ছোট এবং মাধ্যম আয়ের দেশ গুলোকে কেন লোণের ফাঁদে ফেলছে চীন?
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওস। শ্রীলঙ্কার মতই লাওসেও জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে শ্রীলঙ্কান সঙ্কট আমরা দেখেছি শ্রীলঙ্কান সরকারের নীতি ও চীনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারনে শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে চরম সংকট চলছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস সহ ওষুধ, ইলেকট্রিসিটি সব কিছুর অভাব শ্রীলঙ্কায় এই মহূর্তে। লোক ঘন্টার পর ঘণ্টা তেলের জন্য লাইনে দাড়িয়ে আছে। এসব চিত্র, ভিডিও আজ সবাই দেখছে। ভারত শ্রীলঙ্কাকে প্রয়োজনীয় জিনিস, অর্থ দিয়ে অনেক সাহায্য করেছে। শ্রীলঙ্কার মত এবার লাওসের অবস্থাও হতে চলেছে। সম্ভবত লাওস এশিয়া তে তৃতীয় দেওলিয়া দেশ হতে চলেছে। আজ লাওসের এই অর্থনৈতিক অবস্থার কারন সম্পর্কেই আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও জানবেন যে এর জন্য চীন দায়ী কীনা? কারন চীন তার ইউয়ান ডিপ্লোম্যাসি বা ডেব্ট ট্রাপ ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে ছোট ও মধ্যম আয়ের দেশ গুলোকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে, লাওস তারই স্বীকার কীনা জানব। সবশেষে ভারত ও লাওসের সম্পর্কের ব্যাপারেও একটু আলোচনা করা হবে।
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট দেশ লাওস। লাওস একমাত্র আসিয়ান দেশ যার কোন জলসীমা নেই মানে পুরো ল্যান্ডলক দেশ। লাওসের চারদিকে রয়েছে মায়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড। এই চারটি দেশ ছাড়া চীনের সাথেও সীমান্ত রয়েছে লাওসের। লাওস একটি কমিউনিস্ট দেশ যার জন্য চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশী লাওসের। চীনের মতই লাওসে একটিই রাজনৈতিক দল আছে লাওস পিপিলস রেভোলিউশোনারি পার্টি বা এলপিআরপি যার প্রধান রাষ্ট্রপতি থংলুন সিসোউলিথ। লাওসের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে ফানখাম ভিপাভান। এখানের অন্যন্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্সের সাথে চীনের ঝামেলা আছে যার কারন দক্ষিন চীন সাগর যা চীন নিজের বলে দাবি করে। লাওস এব্যাপারে খানিকটা চীনকেই সমর্থন করে বলে এই ব্যাপার আলোচনা করে সমাধান করতে কারন কমিউনিস্ট সরকার থাকায় লাওস চীন ঘেঁষা। সম্প্রতি লাওসের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ, জ্বলানির ভান্ডার এতটাই কমে গেছে যে এই প্রথম দেশটির জনগনের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। সাধারনত কমিউনিস্ট দেশে বাক স্বাধীনতা থাকে না কিন্তু বর্তমানে দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসকদের বিরুদ্ধে জনগন ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে। আমেরিকার ব্যাবসায়িক ও অর্থনৈতিক সংস্থা মুডি জানিয়েছে লাওস হয়ত তাদের লোনও শোধ করতে পারবে না। আমেরিকান ডলারের বিপরীতে লাওসের মুদ্রার মান ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লাওসের কারেন্সি কে বলা হয় লাও কিপ। বর্তমানে ১ ডলার এর বিপরীতে প্রায় ১৫,০০০ লাও কিপ অর্থাৎ লাওসের অবস্থা প্রতিদিন অবনতি হচ্ছে। বানিজ্য প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে কারন বৈদেশিক মুদ্রা নাই। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি চরম আকাটে পৌঁছেছে। গত জানুয়ারিতে লাওসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.৫ শতাংশ কিন্তু জুন আসতে আসতে তা পৌঁছেছে ১৬ শতাংশে। ভারতে যখন মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশে পৌঁছায় তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া পদক্ষেপ নেয় যার জন্য এখন ভারতে মুদ্রাস্ফীতি রেট ৬ শতাংশের আশেপাশেই আছে।
এবার জানা যাক লাওসের এই অবস্থার কারন কী? দেখুন করোনা মহামারীর পর গোটা বিশ্বেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়, ভারতের ও অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল। তবে করোনার সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে বিশ্ব ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে কিন্তু লাওস পারে নি। এরপর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বিশ্বের তেলের দাম অত্যাধিক বেড়ে গেছে, যার জন্য বৈদেশিক লোনের ভারে ক্রমশ ডুবতে শুরু করেছে লাওস। লাওসের কমিউনিস্ট সরকার লাওসকে গোটা বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। লাওস পশ্চিমা দেশ গুলোর সাথে বানিজ্য করেই না তেমন, বরং লাওসের সাথে বানিজ্য হয় চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের। চীনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল লাওস। ২০২০ সালে লাওস তার ইলেকট্রিক গ্রিডের বেশীরভাগের দায়িত্ব একটি চীনা সংস্থার উপর দিয়ে দেয়। এই মহূর্তে লাওসে শুধু চীনেরই বিনিয়োগ ১৬ বিলিয়ন ডলার। লাওসের জিডিপি মোটামুটি ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় জিডিপির সমানই বিনিয়োগ এসেছে লাওসে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ এর শেষেই লাওসের ঘরোয়া প্রোডাক্টের তুলনায় লোন ৮০ শতাংশে পৌঁছে গেছিল এবং বৈদেশিক লোন ১৪.