পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করতে বিকল্প শক্তির ব্যবহারের মুখে গোটা পৃথিবী!
বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্নিং বা বিশ্ব উষ্ণয়ন। বিশ্বের প্রায় সমস্ত উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ গুলো মিলে একটি সিদ্ধান্তে এসেছে যে যা হোক করেও হোক পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক গবেষনায় এটা দেখা গেছে যদি গ্রীনহাউস গ্যাস তৈরি এখনই বন্ধ না করা যায় তাহলে বিশ্ব উষ্ণয়নের ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে পৃথিবী কে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাসের বড় উৎস। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলোর উৎপাদন বন্ধ করতে হবে, যাতে বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি না পায়। আন্তর্জাতিক ভাবে একটা লক্ষ নেওয়া হয়েছে যে সমস্ত উন্নতশীল দেশগুলোকে ২০৩৪ এর মধ্যে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০৫০ এর মধ্যে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে ফসিল ফুয়েল উৎপাদন বন্ধ করা হবে। ২০১৫ সালে প্রায় সমস্ত দেশের উপস্থিতিতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে উন্নত দেশ গুলিকে অ্যাডভান্সড টেকনোলজি থাকায় তারা বিকল্প শক্তির উৎস বার করতে সক্ষম সেই জন্য তারা ২০৩৪ এর মধ্যে ফসিল ফুয়েল উৎপাদন বন্ধ করবে। এই চুক্তি তে আরও বলা হয়েছে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি যাতে ২ ডিগ্রির বেশী না হয়। আর তা সম্ভব তখনই হবে যদি এখন থেকে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। এটাও বলা হয়েছে যাতে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির বেশী না হয় তা চেষ্টা করা।
প্রথমেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও কিয়োটো প্রোটোকল সম্পর্কে জানতে হবে। ফ্রান্সের প্যারিস শহরের লে বুর্জেটে ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন অনুষ্ঠিত হয় যাকে সিএমপি ১১ ও বলা হয়। বিশ্বের ১৯৬ টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল যাতে ৫৫ টি দেশ সম্মত হয়েছিল। এই দেশগুলি বিশ্বের ৫৫ শতাংশ গ্রীনহাউস গ্যাস তৈরি করে। ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্কে ১৭৪ টি দেশ এই চুক্তিতে সই করে। এতে মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, আর এটা ২০৩০ থেকে ২০৫০ এর মধ্যেই করতে হবে। ২০১৫ সালের ডাটা অনুযায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরিতে শীর্ষে রয়েছে চীন। চীন বছরে পৃথিবীতে তৈরি কার্বন ডাই অক্সাইডের ২৯.৫ শতাংশ একাই তৈরি করে। এরপরেই আছে আমেরিকা ১৪.৩ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৯.৬ শতাংশ, ভারত ৭.৪ শতাংশ, রাশিয়া ৪.৯ শতাংশ, জাপান ৩.৫ শতাংশ। এই সম্মেলন ফ্রান্সেই আয়োজন করা হয়েছিল কারন উন্নত বিশ্বের দেশ হিসাবে ফ্রান্স ২০১২ সালে কয়লা ও তেল ছাড়া পারমানবিক বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎের মাধ্যমে প্রায় ৯০ শতাংশ শক্তি উৎপন্ন করে রেকর্ড তৈরি করেছিল। সুতরাং রোল মডেল হিসাবে ফ্রান্সকেই বাছা হয়েছিল। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর জাপানের কিয়োটো শহরে হওয়া জলবায়ু চুক্তির অ্যাডভান্সড ভার্সন যাকে কিয়োটো প্রোটোকল বলা হয়। ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী এই চুক্তি প্রথম কার্যকর করা হয়। বর্তমানে এই চুক্তিতে ১৯২ টি দেশ যুক্ত আছে। এই চুক্তি অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৩৭ টি উন্নত দেশের বার্ষিক গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়। ২০১২ সালে এই চুক্তিকে সংশোধন করে নতুন ভাবে তৈরি করা হয়, যা দোহা সংশোধনী নামে পরিচিত। এই সংশোধনী অনুসারে শুধুমাত্র ২০২০ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলিকে নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যদি অমান্য হয় প্রয়োজনে ক্ষতিপূরন দিতে বাধ্য থাকবে দেশগুলো। এরই পরিমার্জিত রুপ হচ্ছে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। ভারত, চীন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই চুক্তি হোক তবে তারা কোন আইনি দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকতে চাইছে না। