ভারত

ভারতবর্ষের প্রধান যুদ্ধবিমান সুখইকে শক্তিশালী করতে কোন গোত্রের মিসাইল মোতায়েন?

রাজেশ রায়ঃভারতীয় বিমানবাহিনী তে সার্ভিসে থাকা অন্যতম ঘাতক যুদ্ধবিমান হচ্ছে সুখোই-৩০ এমকেআই। ভারতীয় বিমানবাহিনীর মেরুদণ্ড বলা হয় এই সুখোই -৩০ এমকেআই কে।

রাশিয়ার সুখোই করপোরেশনের তৈরি এই সুখোই-৩০ পৃথিবীর অন্যতম সেরা চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। এর ন্যাটো নাম ফ্ল্যাঙ্কার -এইচ। আচ্ছা এখানে একটা মজার কথা বলি এই ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন তৈরি হয়েছিল ১৯৪৯ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে। ততকালীন সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নকে আটকাবার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মিলে এই সংস্থা তৈরি করেছিল। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই কিন্তু ন্যাটো রয়ে গেছে। ন্যাটো রাশিয়ার যেকোন প্রোডাক্ট এর নাম পরিবর্তন করে নিজেদের ইচ্ছেমত একটা নাম রাখে। যেমন দেখুন না গোটা বিশ্ব যে বিমান কে সুখোই -৩০ বলে সেটাকে ন্যাটো ফ্ল্যাঙ্কার-এইচ বলে। এবার আপনাদের মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে কখনও আমরা সুখোই-৩০ এমকেআই আবার কখনও আমরা সুখোই-৩০ কেনো বলছি দেখুন দুটি ভার্সন আলাদা। রাশিয়ার সুখোই কর্পোরেশন তৈরি করেছে সুখোই-৩০ নামে বিমনাটি এবার বিভিন্ন দেশ কেনার পর এই বিমানটিতে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী আপগ্রেড বা মডিফিকেশন করেছে যার জন্য বিভিন্ন দেশের বিমানবাহিনী তে বিমানটির ভার্সন আলাদা। যেমন রাশিয়ান বিমানবাহিনীর সুখোই -৩০ এর নাম সুখোই-৩০ এসএম, ভারতীয় বিমানবাহিনীতে এর নাম সুখোই-৩০ এমকেআই আবার চাইনিজ বিমানবাহিনী তে এর নাম সুখোই-৩০ এমকেকে / এমকেটু।

সুখোই-৩০ এমকেআই প্রজেক্ট শুরু হয় ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে। সুখোই-২৭ বিমানের উপর নির্ভর করে এবং সুখোই-৩৭ নামে একটি প্রোটোটাইপ এবং সুখোই -৩০ বিমানের টেকনোলজির মিশ্রনে সুখোই-৩০ এমকেআই বিমান তৈরি করা হয়েছে। সুখোই-৩৭ তৈরি করা হয়েছিল সুখোই-২৭ এম নামক একটি বিমানের পাইলট ট্রেনিং এর জন্য। এই সুখোই-২৭ এমকে এখন সুখোই-৩৫ বলা হয়। সুখোই-৩০ এমকেআই এবং সুখোই-৩৫ এ অনেক সাদৃশ্য আছে। এই সুখোই-৩০ এমকেআই চাইনিজ ভার্সন এমকেটু এর থেকেও অত্যাধুনিক। রাশিয়া নিজের বিমানবাহিনীতেও এই বিমান ব্যবহার করে যার নাম সুখোই-৩০ এসএম। ভারতীয় সুখোই-৩০ এমকেআই এর অ্যাভনিক্স, ডিসপ্লে, নেভিগেশন, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট তৈরি করেছে রাশিয়া, ভারত, ইসরায়েল ও ফ্রান্স। 

