জার্মানকে দুভাগ করে কোন পার্ট আমেরিকা নিয়েছিল? কেন ই বা এই এমন করা হয়ছিল?
যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন লক্ষ করেন দেখবেন ইউক্রেনের একটি শহর যার নাম মারিওপোল যেটি রাশিয়ান আক্রমনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়ান এয়ারস্ট্রাইক ও মিসাইল হামলায় এই শহরটিকে আজ চিনতে পারবেন না। শহরের বড় বড় বিল্ডিং আজ ভগ্নস্তূপে পরিনত হয়েছে। যে মারিপোলের রাস্তায় সর্বদা লোকের ভিড় করে থাকত সেই রাস্তায় আজ শুধুই ধ্বংসস্তুপ পরে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অবস্থা এর থেকেও খারাপ হয়েছিল। হ্যাঁ এটাই সেই জার্মানি যাকে একুশ শতকে ইউরোপের ইঞ্জিন বলা হয় তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সের আক্রমনে ধ্বংস হয়ে গেছিল প্রায়। শুধু তাই নয় জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চারটি দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ছিল। পশ্চিম জার্মানি ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্সের অধীনে ছিল। জার্মানির রাজধানী বার্লিন একটি দেওয়ালের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত ছিল যাকে বার্লিন ওয়াল বলা হয়।
পশ্চিম জার্মানিতে ১৯৪৮-৫২ অবধি আমেরিকার মার্শাল প্ল্যানের জন্য অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি হয় অন্যদিকে পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত অধীনে থাকায় তেমন কোন উন্নতি হয়নি। তবে ১৯৯০ এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বার্লিন ওয়াল ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়ে যায় যার কারনে অনেকদিন জার্মান অর্থনীতি একটু ধীরগতির হয়ে যায়। ২০০০ সালে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দায় আবারও জার্মানির জিডিপি কমে যায় এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সময় জার্মানির অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে জার্মানিকে ইউরোপের অসুস্থ মানুষ বলে ডাকা হত। কিন্তু খুব দ্রুতই জার্মানি নিজেদের অর্থনীতি এতটাই মজবুত করে ফেলে যে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসাবে জার্মানির উদয় হয়। গোটা ইউরোপ এইসময় যখন দেনায় জর্জরিত ছিল তখন জার্মানি পর্তুগাল, গ্রীস, স্পেনের মতন ভেঙে পড়া অর্থনীতির দেশগুলোকে সাহায্য করে। ইউরোপের অসুস্থ মানুষ থেকে ইউরোপের ইঞ্জিন হয়ে ওঠার এই যাত্রায় জার্মান অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অটোমেটিভ ইঞ্জিন তৈরিতে জার্মানির খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। মার্সেডিজ বেঞ্জ, অডি, পোর্সে, বিএমডব্লিউর মতন বিশ্ব বিখ্যাত লাক্সারি গাড়ির ব্রান্ড জার্মানিরই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ কীভাবে অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে সে ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
জার্মানির অর্থনীতি বুঝতে গেলে সময়ের একটু পেছনে যেতে হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের সময়ে। সময়টা ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর, যা জার্মানির ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় দিন, এই দিনই জার্মান সেনা আত্মসমর্পন করে, যা ভবিষ্যতে ইউরোপের ভাগ্য বদলে দেয়। ১৯১৯ সালের জুন মাসে জার্মানিকে অপমানজনক ভারসাইলের চুক্তি করতে হয় যাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানীকে দায়ী করে প্রচুর ক্ষতিপূরন আদায় করা হয় জার্মানির কাছ থেকে, জার্মানির শিল্পাঞ্চল গুলো বিদেশী অধীনে চলে যায় এবং জার্মানির সেনাবাহিনীকে পুরো ভেঙে দেওয়া হয়। প্রচুর অর্থনৈতিক সংকটে থাকা জার্মানি নোট ছাপাতে শুরু করে যাতে দেশে প্রচুর মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। আমেরিকার অর্থ সাহায্যে জার্মানির অর্থনীতি কীছুদিন সচল ছিল কিন্তু ১৯৩০ এর বিশাল অর্থনৈতিক মন্দায় জার্মানির অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়। এর প্রভাব অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতেও পড়ে। ১৯২০ তে যেখানে জার্মানিতে ৮৬ টি অটোমোবাইল কোম্পানি ছিল সেখানে ১৯৩০ আসতে আসতে এই সংখ্যাটি ১২ তে দাঁড়ায়। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে তৎকালীন সময়ে জার্মানির চারটি বড় অটোমোবাইল সংস্থা হর্চ, অডি, ডিকেডব্লু ও অটোমোবাইল যৌথভাবে ১৯৩২ সালে অটো ইউনিয়ন তৈরি করে যা জার্মানিকে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করে। কিন্তু টেকনোলজিক্যালি অ্যাডভান্সড হলেও জার্মানি আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের তুলনায় রপ্তানিতে পিছিয়ে ছিল, জার্মানি নিজের দেশের বাজারেই আবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৩০ সালে এক বিরাট বড় পরিবর্তন দেখা যায় যা অ্যাডলফ হিটলারের সাথে জড়িত ছিল। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারীতে জার্মানির চ্যান্সেলর হয় অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার অপমানজনক ভারসাইলের চুক্তির প্রতিশোধ নিতে জার্মানিকে সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী করতে শুরু করে যার একটাই লক্ষ ছিল যুদ্ধ।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জার্মানির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বেকারত্ব যার জন্য হিটলার বেকারদের জার্মান নাজি সেনায় ভর্তি করে। নতুন কাজ দেবার বদলে জার্মানিতে সমস্ত চাকরি থেকে ইহুদিদের বের করে দেওয়া হয়। জার্মানিতে হাইস্পিড হাইওয়ে নামে মেগা পাবলিক প্রজেক্টও শুরু হয় এসময় যার কারনে ১৯৩৫ সালে জার্মানিতে বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায় এবং অর্থনীতি মজবুত হতে শুরু করে। জার্মান অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতও ঘুরো দাঁড়াতে শুরু করে। ভক্সওয়াগন নামে গাড়ি কোম্পানিকে সবাই চেনেন। কিন্ত জানেন কী এই গাড়ি তৈরির ইঞ্জিনিয়ার ফার্ডিনান্ড পোর্সের ভক্সওয়াগন প্রজেক্টের পেছনে হিটলারের একটি বড় ভূমিকা ছিল। আসলে হিটলারের গাড়ির খুব সখ ছিল। হিটলার গাড়িকে নিজের স্ট্যাটাস হিসাবে মনে করত। এজন্য তার নাজি দল মটোরাইজেশন নামে একটি পরিবহন নীতি তৈরি করে। এই নীতি অনুযায়ী হিটলার জার্মান মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নত করার চেষ্টা করে। এর জন্য পোর্সেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি কম খরচে গাড়ি তৈরি করতে যা সবাই ব্যবহার করতে পারবে। ১৯৩৭ সালে ভক্সওয়াগন বিটেল নামে একটি গাড়ি তৈরি করা হয়। এই গাড়ি বিক্রির বেশীরভাগ লভ্যাংশ হিটলার সেনার জন্য খরচ করত। এই গাড়িটি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে জার্মান সেনাও প্রয়োজনে ব্যবহার করতো পারে।
হিটলারের হাইওয়ে প্রজেক্টের জন্য সেনাবাহিনীর যাতায়াতে আরও সুবিধা হয়েছিল। এই সময় জার্মানির অর্থ ব্যাবস্থা যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল যার জন্য জার্মানিকে এই সময় মাস্টার অফ কন্টিনেন্টাল ইউরোপ বলা হত কিন্তু এই অবস্থা দ্রুত বদলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়। জার্মানির শিল্প কাঠামো, চাষ প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানির ২০ শতাংশ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। নাজিদের তৈরি হাইওয়ে, সেতু সব ধ্বংস হয়ে যায়। যুদ্ধে জার্মানির ১৮-৩৫ বছর বয়সী জনসংখ্যার অনেকাংশ মারা যায় যার ফলে জার্মানিতে দক্ষ লোকের সংখ্যা কমে যায়। অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়া জার্মানিতে তখন রীতিমতো কালোবাজারি শুরু হয়ে গেছিল। এই সময় জার্মান অর্থনীতিবিদ ওয়াল্টার ইউকেন একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক গঠনের প্রস্তাব দেয় যা জার্মানির অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রন করবে। পশ্চিম জার্মানিতে এবিষয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এক জার্মান অর্থনীতিবিদ লিউডিং এরহাডের নাম এসময় আলোচিত