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের খরচ ছিল ১৭০ মিলিয়ন ইউরো বা ১৮৬.৮৭ মিলিয়ন ডলার যার ২০ শতাংশ ফ্রান্স একাই বহন করেছে। তাছাড়া বিএমডব্লিউ, কোকোকলার মত বড় বড় কোম্পানি গুলো খরচ বহন করেছে। তবে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সেইসময় প্রায় ছয় লাখ লোক এর প্রতিবাদ করেছিল।
সেই থেকে অনেকবার একটা কথা বলা হয়েছে যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির বেশী যেন না বাড়ে। বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১০০ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রির বেশী বেড়ে গেছে। এবার আপনাদের মনে হতেই পারে মাত্র এই ১ ডিগ্রি, ২ ডিগ্রি তে কি এমন হতে পারে?। আসলে এটা একটা আইসক্রিম এবং আইসক্রিম সম্পূর্ণ গলে যাবার মধ্যে যতটা পার্থক্য থাকে ততটাই পার্থক্য। ২ ডিগ্রি খুব ছোট একটা সংখ্যা কিন্তু সারা বিশ্বে যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় এই দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে তখন এই নম্বর বড়ো রকমের এক পার্থক্য তৈরি করবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে দেবে যার ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সমুদ্রের তীরবর্তী শহর গুলো জলমগ্ন হয়ে যাবে। গত সত্তরের দশক থেকে এই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। দুই ডিগ্রির সামান্য বেশী যদি ২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৪ এর মধ্যে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ইঞ্চি বিদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের মতো শীতল অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলছে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং আরেক দিকে বরফ গলে যাওয়ার দ্বৈত চাপ পুরো পৃথিবীর ওপর পড়ছে এই তাপ বৃদ্ধির কারনে। পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানীদের ধারনা অনুযায়ী এইভাবে চলতে থাকলে মানুষের পক্ষে এর মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে উৎপাদন ও খাদ্য মজুত কমে যাবে। পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়বে। তীব্র গরম পড়বে এবং বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মরুভূমি তৈরি হবে।
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী বাড়ানো যাবে না এটা তো ঠিক করা হয়েছে কিন্তু এটা পূরন হবে কি করে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কারন বহু দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। ঠিক এই কারনেই জাতিসংঘ নীতি নেয় সিবিডিআর বা কমন বাট ডিফারেন্টিয়েড রেসপনসেবলিটি। এই কথাটার অর্থ সবার একটাই সমস্যা বিশ্ব উষ্নয়ন কিন্তু প্রত্যেকের ভূমিকা আলাদা। কিন্তু এটা হবে কি ভাবে? ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া গবেষনা দপ্তর একটি রিপোর্টে বলে ১৯৯০ এর দশক থেকেই বিশ্বের বহু দেশ ফসিল ফুয়েলের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে সুতরাং এই সমস্ত দেশগুলিই সর্বপ্রথম ফসিল ফুয়েল উৎপাদন বন্ধ করবে ২০৩৪ এর মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে বাকী দেশগুলি ২০৫০ এর মধ্যে করবে এট ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির উপর চাপ পড়বে না। তবে রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে বর্তমানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এতটাই