চীনের প্রভাব থেকে মাঙ্গোলিয়াকে মুক্ত করতে কি ছক ভারতবর্ষের?
উত্তরে রাশিয়া আর দক্ষিণে চীনের মাঝখানে স্থলভাগ বেষ্ঠিত ছোট্ট দেশ মঙ্গোলিয়া। চারিদিকে স্থলভাগ বেষ্ঠিত হওয়ায় মঙ্গোলিয়া জলপথে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য অনেকাংশে চীনের ওপর নির্ভরশীল। তবে, বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রমে চীন ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে দেখা দিয়েছে এক কূটনৈতিক টানা পোড়ন। আগে নানা সময় চীনের দাদাগিরি মঙ্গোলিয়া বাধ্য হয়ে সহ্য করলেও আসল ঘটনার সূত্রপাত ২০১৬ তে। সেই বছর দলাই লামা মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাতারে গেলে তার প্রতিবাদে চীন মঙ্গোলিয়ার বর্ডার বন্ধ করে দেয়। বাণিজ্যের জন্য মঙ্গোলিয়া সম্পূর্ন ভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল তা জেনেই মঙ্গোলিয়া কে চাপে ফেলতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো চীন। ঘটনার ফলস্বরূপ হাজার হাজার ট্রাক আটকে যায় সীমান্তে। মঙ্গোলিয়ার অর্থনীতি ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীনের এমন এক তরফা দাদাগিরির মাঝে রাশিয়া চীনের বন্ধু দেশ হওয়ায় রাশিয়ার অবস্থান নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয় মঙ্গোলিয়াতে। নিজের ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে এইরকম হাজার অন্যায় চীন দীর্ঘকাল ধরেই এই দেশের সাথে করে আসছে। শুধু চিন নয়, রাশিয়ার সাথেও মঙ্গোলিয়ার সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। অথচ ব্যাবসা বানিজ্য করার জন্য রাশিয়ার ওপরেও অনেকটাই নির্ভর করতে হয় মঙ্গোলিয়াকে। তাই রাশিয়াকে নিয়েও একটা আশঙ্কা থেকেই যায় মঙ্গোলিয়ার। এদিকে মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মত রাশিয়া ও চীন পরস্পরের বেশ কাছের। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গোলিয়া যতটা সম্ভব উক্ত দেশ দুটির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাইছিল। নতুন এই সুযোগ যদিও এসেছিল সে নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেই। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে মঙ্গোলিয়াতে জন্ম নেয় এক নতুন থার্ড নেবার পলিসি। এই পলিসি অনুযায়ী ক্রমে চীন ও রাশিয়ার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী হয়ে ওঠে।সেই সময় আমেরিকার সাথে চীন এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক টানাপোড়ন চলাই মঙ্গোলিয়া কে চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় আমেরিকা সহ অনেক পশ্চিমের অনেক মিত্র দেশই। এমনকি আমেরিকার প্রাক্তন সেক্রেটারি অফ স্টেট জেমস বেকার সেই সময় মঙ্গোলিয়া সফরে গিয়ে আমেরিকাকে মঙ্গোলিয়ার থার্ড নেবার (Third Neighbour) বলে অভিহিত ও করেন।
এই ঘটনার পর থেকেই থার্ড নেবার পলিসি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে মঙ্গোলিয়া।তারপর থেকে ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা ছাড়া জাপান,অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ এমনকি ভারতও মঙ্গোলিয়ার এই থার্ড নেবার পলিসির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সরকারি ভাবে যদিও ভারত ও মঙ্গোলিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয় ১৯৯৫ সালে তবু, এই থার্ড নেবার পলিসি চালু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভারত ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক ভাতৃত্ব ছিলোই। বৌদ্ধধর্ম তো ভারত থেকেই পৌঁছেছিল মঙ্গোলিযায়।
দীর্ঘ এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সুসম্পর্কের পরেও ভারতের কোনো বড় মাপের নেতার কখনো মঙ্গোলিয়া সফরে যাওয়া হয়নি। তবে, পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে ২০১৫ তে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক বছরের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদী প্রথমবারের জন্য যান মঙ্গোলিয়া সফরে। এরপর ২০১৮ তে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ ও তৎকালীন গৃহমন্ত্রী এবং অধুনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী রাজনাথ সিং ও মঙ্গোলিয়া সফরে গিয়েছেন।
তবে, শুধু মঙ্গোলিয়ার স্বার্থেই যে সম্প্রতি ভারতের উচ্চস্তরীয় নেতা নেত্রীদের এই মঙ্গোলিয়া ভ্রমণ, তা কিন্তু নয়। যে দেশে এতদিন কোনো ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী যাননি সেখানে হঠাৎ এত ঘন ঘন সফরের কারণ বুঝতে গেলে মঙ্গোলিয়ার ভৌগলিক অবস্থান টাও মাথায় রাখতে হবে। মঙ্গোলিয়ার দক্ষিনে অবস্থিত চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। প্রতিনিয়ত ভারতের ঘাড়ের পাশে নিশ্বাস ফেলছে চিন। ভারতের উত্তরে অবস্থিত প্রতিবেশী নেপালের উপরেও ক্রমশ প্রভাব বাড়ছে চীনের। এই অবস্থায় চীনের ওপর চাপ বাড়াতে মঙ্গোলিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপন করা খুব ই জরুরি। আর ঠিক এই লক্ষেই মঙ্গোলিয়ার ওপর থেকে চীনের প্রভাব কমতে সেই দেশের সরকারকে সাহায্য করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত।
পূর্বে মঙ্গোলিয়াতে কোনো তৈল শোধনাগার ছিল না। যে কারনে বিদেশ থেকে কাঁচা তেল আমদানি করার পর তা শোধনের ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে হতো মঙ্গোলিয়া কে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত সরকার প্রায় ১.২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার অর্থাৎ প্রায় ৮৫০০ কোটি টাকা খরচ করে মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ দিকে গোবি মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত Sainshand এ এক বিশাল তৈল শোধনাগার তৈরি করছে।সূত্রের খবর এই কাজ শেষ হবে ২০২২ সালে। তবে শুধু এখানেই শেষ নয়। তৈল শোধনাগার তৈরির সাথে সাথে সেখান থেকে তেল পরিবহনের জন্য ২৭ কিলোমিটার রেললাইন, ১৭.৫ কিলোমিটার সড়কপথ নির্মাণ করছে ভারত সরকার। সেই সঙ্গে ১৯ কিলোমিটার রাস্তায় পাওয়ার ট্রান্সমিটার ও বসানো হয়েছে যাতে শোধনাগার থেকে তেল পরিবহনে কোনো সমস্যা না হয়।
ভারত ও মঙ্গোলিয়া এই দুই দেশের সেনার মধ্যে মিলিটারি এক্সারসাইজ শুরু করা হয়েছে জোরকদমে। নোমাডিক এলিফ্যান্ট(Nomadic Elephant) আর খান কোয়েস্ট( Khaan Quests) নামক দুটি মিলিটারি এক্সারসাইজ তারই প্রমাণ। সাইবার সিকিউরিটি জোরদার করতে মঙ্গোলিয়া ই ভারত সরকারের সাহায্যে স্থাপন করা হয়েছে এক ট্রেনিং সেন্টার। সূত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের টেকনোলজিক্যাল এক্সপার্টরা সেখানে সাইবার সিকিউরিটির ট্রেনিং দেবেন।
দুই দেশের মধ্যে মিত্রতা বাড়িয়ে তুলতে সম্প্রতি ভারত ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে এক MoU(Memorandum of Understanding) এবং স্পেস কো অপারেশন (space co operation) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির ফলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ইসরো থেকে মঙ্গোলিয়ার স্যাটেলাইটও মহাকাশে পাড়ি দেবে।
ভারত মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে এক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। প্রতিনিয়ত মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ার সাথে সাথে মঙ্গোলিয়ার উন্নতিসাধন জন্য বিভিন্ন ভাবে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে করা হচ্ছে ভবিষ্যতে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে আরো বিভিন্ন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হবে। কূটনীতি অনেকটাই দাবা খেলার মতো।চীনকে চাপে রাখতে মঙ্গোলিয়ার সাথে ভারতের এই বন্ধুত্ব অদূর ভবিষ্যতে যথেষ্ট কার্যকরী হবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।