ভারত

পরমানু সাবমেরিন লিজ নিয়ে কেন সমস্যায় ভারতবর্ষ?

রাজেশ রায়: ভারতীয় নেভি ২০১২ সালে রাশিয়া থেকে লিজ নেওয়া আকুলা ক্লাস নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন আইএনএস চক্রে ২০১৮ সালে প্রথমবারের জন্য আমেরিকার টেকনিক্যাল টিমকে প্রবেশাধিকার দেয় যা নিয়ে রাশিয়ান সরকার সেই সময় ভারতের উপর ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু পরে জানা যায় এটা একটা গুজব ছিল কিন্তু তা হলেও দীর্ঘ সময় ধরে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এনিয়ে একটা বিতর্ক চলেছিল। বর্তমানে আইএনএস চক্র রাশিয়ায় ফিরে গেছে কারন দশ বছরের জন্য লিজ ছিল। আরও একটি আকুলা ক্লাস সাবমেরিন আগামী দুই বছরের মধ্যে ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হবে যার জন্য ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে তিন বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এতক্ষণ যে এই বিষয়টা বললাম তার একটাই কারন ভারতের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন পোগ্রামের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে বলে। কোন দেশ থেকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন লিজ নিলে তার অনেক শর্ত থাকে যেমন সেই সাবমেরিন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা যাবে না, অন্য কোন দেশের টেকনোলজি ইনস্টল করা যাবে না। সেই জন্য ভারত নিজস্ব নিউক্লিয়ার সাবমেরিন পোগ্রাম শুরু করেছে অনেক আগেই। আজ এটা সম্পর্কেই জানব।

প্রথমেই জানা যাক নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন কী এবং কত প্রকার। সাবমেরিন সাধারনত দুই ধরনের হয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার ও কনভেনশনাল ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক। নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিনে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টার থাকে শক্তির জন্য। নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন একটি ইলেকট্রিক সাবমেরিনের তুলনায় অনেক বেশীদিন জলের তলায় থেকে অনেক দুরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম। এইজন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিনকে সবচেয়ে ঘাতক সাবমেরিন বলা হয়। এই রকম সাবমেরিন টেকনোলজি অনেক জটিল এবং বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশের কাছেই এই প্রযুক্তি আছে, ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। 

** এসএসবিএন বা সাবমারসিবেল শিপ ব্যালেস্টিক মিসাইল নিউক্লিয়ার। এটা শুধু মাত্র স্ট্রাটেজিক্যালি ব্যবহার করা হয়। এটি পরমানু ওয়ারহেড যুক্ত মিসাইল বহন করে। এটি শুধুমাত্র সমুদ্র থেকে কোন দেশে পরমানু আক্রমনের জন্য ব্যবহৃত হয়। একটি এসএসবিএন প্রায় ২৪ টি আইসিবিএম বহন করতে সক্ষম। 

** এসএসএন বা সাবমারসিবেল শিপ নিউক্লিয়ার। এটি ফাস্ট অ্যাটাক সাবমেরিন যা পরমানু অস্ত্র বহন করে না বরং ক্রুজ মিসাইল বহন করে। এটি শত্রুর যুদ্ধজাহাজ, ল্যান্ড টার্গেট ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়। ভারত রাশিয়া থেকে যে আকুলা ক্লাস সাবমেরিন লিজ নিয়েছে, যাকে আইএনএস চক্র বলা হয়, এটি এসএসএন ক্লাস সাবমেরিন। 

** এসএসজিএন বা সাবমারসিবেল শিপ গাইডেড নিউক্লিয়ার। এটি বর্তমান যুগের হাইব্রিড সাবমেরিন। এটি প্রচুর পরিমানে ক্রুজ মিসাইল বহন করে। এসএসবিএন সাবমেরিনকে আপগ্রেড করে এসএসজিনে পরিনত করা যায়। 

