সাদা সোনা কি? ভারতবর্ষকে কেন প্রাধান্য দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র?
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া জম্মু ও কাশ্মীরে লিথিয়ামের বিশাল ভান্ডার খুঁজে পেয়েছে যা ভারতের অর্থনীতির রূপরেখা পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম। এর আগে কর্নাটকের মান্ডিয়াতেও লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেছিল তবে তার পরিমান খুবই সামান্য ছিল, ১৬০০ টন। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে জন্মু কাশ্মীরের রিয়াসি জেলার সালাল হাইমানা এলাকায় এই লিথিয়ামের ভান্ডার পাওয়া গেছে। মিনিস্ট্রি অফ মাইনস জানিয়েছে সেখানে প্রায় ৫.৯ মিলিয়ন টন বা ৬০ লাখ টন জি-৩ লিথিয়াম পাওয়া গেছে। কোন খনিজের প্রাথমিক দশাকে জি-৩ বলা হয়। লিথিয়ামকে সাদা সোনা বলা হয়।
প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক জিনিস মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ ব্যবহারের পরিমান বেড়েছে, এইসব জিনিসেরই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে লিথিয়াম।
ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের প্রধান চালিকা শক্তিই লিথিয়াম। পেট্রোল, ডিজেল চালিত জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে যে ইলেকট্রনিক গাড়ির যুগ শুরু হয়েছে তারও প্রধান উপাদান এই লিথিয়ামই। বর্তমানে ভারত তার প্রয়োজনীয় একশো শতাংশ লিথিয়ামই আমদানি করে কিন্তু জম্মু কাশ্মীরে পাওয়া এই লিথিয়াম ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নির্ভর ভারত তৈরি করতে বড় ভূমিকা রাখবে। যে দেশের কাছে যত লিথিয়াম থাকবে সেই দেশই ভবিষ্যতের বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। ভারতের বিখ্যাত গাড়ি নির্মান সংস্থা মাহিন্দ্রার প্রধান আনন্দ মাহিন্দ্রা জানিয়েছে লিথিয়ামের এই আবিষ্কারের জন্য ভবিষ্যতে ভারতে সম্পূর্ণ ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মান হবে। ভারতে লিথিয়াম পাওয়া যাওয়ার এই খবরে আমেরিকা পর্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠেছে ভারতের উপরে। আমেরিকা জানিয়েছে তাদের এনার্জি ডিপার্টমেন্টের সহকারী জিওফ্রে আর পিয়াট ১৩ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারী ভারত সফরে এসেছে যেখানে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে এনার্জি সিকিউরিটি ও লিথিয়ামের ব্যাপারে আলোচনা হবে। কেন লিথিয়াম এত গুরুত্বপূর্ণ? গোটা বিশ্ব কেনো লিথিয়ামের পেছনে দৌড়াচ্ছে, কেনইবা লিথিয়ামকে সাদা সোনা বলা হয়? সেই ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
বিশ্বে সতেরোটি রেয়ার আর্থ খনিজ রয়েছে। রেয়ার আর্থ অর্থাৎ দুষ্প্রাপ্য নয় কিন্তু এগুলো খনিজ থেকে ব্যবহার করা খুবই ব্যায়বহুল সেজন্য। এই মহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী রেয়ার আর্থ খনিজ রয়েছে চীনের কাছে। ইট্রিয়াম, প্রমিথিয়াম, ইব্রিয়াম, উইট্রিবিয়াম, থুলিয়াম, লুটেটিয়াম, হলমিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, সামারিয়াম, সেরিয়াম, ইউরোপিয়াম, ল্যান্থানাম, টার্বিয়াম, প্রাসিওডিয়ামিয়াম,নিওডিয়ামিয়াম এই সতেরোটি রেয়ার আর্থ খনিজ আছে বিশ্বে যার ভান্ডার রয়েছে চীনে। ভারত সরকারের খনিক মন্ত্রক গত চার বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এরকম রেয়ার আর্থ খনিজ সম্পদ সন্ধানের নির্দেশ দেয়। ২০১৮ থেকে অনুসন্ধান করার পর জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ভারতের এগারোটি রাজ্যে ৫১ টি খনিজ সম্পদের সন্ধান দিয়েছে। সেখান থেকেই লিথিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায়। বারবার যে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কথা বলা হচ্ছে এই সংস্থাটি ১৮৫১ সালে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল যার কাজ ছিল ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়লা খনির আবিষ্কার করা, কারন সেসময় ভারতে রেলগাড়ির জন্য কয়লা দরকার ছিল। গ্রীক শব্দ লিথোস থেকে লিথিয়াম কথাটি এসেছে যার অর্থ পাথর। ১৮১৭ সালে জোহান আগস্ট আর্ফেডেসন লিথিয়াম আবিষ্কার করে। তবে বিজ্ঞানীদের মতে লিথিয়াম অন্যান্য খনিজের মতো সাধারন ভাবে পৃথিবীতে তৈরি হয়না। নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষের ফলে এই লিথিয়াম তৈরি হয়, নক্ষত্রের ধ্বংস হওয়াকে নোভা বলা হয়। সেই বিস্ফোরনের পারমানবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া এই লিথিয়াম পুরো ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। জলের সাথে অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল এই লিথিয়াম। লিথিয়াম এত গুরুত্বপূর্ণ কারন ইলেকট্রিক গাড়ি থেকে শুরু করে মোবাইল, ল্যাপটপ সহ সমস্ত ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যাটারি হচ্ছে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। সুতরাং লিথিয়াম ছাড়া ব্যাটারি তৈরি সম্ভব নয়। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লিথিয়ামই পাওয়া দক্ষিন আমেরিকার তিনটি দেশ চিলি, বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনায়, এদেরকে একসাথে লিথিয়াম ত্রিভুজ বলা হয়। তবে লিথিয়ামের ভান্ডার থাকার অর্থ এই নয় যে সেই দেশেই লিথিয়াম তৈরি হয় সবচেয়ে বেশী। কারন খনি থেকে লিথিয়াম তোলা ও শোধন করতে অনেক খরচ ও আধুনিক প্রযুক্তির দরকার। যেমন খনিজ তেলকে শোধন করে পেট্রোল, ডিজেল পাওয়া যায় তেমন খনিজ লিথিয়ামকেও শোধন করা হয়, এই ক্ষেত্রে চীন সবচেয়ে এগিয়ে।
চীন বিশ্বের ৭৫ শতাংশ লিথিয়ামকে শোধন করে। ভারতে গুজরাট প্রথম রাজ্য হতে চলেছে যেখানে লিথিয়াম শোধনাগার তৈরি হচ্ছে। ২০১৬-১৭ সালে ভারত ৩৮৪ মিলিয়ন ডলারের লিথিয়াম আমদানি করেছিল, ২০১৮-১৯ এ এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১.২ বিলিয়ন ডলার। ২০৩০ সালে এই সংখ্যাটা অন্তত ১০০ গুন বাড়বে কারন ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে অন্তত ৩০ শতাংশ ইলেকট্রিক গাড়ি থাকবে, সুতরাং লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দরকার পড়বে অনেক। যদি ভারতেই এই ব্যাটারি তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে ইলেকট্রিক গাড়ির দামও কমবে অনেক, কারন ইলেকট্রনিক গাড়ির মোট মূল্যের ৫০ শতাংশই ব্যায় হয় এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে। ভারত ২০৭০ এর মধ্যে শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্য নিয়েছে। সমস্ত অপ্রচলিত শক্তি উৎসের মধ্যে আপাতত লিথিয়ামই সবচেয়ে কার্যকর হয়েছে, যদিও হাইড্রোজেন সহ আরও বেশ কিছু বিকল্প