ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কেন এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ?
গত ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের হামাস নামক সন্ত্রাসী সংগঠন হঠাৎ ইসরায়েল আক্রমন করে প্রায় এক হাজার সাধারন নিরস্ত্র ইসরায়েলি নাগরিককে নৃশংস ভাবে হত্যা করে এবং কয়েকশো ইসরায়েলি নাগরিককে বন্দি করে নিয়ে যায়। মূলত প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলে আক্রমন করে হামাস। ৭ অক্টোবর হামাস গাজা থেকে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট ছোঁড়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে। ইসরায়েলের আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অধিকাংশ রকেট ধ্বংস করলেও বেশ কিছু রকেট ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হানে। এর জবাবে ইসরায়েল গত ছয়দিন ধরে ক্রমান্বয়ে গাজা উপত্যকায় হামাসের ঘাঁটিতে বোম্বিং করে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ইসরায়েল বায়ু সেনার আক্রমনে অন্তত ১,৫০০ এর বেশী হামাস জঙ্গি মারা গেছে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো।
ইসরায়েলের মানচিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইসরায়েলের উত্তর অংশে রয়েছে সিরিয়া ও লেবানন, পূর্বদিকে রয়েছে জর্ডান এবং দক্ষিন অংশের নীচের দিকে রয়েছে মিশর। ইসরায়েলের এই দক্ষিন অংশে মিশরের উপর একটি ছোট এলাকা রয়েছে যাকে বলা হয় গাজা স্ট্রিপ বা গাজা পট্টি। গাজার উত্তর সীমান্তে ইসরায়েলের সীমানা রয়েছে, দক্ষিন অংশে মিশর এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে ভূমধ্যসাগর অর্থাৎ গাজায় কোন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ইসরায়েল হয়েই বেশী আসে। মাত্র ৪১ কিলোমিটার লম্বা এবং ১০ কিলোমিটারে চওড়া এই গাজা পট্টির জনসংখ্যা প্রায় ২.৩ মিলিয়ন বা ২৩ লক্ষ। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ন জায়গা এই গাজা পট্টি। গাজার আকাশ সীমানা ইসরায়েল ও মিশরের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ মানুষ জাতিসংঘের ত্রানের উপর নির্ভরশীল এবং দশ লক্ষ লোক প্রতিদিন খাদ্যের জন্য জাতিসংঘের উপর নির্ভরশীল। ইসরায়েলের সীমানা হয়েই এসব প্রয়োজনীয় জিনিস গাজায় পৌঁছায়। গাজাতে বিদ্যুৎ ও পানীয় জল সরবরাহ ইসরায়েলই করে। তবে হামাস ইসরায়েলে অমানবিক আক্রমন করায় বর্তমানে গাজায় বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। হামাসের সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য ইসরায়েল উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাকে ২৪ ঘন্টা সময় দিয়েছে দক্ষিন গাজায় চলে যেতে কারন উত্তর গাজায় হামাসের ঘাঁটিতে ইসরায়েল সরাসরি এয়ার স্ট্রাইক করবে এবং সেনা অভিযান করবে। প্যালেস্টাইন দেশটি গঠিত হয়েছে ওয়েস্টব্যাঙ্ক এবং গাজা পট্টি এই দুই এলাকা নিয়ে। গাজা পট্টি এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেট মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৯৪ কিলোমিটার, এর মাঝে রয়েছে ইসরায়েল, অনেকটা ১৯৭১ এট আগে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের যেমন বিচ্ছিন্ন এলাকা হয়েও পাকিস্তান দেশ ছিল ঠিক তেমনি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা পট্টিও বিচ্ছিন্ন এলাকা। যার কারনে প্যালেস্টাইনের এই দুই প্রান্তে দুই রকম সরকার রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে গাজা পট্টির নিয়ন্ত্রন রয়েছে হামাসের হাতে। হামাসের পূরো অর্থ হারাকা আল মুকাওয়ামা আল ইসলামিয়া। মিশরের রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে আলাদা হয়ে ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর হামাস গঠন হয়। আহমেদ ইয়াসিন, আব্দেল আজিজ আল রান্টিসি হামাস গঠন করে। হামাসকে তৈরিই করা হয়েছিল ইসরায়েলে আক্রমনের জন্য। হামাস প্রায়ই গাজা থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়ে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন সহ অধিকাংশ দেশই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষনা করেছে। হামাস সংগঠন সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাগে বিভক্ত। হামাসের সংস্কৃতিক বিভাগকে বলা হয় দাওয়া এবং হামাসের সামরিক বিভাগকে বলা হয় ইজ এড দিন আল কাসাম বিগ্রেড।
