সুয়েজ খালের কারনেই ব্রিটেনের থেকে আমেরিকার হাতে সুপার পাওয়ার হস্তান্তরিত হয়েছিল
আন্তর্জাতিক বানিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ হচ্ছে সুয়েজ খাল। বিগত ১৫০ বছরে এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হোক কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই হোক। তবে ১৯৫৬ সালে এখানে সবচেয়ে বড় জিওপলিটিক্যাল সমস্যা তৈরি হয় যাকে সুয়েজ খাল সংকট বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবারও ব্রিটেনের সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠার মূলে প্রধান বাধা ছিল এই ঘটনা। এই সংকট কী করে তৈরি হল, কারা দায়ী এর জন্য!
সুয়েজ খাল মিশরে অবস্থিত, এটি একটি কৃত্রিম খাল যা ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করে, এছাড়া এটি এশিয়া ও আফ্রিকার বিভক্তকারী খালও। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বানিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সুয়েজ খাল। এখানে রয়েছে অ্যাকোবা উপসাগর যার তীরে তীরান প্রনালী অবস্থিত। যদি ইসরায়েলকে এশিয়া পৌঁছাতে হয়, তাহলে দক্ষিনে লোহিত সাগর পৌঁছে তুরিন প্রনালী হয়েই যেতে হবে। এজন্য এটি ইসরায়েলের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিশর এখানে ব্লক করে দিয়েছিল একবার যাতে ইসরায়েল লোহিত সাগর পৌঁছাতে না পারে। ইসরায়েলের বিতর্কিত গাজা উপত্যকার সাথে মিশরের ১৫ কিলোমিটার সীমনা আছে। ১৯৫০ এর দশকে মিশর প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করত, যদিও এখনও করে তবে তখন অনেক বেশী সমর্থন করত। প্রায় ১৯৪ কিলোমিটার লম্বা সুয়েজ খাল নির্মান শুরু হয় ১৮৫৯ সালে এবং শেষ হয় ১৮৬৯ সালে। সুয়েজ খালের দক্ষিনে সুয়েজ বন্দর থেকে সৈয়দ বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত এই খাল। ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর সুয়েজ খাল সংকট তৈরি হয় যা শেষ হয় ১৯৫৭ সালের মার্চে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই যখন মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খালের জাতীয়করন করে দেয়। এরপরই ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইসরায়েলের সেনা যৌথভাবে মিশরের উপর আক্রমন করে দেয়। শেষপর্যন্ত আমেরিকা, জাতিসংঘ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে এই ঝামেলা বন্ধ হয়। একে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় জিওপলিটিক্যাল সংকট বলা হয়। এরপরেই আমেরিকা আরও বেশী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে এই ব্যাপার এত সাধারন ভাবে মেটেনি, এর পেছনে অনেক কাহিনী আছে।
প্রথমে সুয়েজ খালের সম্পর্কে একটু জানা যাক। সুয়েজ খাল তৈরির চেষ্টা অনেকবার হয়েছে তবে সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ সালে ফ্রেঞ্চ ডিপ্লোম্যাট ফার্ডিনান্ড দ্যে লেসপস সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানি তৈরি করে এবং মিশরের পাশার থেকে অনুমতি নিয়ে সুয়েজ খাল তৈরি শুরু করে যা সম্পন্ন হতে দশ বছর লাগে। সেসময় মিশর অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল এবং মিশর ও সুদানের যৌথ শাসককে পাশা বলা হত। সুয়েজ ক্যানেল তৈরি একটি ইন্জিনিয়ারিং মার্বেল কারন মরুভূমির বুকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার লম্বা ক্যানেল তৈরি সত্যিই কঠিন ব্যাপার। পরবর্তী ৯৯ বছরের জন্য এই সংস্থাটিকে সুয়েজ ক্যানেল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ক্যানেলের মধ্যে দুটি বড় লেক আছে লেক তিসমা ও গ্রেট বিটার লেক। এই ক্যানেল তৈরির ফলে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৮৫০০ কিলোমিটার কমে যায়। লন্ডন থেকে মুম্বাই আসতে যদি ২০,০০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় তাহলে সুয়েজ ক্যানেল হয়ে যেতে মাত্র ১১৫০০ কিলোমিটার লাগবে। সুয়েজ খালের সবচেয়ে বেশী লাভ ব্রিটিশদের হয়। যদিও প্রথমদিকে ব্রিটিশরা এর বিরোধীতা করেছিল কারন তারা ভেবেছিল এই খাল তৈরির ফলে এবার বোধহয় সবাই ভারতে বানিজ্য করতে আসবে এবং তাদের প্রভাব কমে যাবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এই সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানিতে অনেকের শেয়ার ছিল তবে সবচেয়ে বেশী অংশ ছিল ফ্রান্সের।
