নয়। রাশিয়ান এস-৩০০ এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের নকল হচ্ছে এটি। ২০০১ সালে সর্বপ্রথম এটি সার্ভিসে আনে চীন। এর গতি ৪ ম্যাক। মোটামুটি ১২০-২৫০ কিলোমিটার অবধি এর রেঞ্জ। এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের নেশ কয়েকটি ভার্সন রয়েছে। যেমন এইচ এইচ কিউ ৯ বলে এর একটি নেভাল ভার্সন আছে। এইচ কিউ ৯ বি নামে ২০০৬ সালে আরও আপগ্রেডেড একটি ভার্সন তৈরি করা হয়েছে যার রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার। এফ কে -২০০০ নামে এর একটি অ্যান্টি রেডিয়েশন ভার্সন আছে। এইচ কিউ ১৯ ভার্সনটিকে অ্যান্টি ব্যালেস্টিক ভার্সন বলা হয় যার রেঞ্জ ১০০০-৩০০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এর এক্সপোর্ট ভার্সনের নাম এফ ডি ২০০০ যার রেঞ্জ ১২৫ কিলোমিটার। চীন ছাড়াও পাকিস্তান, মরোক্ক, তুর্কমিনিস্তান, উজবেকিস্তান ও আলজেরিয়া এই সিস্টেম ব্যবহার করে।
বেলুন দেখেছেন তো ওপর থেকে ফুলে ফেঁপে থাকে কিন্তু ভিতরে কীছুই থাকে না। ঠিক তেমন অবস্থা চীনের এসব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের। একটা ঘটনা বলি গত ৯ মার্চ ভারত থেকে একটি মিসাইল গতিপথ হারিয়ে হঠাৎই পাকিস্তানের ভিতর ঢুকে যায়। পরে ভারত জানায় এটি ব্রাহ্মস মিসাইল ছিল যা ম্যাক ৩ গতিতে পাকিস্তানে যায়। এটি শুধু পাকিস্তানে যায় তা নয় পাকিস্তানের ভিতর ১২৩ কিলোমিটার ঢুকে ধ্বংস হয়ে যায়। একটা দেশের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কতটা দুর্বল হলে এমন হতে পারে তা যাস্ট কল্পনা করুন। যদি পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স ইউনিটের কথা বলা হয় তাহলে এটা দেখা যাবে পাকিস্তানের সমস্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম চীনের। পাকিস্তান ২০১৫ সালে এইচ কিউ ৯ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনে ৪ ব্যাটারি, আরও ৬ ব্যাটারি অর্ডারে আছে। অর্থাৎ নিকট ভবিষ্যতে পাকিস্তানের কাছে শুধু ১০ ব্যাটারি এইচ কিউ ৯ থাকবে। এছাড়াও পাকিস্তানের কাছে ২৪ ব্যাটারি এইচ কিউ ১৬ মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স
সিস্টেম যার রেঞ্জ ৪০ কিলোমিটার। এছাড়াও ১৫ কিলোমিটার রেঞ্জের এইচ কিউ ৭ শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। পাশাপাশি টাইপ ৫৫, টাইপ ৫৬ এর মতন অ্যান্টি এয়ারক্রাফট বন্দুক ও রয়েছে। তবে এত কীছু সম্ভব ব্রাহ্মস ১২৩ কিলোমিটার পাকিস্তানের ভিতর চলে গেল, পাকিস্তান জানতে পর্যন্ত পারে নি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন চাইনিজ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কী অবস্থা। চীন নিজেই তার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সম্পর্কে রিসার্চ করছে আরও। অলরেডি রাশিয়া থেকে অ্যাডভানস্ড এস -৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম চীন। এবার এটাও কপি করে অন্য নাম দিয়ে চীন জন সমক্ষে আনবে।