পৃথিবীর সবথেকে উঁচু স্থানে টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ দেখতে চান!
রাজেশ রায় : আমাদের এই ব্রহ্মান্ড বিশাল বড়। কত লক্ষ তারা, গ্রহ মজুত রয়েছে এখানে? সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে একটাই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছে এই মহাবিশ্বে আমরা কী শুধু একা? নাকী অন্য কোন গ্রহেও প্রান আছে? যার জন্য মহাকাশে অনেক বৈজ্ঞানিক অভিযান চালানো হচ্ছে। সর্বপ্রথম কেপলার টেলিস্কোপ পাঠানো হয় মহাকাশে যার উদ্দেশ্য ছিল এক্সোপ্ল্যানেট খোঁজা অর্থাৎ মহাকাশে আরও অনেক গ্রহের সন্ধান করা। এরপর পাঠানো হয় হাবল স্পেশ টেলিস্কোপ যা আমেরিকান স্পেস এজেন্সি নাসা পাঠায়। হাবাল টেলিস্কোপ পাঠানো হয় ১৯৯০ সালে। সেই থেকে ৩০ বছর ধরে মহাকাশে হাবাল টেলিস্কোপ এমন এমন সব জিনিস খুঁজে যা অবাক করে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের। হাবাল টেলিস্কোপ অনেক ব্রহ্মান্ড আবিষ্কার করেছে, সাথে সাথে ব্রহ্মান্ডের এক্সপানসন, ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করেছে। তবে এবার হাবাল টেলিস্কোপ কে অবসরে পাঠানো হচ্ছে। এবার মহাকাশে পাঠানো হয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এবার একটা প্রশ্ন হচ্ছে টেলিস্কোপ কেনো মহাকাশে পাঠানো হচ্ছে, পৃথিবী থেকেও তো শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তো বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু কোন জায়গা ধরুন মাউন্ট এভারেস্ট থেকে কোন টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ দেখা হচ্ছে কেমন লাগবে জানেন? সমুদ্রের তলায় শুয়ে যদি আপনাকে বলা হয় খালি চোখে বলুন আকাশে কটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। বলতে পারবেন? ব্যপারটা ঠিক তেমনই, পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের জন্য পৃথিবী থেকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না, সেই ডিপ স্পেস মিশনে টেলিস্কোপ পাঠানো হয়।
আগেই বলেছি হাবাল টেলিস্কোপ কে অবসরে পাঠানো হচ্ছে, যার জন্য এর বিকল্প হিসাবে আরও শক্তিশালী, অ্যাডভান্সড জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ লঞ্চ করা হয়েছে। এটা সত্যি যে হাবাল টেলিস্কোপের জন্যই মহাকাশের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ২৪ ডিসেম্বর, ফ্রেঞ্চ গুয়েনা থেকে এরিয়ান -৫ রকেটে করে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ লঞ্চ করা হয়। ভারত ও তাদের কোন হেভি স্যাটেলাইট পাঠাতে এই রকেটই ব্যবহার করে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এখনও পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে জটিল ও উন্নত টেলিস্কোপ, একে ইন্জিনিয়ারিং মার্বেল ও বলা হয়। একে টাইম মেশিন ও বলা হয়। হাবাল টেলিস্কোপ কে পৃথিবীর ৫৭০ কিমি উপরে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কে L2 পজিশনে স্থাপন করা হচ্ছে। আচ্ছা এবার সবাই ভাববেন L2 পজিশন কী? L পয়েন্ট কে ল্যাংরেঞ্জ পয়েন্ট বলে। সাধারনত দুটো কোন বস্তর মধ্যবর্তী পয়েন্ট কে ল্যাংরেঞ্জ পয়েন্ট বলে। যেমন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে এমন কোন পয়েন্ট যেখানে গ্রাভিটেশনাল ফোর্স বা মাধ্যাকর্ষণ বল কাজ করে না। তাই এমন কোন পজিশনে টেলিস্কোপ কে স্থাপন করলে কোন সমস্যা হয় না।
সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে এমন পাঁচটি ল্যাংরেঞ্জ পয়েন্ট আছে যাকে L1, L2, L3, L4, L5 বলা হয়। L1 পয়েন্ট হচ্ছে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যেখানে, L2 পয়েন্ট হচ্ছে পৃথিবীর পেছনে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কে L2 পয়েন্টে স্থাপন করা হচ্ছে যা পৃথিবীর পেছনে প্রায় ওয়ান মিলিয়ন মাইল দূরে বা ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। L2 পজিশনে থাকার জন্য সূর্যের আলো সরাসরি টেলিস্কোপে পড়ে না, ফলে টেলিস্কোপের কোন ক্ষতি হয় না, পৃথিবী যত ঘুরতে থাকে এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ও ঘুরতে থাকে পৃথিবীর সাথে। এছাড়াও সূর্যের আলো থেকে বাঁচার জন্য এই টেলিস্কোপে ২১ ফিট বড় একটি আয়না আছে, ২১ ফিট মানে প্রায় দুতলা বাড়ির সমান উঁচু। এই আয়না ইনফ্রারেড রশ্মি কে অ্যানালিসিস করে গ্রহ, নক্ষত্র, ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে। এই টেলিস্কোপে ব্যবহার করা আয়নার ব্যাস হাবাল টেলিস্কোপে ব্যবহার করা আয়নার তুলনায় ২.৭ গুন বেশী, যা হাবাল টেলিস্কোপের তুলনায় ৬ গুন এলাকা কভার করে। এই আয়না বেরিলিয়াম দিয়ে তৈরি, এই বেরিলিয়ামের উপর প্রায় এক হাজার পরমানু যুক্ত একটি সোনার স্তর রয়েছে। এই পুরো আয়নায় ৪৮.২৫ গ্রাম সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। এই আয়না কে রক্ষা করার জন্য রয়েছে একটি বিশাল ঘুড়ির আকারের সানস স্ক্রিন যা সাইজে একটি টেনিসবল কোর্টের মতন। সূর্যের আলো পড়লে আয়না তে তাপমাত্রা ১১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায় কিন্তু আয়নাটা পুরো ভালভাবে অপারেট করার জন্য – ২০০ ডিগ্রি থেকে -২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দরকার পরে। তাই এই সানস স্ক্রিনের দরকার পড়ে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তৈরির কাজ শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে, আমেরিকান স্পেস এজেন্সি নাসা, সহ ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি ও কানাডার স্পেস এজেন্সি যৌথভাবে এটি তৈরি করেছে। প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বা ৭৬০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই প্রজেক্টে। নাসার ইতিহাসে তাদের দ্বিতীয় প্রধান ডিরেক্টর জেমস এডউইন ওয়েবের নামে এই টেলিস্কোপের নাম জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ রাখা হয়েছে।
অ্যাপোলো মুন মিশনে জেমস এডউইন এর বিশাল অবদান ছিল। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ হাবাল টেলিস্কোপের থেকে একশো গুন শক্তিশালী। এই টেলিস্কোপের জীবনকাল মাত্র দশ বছর। কারন এই টেলিস্কোপ ও টেলিস্কোপে ব্যবহৃত হাইটেক ইনফ্রারেড ডিটেক্টর কে ঠান্ডা রাখার জন্য লিকুইড হিলিয়ামের দরকার পড়ে, আর এতে আগামী দশ বছরের মতনই হিলিয়াম দেওয়া হয়েছে। দশ বছরের বেশী এটা কাজ তখনই করতে পারবে যদি কোন মহাকাশযানে করে কীছু মহাকাশচারী গিয়ে এই টেলিস্কোপে রিফিউল করে। কিন্তু ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে মানুষের যাবার মত এখনও কোন মহাকাশযান তৈরি হয় নি। এই টেলিস্কোপ কতটা শক্তিশালী একটা উদাহারন দিলে বুঝবেন, এই টেলিস্কোপের সাহায্যে পৃথিবী থেকে চাঁদে একটি মাছি কে পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের শুধু আয়নাই বলেছি ২১ ফিট তাহলে ভাবুন গোটা টেলিস্কোপ কত বড় হতে পারে! কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন এরিয়ান -৫ রকেটে এত বিশাল টেলিস্কোপ বহন করা সম্ভব না, তাহলে এই আশ্চর্য সম্ভব হল কী ভাবে? এই পুরো টেলিস্কোপ কে এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে একে পুরো একটা কাগজের মতন ভাজ করে মহাকাশে পাঠানো যায়। এরিয়ান -৫ একে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে পৌঁছে দিয়ে এসেছে, এখানে পৌঁছানোর পর টেলিস্কোপটির সোলার প্যানেল খুলে গেছে, যাতে এই টেলিস্কোপটির L2 পয়েন্টে পৌঁছানার জন্য ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়ে যায়, প্রায় একমাস সময় লাগবে L2 পয়েন্টে পৌঁছাতে। এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ৫০ টি কম্পোনেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে এবং ১৫০ টি মেকানিজম রয়েছে, একবার L2 পয়েন্টে পৌঁছানোর পর এটির সব ভাজ আস্তে আস্তে খুলবে। যদি কোন একটি ভাজ না খোলে সাথে সাথে টেলিস্কোপটি অচল হয়ে যাবে। ভাবুন ২০ বছরের পরিশ্রম, ১০ বিলিয়ন ডলার এক মহূর্তে শেষ তাহলেই ভাবুন রিস্ক কতটা। একজন্য জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কে ইন্জিনিয়ারিং মার্বেল বলা হয়। এটা পুরোপুরি অপারেশনাল হতে এখনও ছয়মাস সময় লাগবে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ প্রায় ১৩ বিলিয়ন সাল পুরোনো সময় কে দেখতে পারবে, হ্যা শুনে চমকে গেলেন তো কিন্তু এটাই সত্যি যার জন্য একে টাইম মেশিন ও বলা হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় বিগব্যাং থিওরিই হচ্ছে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির কারন। ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পর প্রথম যে নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল তাকেই খুঁজবে এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। সমস্ত ব্রহ্মান্ডে আর কোথাও প্রানের অস্তিত্ব, জল আছে কীনা সেটাও সন্ধান করবে।