মিশরের পাশারও এতে অংশ ছিল। কিন্তু ১৮৭৫ আসতে আসতে পাশা ইসমাইলের প্রচুর লোন হয়ে যায় যার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে পাশা তার ৪৪ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয়, এভাবে সুয়েজ খালে যুক্ত হয় ব্রিটিশরা। ১৮৮২ সালে মিশরে পাশার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় যাকে বলে উরাবি বিদ্রোহ। এই উরাবি একজন সেনা অফিসার ছিল। পাশা ব্রিটেনের কাছে সাহায্য চায়, ব্রিটেন তার সেনা মিশরে পাঠিয়ে বিদ্রোহ দমন করে। এইভাবে মিশরে ব্রিটেন নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। ১৯২২ সালে মিশরকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তবে এই স্বাধীনতা ছিল নাম মাত্র তখনও মিশরে ব্রিটেনের বিশেষ প্রভাব ছিল। ১৯৩৬ সালে মিশর ও ব্রিটেনের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাতে বলা হয় ১৯৫৬ অবধি সুয়েজ খালের দায়িত্ব থাকবে ব্রিটিশদের উপর। ব্রিটিশদের কাছে সুয়েজ খালের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল কারন ভারতের সাথে তাদের বানিজ্য এই পথেই হত, সুয়েজ খাল দিয়ে পার হওয়া মোট জাহজের ৬০ শতাংশই ব্রিটিশ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এই সুয়েজ খাল ব্রিটিশরাই রক্ষা করেছিল। ১৯৪০ এর পর থেকে ব্রিটিশদের উপর মিশরীয়দের ক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং মিশরে থাকা ব্রিটেনের সেনা ছাউনিতে ছোটখাটো আক্রমন হতে থাকে। মিশরীয়দের বক্তব্য ছিল ব্রিটেন সুয়েজ খাল ছেড়ে চলে যাক। এবার মনে হতে পারে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল তাহলে এখানে ব্রিটিশদের কী কাজ! ১৯৩০ এর দিকে আরব দেশ গুলোতে পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায় এবং তেলের বানিজ্য এই পথ দিয়েই হত সেজন্য ব্রিটিশদের কাছে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। ১৯৫২ সালে মিশরে বিশাল বিপ্লব ঘটে যাতে মিশরে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৫৬ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মিশরের রাষ্ট্রপতি হয় গামাল আব্দেল নাসার। পুরো আরব বিশ্বের এক করার জন্য গামাল অনেক চেষ্টা করেছিল। গামাল তার জীবনে এমন এমন কাজ করেছিল যারজন্য ১৯৭০ অবধি মিশরের রাষ্ট্রপতি থাকা পর্যন্ত গামালকে মধ্য প্রাচ্যে সবচেয়ে বড় নেতা হিসাবে দেখা মানা হত। ১৯৫৪ সাল থেকেই মিশরের মিলিটারি ব্রিটেনের উপর চাপ দিতে শুরু করে মিশর থেকে সেনা সরিয়ে নেবার জন্য। এই সময় মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ছোট খাটো ঝামেলা হচ্ছিলই। গামাল নাসের পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরোধী ছিল। আসলে ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল তৈরি হবার পর থেকে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল যার মধ্যে মিশরও ছিল। এইসময়ই গামেল নাসার সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। সেসময় বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলায় আমেরিকা ও পশ্চিমাদেশ গুলো মিশরের উপর ক্ষুব্ধ হয়। তবে গামাল নাসারের লক্ষ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা দুজনকেই ব্যাবহার করে সুবিধা নেওয়া। নাসার সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ হয়েছিল আমেরিকার কারনে।