বেড়ে গেছে যদি সমস্ত নিয়ম মেনেও চলা হয় তাহলেও বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী না বাড়ার ৫০ শতাংশ সম্ভবনা রয়েছে। অর্থাৎ এতকিছু করার পরও ৫০ শতাংশ সম্ভবনা রয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, কাতার, জার্মানি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস সহ ১৯ টি দেশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ২০৩৪ এর মধ্যে তাদের সমস্ত তেল ও গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করতে হবে তবেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির বেশী না হবার ৫০ শতাংশ সম্ভবনা থাকবে। ফসিল ফুয়েলের কারনে যে বায়ুদূষণ হয় তাতে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষের তাদের স্বাভাবিক জীবনকালের পূর্বেই মৃত্যু হয়ে যাচ্ছে। রান্নার গ্যাস ও ফসিল ফুয়েল, এর থেকেও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য ৭০ শতাংশ দায়ী গ্রীনহাউস গ্যাস। সুতরাং এটা আগে বন্ধ করা দরকার।
ফসিল ফুয়েল এর বিকল্প হতে পারে সোলার এনার্জি, পরমানু বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ এর মতন প্রকল্প গুলি। এই প্রকল্প গুলোতে নতুন পরিকাঠামো দরকার হয়, ফলে একদিকে যেমন গ্রীনহাউস গ্যাস কম হয় অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়ে। জার্মানি যখন ফসিল ফুয়েলের বদলে বায়ু বিদ্যুৎ এর দিকে যায় তখন জার্মানি তে ব্যাপক কর্ম সংস্থান হয়। ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। বর্তমানে ফ্রান্সের মোট এনার্জির ৭৫ শতাংশই আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে। এই পরমানু বিদ্যুৎ এর পুরো ইনফ্রাস্টাকচারে ইন্জিনিয়ার, শ্রমিক, রেডিয়েশন এক্সপার্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে প্রচুর দক্ষ কর্মী দরকার। ফসিল ফুয়েল দূষনের পাশাপাশি অনেক সময় দেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে যার উদাহরণ হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়ার বিশ্বের অন্যতম বড় ক্রুড অয়েল রপ্তানিকারক। কিন্তু যুদ্ধের কারনে আপাতত ক্রুড অয়েল রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে যার সরাসরি প্রভাব ফেলেছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে, সুতরাং অদুর ভবিষৎে ফসিল ফুয়েলকে বন্ধ করা দরকার। কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমনই বিশ্ব উষ্ণয়নের প্রধান কারন। সুতরাং কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন বন্ধ করার লক্ষে উন্নত দেশ গুলিকে ২০৩০ এর মধ্যে তাদের তেল ও গ্যাস উৎপাদন ৭৪ শতাংশ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতের মত উনয়নশীল দেশ গুলিকে ১৪ শতাংশ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ২০৩০ এর মধ্যে। ফসিল ফুয়েলের এর আগে তাপবিদ্যুৎ ছিল পৃথিবীতে বিদ্যুৎ এর প্রধান উৎস। এতে কয়লা কে ব্যবহার করা হত যা প্রচুর দূষন করত। ২০১৫ তে পৃথিবীর ১৬.৬ শতাংশ বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যায় হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি থেকে। জলবিদ্যুৎ থেকে কোন দূষন হয় না। তবে জলবিদ্যুৎ এর ক্ষেত্রে হয় কী একটি বড় রিজার্ভার তৈরি করে জলকে ধরে রাখা হয়, এতে সমস্যা হয় কি জলের প্রভাব ব্যাহত হয় যার প্রভাব পড়ে ওই জলের উপর নির্ভর করে থাকা চাষের উপর। তারপর যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোন কারনে রিজার্ভের ক্ষতি হয় তাহলে বিস্তীর্ণ এলাকা জলে ডুবে যাবার সম্ভবনা থাকে। সেইজন্য এখন রান অফ দি রিভার হাইড্রোইলেকট্রিসিটি প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। এতে রিজার্ভারের দরকার হয় না, একটি ড্যাম তৈরি করা হয় যাতে টারবাইন থাকে। নদীর জল গতিতে এসে টারবাইন ঘুরিয়ে আবার একই গতিতে আগে প্রভাহিত হয়ে যায়, ফলে জল আটকানোর কম সম্ভবনা থাকে না।