প্রথমে হামাসের লক্ষ্য ছিল গাজা পট্টি, ইসরায়েল এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক নিয়ে বৃহত্তর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন কিন্তু সময়ের সাথে ধীরে ধীরে হামাস তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েল সেনাবাহিনী এবং শক্তিশালী ইসরায়েল বায়ুসেনার কাছে বারবার পরজায়ের পর হামাস বুঝে গেছে ইসরায়েলকে হারানো সম্ভব নয় তাই হামাস বর্তমানে দাবি করছে যদি ১৯৬৭ এর আগে প্যালেস্টাইনের যে অংশ ছিল তা যদি ইসরায়েল ফিরিয়ে দেয় তাহলে তারা ইসরায়েলে আক্রমন করা বন্ধ করে দেবে এবং মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবে।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশ গুলোর মধ্যে ছয় দিনের যুদ্ধ হয় যাতে পূ্র্ব জেরুজালেম সহ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের অধিকাংশ এলকা ইসরায়েলের অধীনে চলে আসে। এই পূর্ব জেরুজালেমের টেম্পেল মাউন্টে মুসলিমদের মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান আল আকসা মসজিদ অবস্থিত, এছাড়া এখানে ডোম অফ দি রক নামে আরও একটি পবিত্র স্থান আছে মুসলিমদের। যার কারনে পূর্ব জেরুজালেম হামাস বহু দিন ধরেই দাবি করে আসছে কিন্তু ইসরায়েল হামাসের সমস্ত দাবি অস্বীকার করে দিয়েছে।
হামাসকে অর্থ সহায়তা করে কাতার এবং অস্ত্র দেয় সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন এবং ইরান। হামাস প্রতিবছর যে অর্থ সাহায্য পায় তার ৭০ শতাংশ একা ইরান দেয়। ইরান প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার সহয়তা করে হামাসকে। দক্ষিন লেবাননে হিজবুল্লাহ নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন আছে যারা হামাসকে সমর্থন করে। এই হিজবুল্লাহ এবং হামাসকে ইরান পূর্ন সমর্থন করে। গত ৭ অক্টোবর যখন হামাস ইসরায়েলে আক্রমন করে তখন হিজবুল্লাহও উত্তর ইসরায়েলে আক্রমন করেছিল তবে ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমনে হিজবুল্লাহ পীছু হটে গেছে। হামাসের ইসরায়েলে আক্রমনকে সমর্থন করেছে কাতার, ইরান, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়ামেন। গাজা পট্টি থেকে সিরিয়া, মিশর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় হামাসের অনেক গোপন সুড়ঙ্গ রয়েছে যেখানে হামাসের সন্ত্রাসীরা লুকিয়ে থাকে এবং তাদের রকেট মজুত রাখে। গাজা পট্টি ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে রাজনৈতিক মতবিরোধ রয়েছে প্যালেস্টাইনদের মধ্যে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফতেহ নামে একটি রাজনৈতিক দলের সরকার রয়েছে যার নেতা মহম্মদ আব্বাস।
১৯৯০ এর দশকে ফতেহ এবং হামাসের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। ফতেহ চাইছিলো গাজা পট্টি ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে পূর্ন নিয়ন্ত্রন কিন্তু হামাসের কারনে গাজা পট্টিতে তারা সুবিধা করতে পারেনি দীর্ঘদিন। ফতেহর নেতা ইয়াসির আরাফতের ২০০৪ সালে মৃত্যুর পর ফতেহর মধ্যে নেতৃত্বের সংকট হয়, এর সুযোগে ২০০৪ সালে গাজা পট্টিতে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এবং ২০০৭ সাল থেকে গাজা পট্টি হামাসের নিয়ন্ত্রন চলে যায়, ফতেহ শুধু ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফতেহর সাথে হামাসের মত পার্থক্য আছে। ফতেহ প্রথমে হামাসের মতোই ইসরায়েল বিরোধী ছিল তবে ধীরে ধীরে ফতেহ ইসরায়েলের সাথে সরাসরি যুদ্ধের বদলে আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করতে চায় কিন্তু হামাস ইসরায়েলে প্রায়ই গোরিলা আক্রমন করে। এই কারনে গত ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমনের পূর্ন সমর্থন করেনি ফতেহর নেতা মহম্মদ আব্বাস অবশ্য তিনি পূর্ন বিরোধীতাও করেননি। মহম্মদ আব্বাস এই যুদ্ধের জন্য ইসরায়েলের নীতিকেই দায়ি করেছে।