হয় যাকে জার্মান ইকোনমিক মিরাকেলের জনক বলা হয়। তিনি হিটলারের রাজত্বকালেই ভবিষ্যতে জার্মান অর্থনীতির দুর্দশা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। লিউডিং এরহাডকে পশ্চিম জার্মানির ইকোনমিক কাউন্সিলের ডিরেক্টর করা হয়। তিনি কিছু বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করেন। তিনি একটি নতুন কারেন্সি চালু করেন এবং দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ট্যাক্স কম করেন। ধীরে ধীরে পশ্চিম জার্মানির অর্থনীতি সচল হতে শুরু করে। কালোবাজারি, দুর্নীতি কম হতে শুরু করে এবং কাজে গতি বাড়ে। ইউরোপ পুনর্গঠন বা মার্শাল প্ল্যান পশ্চিম জার্মানির অর্থনীতিকে আরও মজবুত করে। আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট জর্জ মার্শাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠনের জন্য ১৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়। এর সবচেয়ে বেশী অংশ পায় পশ্চিম জার্মানি। যার জন্য ১৯৫০ সালে পশ্চিম জার্মানি ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫৮ সালের মধ্যে জার্মানির শিল্প প্রতিষ্ঠান চার গুন বৃদ্ধি পায়। জার্মানির অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতেও এর প্রভাব দেখা যায়।
ভক্সওয়াগন সংস্থা তৈরি হয়েছিল হিটলারের নেতৃত্বে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে এখানে গাড়ি তৈরি বন্ধ করে সেনার জন্য আর্টিলারি ও গাড়ি তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই গাড়ি ফ্যাক্টরি ও উলফসবার্গ শহর যেখানে এই ফ্যাক্টরি অবস্থিত পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়। পরে এই কারখানা যখন আবার শুরু করা হয় তখন এক দশকের মধ্যে জার্মানির অর্ধেক গাড়ি এই সংস্থাই তৈরি করতে শুরু করে। এই কোম্পানি হিটলার তৈরি করলেও ১৯৬০ আসতে আসতে সংস্থার ৬০ শতাংশ শেয়ার মানুষ কিনে নেয়। ভক্সওয়াগন অটো ইউনিয়নকে কিনে নেয় যা পরে গিয়ে অডির মতন বিলাসবহুল গাড়ি নির্মান সংস্থা তৈরি হয়। ভক্সওয়াগনের পাশাপাশি জার্মানিতে এসময় বিএমডব্লিউ নামেও একটি গাড়ি নির্মান সংস্থা তৈরি হয়। এভাবে ধীরে ধীরে জার্মান অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি গোটা বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ ছিলনা। সেসময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল।
আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম জার্মানি যেখানে পুঁজিবাদি নীতি অনুসরন করছিল সেখান সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট নীতি ছিল। যেখানে একদিকে পশ্চিম জার্মানি ক্রমশ অর্থনৈতিক ভাবে মজবুত হচ্ছিল অন্যদিকে পূর্ব জার্মানি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল। পূর্ব জার্মানির লোক স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং বড় সংখ্যায় পূর্ব জার্মানির লোক দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে। বাধ্য হয়ে পূর্ব জার্মানির সরকার তার নাগরিকদের ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার অনুমতি দেয়। এরপর বার্লিন ওয়াল ভেঙে গিয়ে দুই জার্মানি এক হয়ে যায়। আজ প্রায় ৩০ বছর দুই জার্মানি এক হয়ে গেছে কিন্তু আজও পূর্ব জার্মানির তুলনায় পশ্চিম জার্মানি বেশী উন্নত কারন দীর্ঘদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকার প্রভাব আজও রয়েছে পূর্ব জার্মানিতে। দুই জার্মানি যখন এক হয় তখন পূর্ব জার্মানির পার ক্যাপিটা জিডিপি পশ্চিম জার্মানির থেকে ৩০ শতাংশ কম ছিল। বর্তমানে ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির কথা গোটা বিশ্ব জানে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনা মহামারীর কারনে জার্মানিতে গাড়ি বিক্রি কমে গোছে। এই বছরের প্রথম পাঁচ মাসে জার্মানিতে এক মিলিয়ন গাড়ি বিক্রি হয়েছে যা ২০২১ এর তুলনায় ৯ শতাংশ কম এবং ২০১৯ এর তুলনায় ৩৩ শতাংশ কম। তবে জার্মানিতে ইলেকট্রিক গাড়ি কেনবার পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে।