কেন সীমান্তে ভারতবর্ষের সাথে বারংবার অশান্তি করছে চীন?
নিজস্ব সংবাদদাতা: হালফিলে একটা কথা খুবই উঠছে। ভারত নাকি চারদিক থেকে শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়েছে। কথাটা সম্পূর্ণ ভুল না হলেও গলদ রয়েছে অনেকটাই। ভারত চীন সীমান্তে চীনের অগ্রাসন দেখে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠছেন। আর ঠিক এই কারণেই বক্তব্যটির মধ্যে কতটা সত্যতা রয়েছে আর ঠিক কতটা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে তা একে একে যুক্তি দিয়ে পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
তার আগে আসুন এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক চীন ঠিক কি কি কারণে এখন হুট করে সীমান্তে ঝামেলা পাকানোর তাল করছে।
আপাত দৃষ্টিতে দেখলে এর মোটামুটি তিনটি কারণ চোখে পড়ে
প্রথমত, করোনা থেকে সকলের দৃষ্টি সরানো। এই ভাইরাস চীন থেকে ঠিক কিভাবে ছড়ালো বা চীনের ল্যাবে ভাইরাসটি করছিলোই বা কি? এই ধরনের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ভারতের তরফ থেকেও বেশ চাপে পড়তে হয়েছিল চিনকে। এখন লাদাখে ঝামেলা পাকিয়ে সেই দিক থেকে কিছুটা হলেও দৃষ্টি সরাতে পেরেছে তারা। এমনকি সংবাদমাধ্যমেও লাদাখের খবরের জেরে করোনা বেশ ব্যাকফুটে চলে গেছে।
দ্বিতীয়ত, সি পি ই সি নিয়ে চীনের তীব্র ইন্সিকিউরিটি। ভারত সাম্প্রতিককালে পি ও কে তথা গিল্গিটকে বাল্টিস্তানে ফেরানোর কথা ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যেই চিনের প্রায় ৬৬.৬৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ হয়ে গেছে চায়না-পাক-ইকনমিক-করিডোর এর পেছনে অথচ সি পি ই সি ঠিক এই টেরিটোরির ওপর দিয়েই যাওয়ায়, চীন স্বীকার না করলেও এখন খানিকটা আতঙ্কে রয়েছে। আর ঠিক তাই করোনাকে কাজে লাগিয়ে চিন এল এ সি তে গোলমাল পাকিয়ে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য ভারতের পি ও কে ফেরানোর প্ল্যান ভণ্ডুল করতে চায়।
তৃতীয়ত, সম্প্রতি ভারত করোনা নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের কাছে অস্ট্রেলিয়ার পেশ করা তদন্ততে সায় দিয়েছে। বলাই বাহুল্য যে ঘটনাটি বেশ গায়ে লেগেছে চিনের। আর এটা একপ্রকার বদলা বলা যেতে পারে।
এবার আসা যাক আগের আলোচনায়। যারা মনে করছেন চীন ও পাকিস্তানের মাঝে চক্রব্যূহে আটকে গেছে ভারত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে খানিকটা। আসুন কিছুটা বিশ্লেষণ করে বোঝাই।
ভারতের মাথার কাছে চীন নিশ্বাস ফেলছে ঠিকই কিন্তু বুঝতে হবে চীন নিজের এরিয়াতেই দক্ষিণ চীন সাগর ডিস্পিউট নিয়ে যথেষ্ট কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম সবার ওপরে চলে চীনের একতরফা দাদাগিরি। এপ্রিল মাসে চিন ভিয়েতনামের একটা ফিশিং বোট ডুবিয়েছে আবার মে মাসেও মালয়েশিয়ার সাথে গোলমাল বেঁধেছে চিনের। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন চীনের সাথে ওই দেশগুলোর ঠিক কেমন সম্পর্ক। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন যুদ্ধ বাধলে চীন তার প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে কোনরকম সাহায্য পাচ্ছে না বরং চীন বেকায়দায় পড়লে তাদের লাভ।
ভারতের অপর এক প্রতিবেশী দেশ নেপাল যুদ্ধ বাধলে কখনোই তাতে সরাসরি জড়াবে না। চীন ও ভারতের মাঝখান এ অবস্থিত নেপাল দুই দেশের ওপরেই নির্ভরশীল হওয়ায় থাকবে একেবারে নিউট্রাল।
এবার আসা যাক জাপানের কথায়। সেই সেন-কাকু দ্বীপ নিয়ে ঝামেলার জোরে এখন জাপান ও চীনের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে। পরিস্থিতি যাই হয়ে যাক না কেন জাপান তাই কোনমতেই চীনের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। চীন সাহায্য পাবে না সাউথ কোরিয়ার কাছ থেকেও। চীনের সাথে তাদের শত্রু দেশ নর্থ কোরিয়ার যোগাযোগ বেশ ভালই। আর ঠিক এই কারণেই বন্ধু হিসাবে পাশে দাঁড়াবে না সাউথ কোরিয়া।
রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্ব অল্পসময়ের মধ্যেই গাঢ় হয়েছে বেশ অনেকটাই। তবে, যুদ্ধে রাশিয়া ভারত ছেড়ে চীনকে সরাসরি সাপোর্ট করবে এটা ধরে নিলে কিন্তু ভুল হবে। রাশিয়ার বড় অস্ত্র মার্কেট ভারত অপরদিকে চীনের সাথেও তাদের সম্পর্ক বেশ ভালো তাই দুই সম্পর্কের moddhe কোনোটাকেই বিপদের মুখে ফেলতে চাইবে না রাশিয়া। রাশিয়া নিউট্রাল থাকবে। বরং ভারত রাশিয়ার অস্ত্রের খদ্দের হওয়ায় সেই সম্পর্কটা ঠিকই বজায় থাকবে।
এক্ষেত্রে আরেকটা জিনিস মনে রাখা দরকার। সাম্প্রতিককালে রাশিয়া থেকে আমদানি করা এস-৪০০ ভারতের কাছে এক বড় অ্যাডভান্টেজ। হ্যাঁ, চীনের কাছেও রয়েছে এটি। তবে, চিন মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম এর সদস্য না হওয়ায় তাদের কাছে বিক্রি করা এস-৪০০ এর রেঞ্জ ভারতের তুলনায় অনেকটাই কম। মাত্র 300 কিমি। সুতরাং তা কোনমতেই ভারতের এস-৪০০ এর মতো কার্যকরী হবে না।
এবার ন্যাভাল পয়েন্ট থেকে যদি বলা হয় তবে, চীনের প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, হংকং, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স প্রত্যেকের সাথে ঝামেলা থাকায় ভারত যদি কোনরকমে চীনে প্রবেশ করতে চায় তবে তা আটকানো চীনের জন্য একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠবে। কারণ উক্ত কোন দেশেই সেই ব্যাপারে চীনকে সহায়তা করবে বলে মনে হয় না।
অপরদিকে ইন্ডিয়ান অশেন এ চীন প্রবেশ করতে চাইলে রয়েছে দুটো উপায়।
এক হচ্ছে মালাক্কার পথ যা খুব সহজেই ভারত চাইলে ভারত মহাসাগরে ন্যাভাল ব্লকেজ বানিয়ে আটকে দিতে পারে। এই ব্যাপারে একটা জিনিস মাথাই রাখা দরকার,চিনা সৈন্য মালাক্কা দিয়ে ভারতে প্রবেশর চেষ্টা করলে সোজা আন্দামান নিকবার এর বেস এর সামনে পড়বে।
অপর রাস্তাটি হলো দক্ষিণে সুন্দা দিয়ে ঢোকা। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো সাম্প্রতিক কালে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী ভারত কোকোস দ্বীপটিকে নিজস্ব বেস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে ফলে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করা চীনের কাছে অসম্ভব।
যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ব্রাহ্মস মিসাইল ভারতের কাছে আরেক বড় অ্যাডভান্টেজ হয়ে দাঁড়াবে। ভারতীয় বর্ডার এর ঢাল ৮০ ডিগ্রী এর সাথে এটি যেন একেবারে স্বর্গে তৈরি জুটি, একমাত্র ব্রাহ্মস এর সাথে আয়ক্লিমেটেড।
এবার এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে চীনের পাশে থাকবে কে কে।
আশা করা যায় নর্থ কোরিয়া নিশ্চিত ভাবেই থাকবে তার কমরেডদের সাপোর্টের জন্য।
ভারত চীন যুদ্ধ লাগলে পাকিস্তানের মনেপ্রাণে ইচ্ছে থাকলেও নিজের ইকোনোমিক কন্ডিশন এর কথা মাথায় রেখে যুদ্ধে জড়াতে পারবে না। কারণ মনে রাখা প্রয়োজন পাকিস্তান অনেকাংশেই আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল অপরদিকে চীন আর আমেরিকার সম্পর্ক যে বিশেষ ভালো নয় তা তো সকলেরই জানা। সুতরাং যুদ্ধে জড়ানোর মতো এত বড় রিস্ক পাকিস্তান কখনোই নেবে না।
এতগুলো তথ্য পরপর তো সাজানো হলো। এরপর আশা করি বুঝতে পারছেন কেন এতক্ষণ ধরে বলছিলাম ভারত-চীনের থেকে অনেকটাই অ্যাডভান্টেজ এর পজিশনে রয়েছে? পাকিস্তান চীনের মতো শত্রুদের ভারতের দুর্বলতা সৃষ্টি করছে ঠিকই তবে মনে রাখতে হবে তারা নিজেরা কিন্তু ভারতে থেকেও বেশি কোণঠাসা।