১৯৯৬ সালের ৩০ নভেম্বর ভারত রাশিয়ার সাথে ১.৪৬২ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করে ৫০ টি সুখোই-৩০ এমকেআই ক্রয় করার। মোট পাচটি ব্যাচে এই সুখোই-৩০ এমকেআই সাপ্লাই দেওয়া হয় ভারত কে। প্রথম ব্যাচে আসে আটটি সুখোই-৩০ এমকে যা একদম বেসিক ভার্সন,  দ্বিতীয় ব্যাচে আসে ১০ টি সুখোই -৩০ এমকেআই যাতে ইসরায়েল ও ফ্রান্সের অ্যাভনিক্স ছিল। তৃতীয় ব্যাচে আসে ১০ টি সুখোই -৩০ এমকেআই যাতে ক্যানার্ড ছিল, চতুর্থ ব্যাচে আসে ১২ টি সুখোই -৩০ এমকেআই এবং শেষ ব্যাচে আসে ১০ টি সুখোই -৩০ এমকেআই যাতে AL-31 ইঞ্জিন ছিল।

এই মহূর্তে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে মোট ২৬০ টি সুখোই -৩০ এমকেআই রয়েছে। ভারত মোট ২৭২ টি সুখোই -৩০ এমকেআই অর্ডার দিয়েছিল কিন্তু ১২ টি সুখোই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যায়। ২৭২ টি সুখোই এর মধ্যে রাশিয়া থেকে সরাসরি কেনা হয় ৫০ টি এবং বাকী ২২২ টি লাইসেন্স নিয়ে ট্রান্সফার অফ টেকনোলজির মাধ্যমে হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড ভারতেই তৈরি করেছে। হ্যালের কোরাপুট ডিভিশনে সুখোই এর AL-31 ইন্জিন তৈরি হয়, লক্ষনৌ ও হায়দ্রাবাদে বিমানের অন্যান্য পার্টস তৈরি হয় এবং নাসিকে ফাইনাল ইন্ট্রিগেশন ও টেস্টিং হয়। 

ভারত ১৯৯৬ সালে ৫০ টি সুখোই -৩০ এমকেআই অর্ডার দিয়েছিল, ২০০০ সালে ১৪০ টি সুখোই এর অর্ডার দেওয়া হয়, ২০০৭ সালে আরও ৪০ টি সুখোই এবং ২০১০ সালে ৪২ টি সুখোই ৩০ এমকেআই এর অর্ডার দেওয়া হয়। 

বিমানটিতে ২ টি AL-31 ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে যা ১২৩ KN থ্রাস্ট উৎপন্ন করতে সক্ষম। এর সর্বোচ্চ গতি ২১২০ কিমি/ঘন্টা। এর রেঞ্জ ৩০০০ কিমি। 

অস্ত্র ভান্ডার:- সুখোই ৩০ এমকেআই এ মোট ১২ টি হার্ড পয়েন্ট আছে। এতে অস্ত্র হিসাবে S8, S13 রকেট এবং এয়ার টু এয়ার মিসাইল হিসাবে রাশিয়ান R-77, R-73, R-27 মিসাইল,  ইসরায়েলের I derby ER মিসাইল, ভারতের অস্ত্র মার্ক ১ মিসাইল ব্যবহার করা হয়। এয়ার টু সারফেস মিসাইল হিসাবে রাশিয়ান kh-59, kh-29 মিসাইল ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টি শিপ মিসাইল হিসাবে রাশিয়ান Kh-35, kh-31A ও রাশিয়া-ভারতের যৌথভাবে তৈরি  ব্রাহ্মস মিসাইল ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টি রেডিয়েশন মিসাইল হিসাবে রাশিয়ান kh-31 p ও ভারতীয় রুদ্রম-১  মিসাইল ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এতে বোম্ব হিসাবে রাশিয়ান Kab-500, kab-1500, ভারতীয় সুদর্শন লেজার গাইডেড বোম্ব, ইসরায়েলের স্পাইস-২০০০, ডিআরডিও এর SAAW এবং FAB -৫০০ বোম্ব ব্যবহার করা হয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুখোই -৩০ এমকেআই কে আরও ঘাতক করে তোলা হবে। যার জন্য সুপার সুখোই নামে একটি প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী তে এখন ২৬০ টি সুখোই -৩০ আছে। ভারত রাশিয়া থেকে আরও ৫০ টির মতন সুখোই -৩০ এমকেআই কিনতে পারে। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় বিমানবাহিনী তে ৩০০+ সুখোই ৩০ এমকেআই থাকতে চলেছে। সুপার সুখোই প্রজেক্টের আওতায় ২০০ টি সুখোই ৩০ এমকেআই কে সুপার সুখোইয়ে আপগ্রেড করা হবে৷ এতে মোট ১৫-১৭ বিলিয়ন ডলার খরচা হবে। 

সুপার সুখোই প্রজেক্ট অফিসিয়ালি এখনও শুরু হয় নি কিন্তু এই ইতিমধ্যেই সুখোই এ অনেক আপগ্রেড করা হচ্ছে। ২০১৯ এ পাকিস্তানের বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইকের পর থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লীট কে ব্যাপক ভাবে আপগ্রেডেশন করা হচ্ছে। সুখোই এ যেসব আপগ্রেড করা হয়েছে ও ভবিষ্যতে যেসব আপগ্রেড করা হবে 

* সুখোই ৩০ এমকআই এর জন্য ইসরায়েল থেকে SDR বা সফটওয়্যার ডিফাইন রেডিও ক্রয় করা হয়েছে। শত্রু দেশ এসব রেডিও গুলোকে জ্যাম করতে পারবে না।

* সবচেয়ে দারুন আপগ্রেড হচ্ছে রাশিয়ান SAP-14 এসকর্ট জ্যামার। এই লো ফ্রিকুয়েন্সি জ্যামার আমেরিকার বিখ্যাত বোয়িং EA-18G গ্রোলিয়ারের ALQ-99 জ্যামারের সমান এটা। পুরো একটা মাস্টারপিস। এই SAP-14 শত্রুর সারভিলেন্স রেডার কে জ্যাম করে যাতে শত্রু বুঝতেও পারে না তাদের আকাশ সীমায় বিদেশী বিমান এসে উপস্থিত হয়েছে। 

ওসামা বিন লাদেন কে যখন আমেরিকা পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে মেরে আসে তখন পাকিস্তান বুঝতেও পারে নি। কেন এটা হয়েছিল জানেন? প্রথমে আমেরিকার গ্রোলিয়ারের ALQ-99 জ্যমার পাকিস্তানের সমস্ত সারভিলেন্স রেডার কে জ্যাম করে দেয় তারপর ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারে করে আমেরিকার সৈন্য পাকিস্তানে ঢোকে ও লাদেন কে মেরে চলে আসে, পাকিস্তান টের ও পায় নি। 

SAP-14 ঠিক তেমনই একটি মাস্টারপিস যা ভারত সুখোই এ ইনস্টল করেছে। SAP 14 এর পাশাপাশি সুখোই-৩০ এমকেআই এ ইসরায়েলের EL/L  8222 HB সেল্ফ প্রোটেকশন জ্যামার ও রাশিয়ান SAP-518 হাইব্যান্ড জ্যামার রয়েছে যাকে ভবিষ্যতে ডিআরডিও এর নিজস্ব তৈরি হাইব্যান্ড জ্যামার দিয়ে রিপ্লেস করা হবে। তাহলেই ভাবুন সুখোই ৩০ এমকেআই কতটা শক্তিশালী।

* ডিআরডিও এর তৈরি উত্তম এসা রেডার ব্যবহার করা হবে ভবিষ্যতে যা এর মারন ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দেবে।

* ভারত ইলেকট্রনিক সিস্টেম এর তৈরি ইনফ্রারেড সার্চ এন্ড ট্রাক (IRST) টেকনোলজি ভবিষ্যতে যুক্ত করা হবে।

* হ্যালের তৈরি নতুন আপগ্রেডেড ককপিট ও নতুন ডিজিটাল ফ্লাইট কনট্রোল কম্পিউটার ইনস্টল করা হবে। 

* এয়ার টু এয়ার মিসাইল হিসাবে ভবিষ্যতে অস্ত্র মার্ক ২ মিসাইল ইনস্টল করা হবে যা রাশিয়ান R-77,R-27 কে রিপ্লেস করবে।

* ব্রাহ্মস এনজি ও নির্ভয় মিসাইল যুক্ত করা হবে।

মোটামুটি ২০৪০ সাল থেকে সুখোই ৩০ এমকেআই অবসরে যাবে। অর্থাৎ আগামী দশকেও ভারতের আকাশে দাপটের সাথে রাজত্ব করবে সুখোই। সুখোই ৩০, রাফায়েল ও তেজসের কম্বিনেশন রীতিমতো শত্রুর রাতের ঘুম উড়িয়ে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.