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছিল। লাওসের মোট বৈদেশিক লোনের ৪৭ শতাংশই চীনের। অর্থাৎ লাওসের উপর ১০০ টাকার লোন থাকলে তার ৪৭ টাকাই শুধু চীনের। আমেরিকার ক্রেডিট এজেন্সি ফিচ লাওসকে সিসিসি রেটিং দিয়েছে যা সবচেয়ে খারাপ। ফিচ আরও জানিয়েছে ২০২১ সালে লাওসের লোন পরিশোধ বাকী ৪২২ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ থেকে ২০২৫ অবধি প্রতিবছর ১.১৬ বিলিয়ন ডলার করে লোন শোধ করতে হবে। সম্প্রতি দেওলিয়া হবার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানকে ২.৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে চীন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কিন্তু ভারত সবার আগে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করে, চীন এখান থেকে সরে গেছে। মনে করা হচ্ছে আর্থিক দেওলিয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চীন হয়ত লাওসকেও সাহায্য করবে। কারন লাওস এবং পাকিস্তানের অবস্থান চীনের জন্য স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান একটি পরমানু শক্তিধর দেশ এবং পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর সহ সিপেক প্রজেক্টে চীন অনেক বিনিয়োগ করেছে, সবচেয়ে বড় কথা ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান চীনের বড় হাতিয়ার। অন্যদিকে আসিয়ান গ্রুপের মধ্যে অবস্থিত লাওস ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ চীনের জন্য। কিন্তু এখানে একটা বড় জিনিস ভাববার আছে, চীনের ডেব্ট ট্রাপে পড়ছে একটার পর একটা দেশ যেমন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, লাওস ও উগান্ডা। চীন কটা দেশ কে বাঁচাবে?? শেষে চীনের নিজের অর্থনৈতিক অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং এটা দেখার চীনের এই ডেব্ট ট্রাপ ডিপ্লোম্যাসির এই বিশাল খেলায় চীন কটা দেশকে সাহায্য করতে পারে।
তবে শ্রীলঙ্কাকে যেমন ভারত খাদ্য, ওষুধ, তেল ও অর্থ দিয়ে ভারত সাহায্য করেছে ততটা হয়ত লাওসকে করবে না কারন লাওসের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্ক থাকলেও লাওস অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। উত্তর পূর্ব ভারতের বাজরের জন্য কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও মায়ানমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তবুও ভারতের নেবারহুড ফাস্ট নীতি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কা লাওসের থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভারতের কাছে। ভারত ও লাওসের মধ্যে বছরে মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয় তাও ভারত নিজেই ইলেকট্রনিক্স, আইটি সহ ৩৯ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে এবং মাত্র ১ মিলিয়ন ডলার আমদানি করা হয়। তবে আসিয়ান দেশ হিসাবে ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লাওস। ১৯৯৪ থেকেই ভারতের সাথে লাওসের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে কারন লাওসের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম, সেই সূত্র ধরে ভারতের সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। বলা হয় ভারত দুটি মাদক পাচার চক্র এলাকার মধ্যে ফেঁসে আছে। একদিকে রয়েছে গোল্ডেন ক্রিসিন্ট যার অংশ আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান এবং একদিকে রয়েছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল যার অংশ লাওস, থাইল্যান্ড ও মায়ানমার। আসলে এই তিনটি দেশের সীমান্ত মিশেছে মেকং নদী এলাকায়। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল নাম দিয়েছে আমেরিকার সিআইএ। প্রায় ৯,৫০,০০০ স্কেয়ার কিলোমিটার এলাকাকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বলা হয় কারন এই গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসিন্টকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ড্রাগ রুট। এখান দিয়েই সবচেয়ে বেশী হেরোইন, কোকেন পাচার হয়। এই মাদক চক্র বন্ধ করার জন্য লাওসের সাথে চুক্তি হয়েছে ভারতের। তবুও কোথাও না কোথাও ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার যা সম্পর্ক লাওস ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় ভারতের কাছে।