শক্তির উপর কাজ চলছে তবে লিথিয়ামই সবচেয়ে সফল এখনও পর্যন্ত। বাকি সমস্ত ব্যাটরির তুলনায় লিথিয়ামের শক্তি অনেক বেশী, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি সহজেই চার্জ হয় এবং প্রতি কিলোগ্রামে বাকি সব ব্যাটারির তুলনায় অনেক বেশী শক্তি ধারন করে রাখে। এত ক্ষমতা হওয়া সত্বেও এই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ওজন অনেক কম। তবে লিথিয়ামের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে লিথিয়াম মাত্র গোটা কয়েক দেশেই পাওয়া যায় এবং চীন এই সেক্টরে অনেক বেশী এগিয়ে সবার থেকে।
২০২১ এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে চীন একাই ৭৯ শতাংশ লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি তৈরি করেছে, আমেরিকা তৈরি করেছে মাত্র ৬.২ শতাংশ। এই পার্থক্যই প্রমান করে চীন কতটা এগিয়ে। গোটা বিশ্বের লিথিয়াম বানিজ্যের ৮০ শতাংশ একা চীনের দখলে, ভারতও চীন থেকেই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ক্রয় করে। চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লিথিয়াম খনির শেয়ারও কিনে নিচ্ছে। চীন অস্ট্রেলিয়ার লিথিয়াম খনির ৫১ শতাংশ এবং চিলির লিথিয়াম খনিতে ২৩.৮ শতাংশ শেয়ার চীনের দখলে। চীনের গ্যানফেং লিথিয়াম ও তিয়ানকুই লিথিয়াম এইসব অঞ্চলের অন্যতম বড় লিথায়ম জায়েন্ট সংস্থা। তবে চীন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি তৈরি করে মানে এই নয় যে চীনে লিথিয়ামের ভান্ডার আছে। লিথিয়ামের মজুতের বিচারে চীন বিশ্বে ষষ্ঠ। চীনে ৪.৫ মিলিয়ন টনের লিথিয়াম ভান্ডার আছে, সেখানে ভারতের জম্মু কাশ্মীরে ৫.৯ মিলিয়ন টনের লিথিয়াম ভান্ডার পাওয়া গেছে! ঠিক এই কারনেই আমেরিকা ভারতের ব্যাপারে আগ্রহী এত বেশী। কারন চীনকে টেক্কা দেবার জন্য আমেরিকার দরকার ভারতকে। ভারতে ভবিষ্যতে আমেরিকা সহ বিশ্বের বড় বড় অটোমোবাইল সংস্থা গুলো বিনিয়োগ করতে পারে। ইলেকট্রনিক গাড়ির ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার।
ইতিমধ্যেই মুকেশ অম্বানির রিলায়েন্স সংস্থা অপ্রচলিত শক্তি উৎসের জন্য ৭৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে যার মধ্যে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি নির্মানও আছে। এই বিভাগে ভারতের আরও বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসার জন্য ভারত সরকার বিশেষ আর্থিক সহায়তারও ঘোষনা করেছে। ভারত সরকারের সাহায্যে নালকো, হিন্দুস্থান কপার ও মিনারেল এক্সপ্লোরেশন এই তিনটি সংস্থা ২০১৯ সালে খনিজ বিদেশ ইন্ডিয়া লিমিটেড নামে একটি সংস্থা তৈরি করে যার লক্ষ্য যেসব দেশে লিথিয়াম পাওয়া যায় কিন্তু তাদের পরিকাঠামো নেই ব্যবহারের, সেইসব দেশের সাথে চুক্তি করে খনি থেকে লিথিয়াম তুলে শোধন করা। এরইমধ্যে চিলি ও বলিভিয়ার সাথে কথা চলছে সংস্থাটির লিথিয়ামের ব্যাপারে। ২০২১ সাল থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, জম্মু কাশ্মীর, রাজস্থান, অরুনাচলপ্রদেশ সহ একাধিক রাজ্যে লিথিয়ামের জন্য অভিযান চালাচ্ছে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। সুতরাং আগামী কয়েক বছরে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি নির্মানের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের প্রথম সারির দেশ গুলোর মধ্যে একটি হবে তা বলাই যায়।