এবার আসা যাক ভারতের নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন পোগ্রামে। আগেই বলেছি ভারত আইএনএস চক্র লিজে নিয়েছে রাশিয়া থেকে। ভারতই বিশ্বের প্রথম কোন দেশ যারা পরমানু সাবমেরিন লিজে নিয়েছে। পরমানু সাবমেরিন অত্যন্ত জটিল ও অ্যাডভান্সড প্রজেক্ট যার জন্য এই ধরনের সাবমেরিন বিক্রি করা হয় না কিন্তু ভারত ও রাশিয়ার গভীর বন্ধুত্বের কারনে রাশিয়া এই ধরনের সাবমেরিন লিজে দিয়েছিল। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভারত প্রথম নিউক্লিয়ার সাবমেরিন লিজে নেয়। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত ছিল। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৭ অবধি ভারতের নেভাল ফ্লীটের ৭০ শতাংশ ইকুইপমেন্টই রাশিয়ান ছিল। তবে ১৯৮৮ সালে এত সহজে ভারত সাবমেরিন পায় নি। কারন যতই সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু থাকুক ভারত সেইসময় সোভিয়ত নেভির অনেল অ্যাডমিরাল ভারতকে এই সাবমেরিন দেবার বিপক্ষে ছিল কারন এই ধরনের সাবমেরিন পরিচালনা করার মত ইনফ্রাস্ট্রাকচার ভারতের কাছে ছিল না এবং এত অ্যাডভান্সড টেকনোলজি সোভিয়েতের শত্রু দেশের হাতে পড়ে যাবার সম্ভবনা ছিল কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ভারতকে এই সাবমেরিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাশিয়া থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যখন সাবমেরিনটি রওনা হয় তখন এতে অনেক রাশিয়ান গুপ্তচর ছিল যাদের কাজ ছিল ভারতীয় নাবিকদের এই সাবমেরিন পরিচালনার ট্রেনিং দেওয়া এবং যাতে এই টেকনোলজি বাইরের দেশের হাতে না চলে যায় সে বিষয়ে নজর রাখা। এরপর ২০১৬ সালে আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও চীনের পর বিশ্বের ষষ্ঠ দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের হাতে পরমানু ক্ষমতা সম্পন্ন সাবমেরিন আছে। ২০১৬ সালেই ভারত আরিহান্ট ক্লাস পরমানু সাবমেরিন তৈরি করে। এবার একটা প্রশ্ন আসে যে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?? কেনই বা এই টেকনোলজি কোন দেশ কাউকে বিক্রি করতে চায় না।

গভীর জলের ভিতর থেকে শত্রুর উপর নিঃশব্দে আক্রমণ করতে সাবমেরিনের জুরি মেলা ভার। এই জন্য  সাবমেরিনকে যেকোন দেশের নেভাল ফ্লীটের নিউক্লিয়াস বলা হয়। প্রথমের দিকে সাবমেরিনকে চালানো হত ইলেকট্রিক ব্যাটারির সাহায্যে যেখানে একটি ডিজেল জেনারেটর থাকে। কিন্তু এর একটা বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যাটরি চার্জের জন্য বারবার জলের উপর আসতে হয়। এবার কোন সাবমেরিন জলের উপর এলে তৎক্ষনাত শত্রু দেশ তাকে টার্গেট করে ফেলে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়  স্নায়ু যুদ্ধের সময় এই ধরনের সাবমেরিন ব্যবহার করা হত। কনভেনশনাল ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনে একটি বড় আপগ্রেডেশন করা হয় তা হচ্ছে এআইপি বা এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালশন সিস্টেম ইনস্টল করা। জার্মান বিজ্ঞানী হেলমুথ ওয়ল্টার এটি তৈরি করেন এতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যবহার করা হয় ফুয়েল হিসেবে যাতে বাতাস দরকার পড়ে না। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড জ্বলবার সময় প্রচুর সুপার হিটেড স্টিম উৎপন্ন করে যার মাধ্যমে টারবাইনের সাহায্যে অক্সিজেন তৈরি হয় ফলে সাবমেরিন জলের তলায় একটু বেশীক্ষণ থাকতে পারে। কিন্তু এতে একটা সমস্যা ছিল তা হচ্ছে বিস্ফোরন হওয়ার। এরপর আরও কিছু টেকনোলজি আনা হয় যেমন ফুয়েল শেল, লিকুইড অক্সিজেন, হাই ক্যাপাসিটি ব্যাটারি যাতে সাবমেরিন দীর্ঘক্ষন জলের তলায় থাকতে পারে। কিন্তু আশানুরুপ ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। এই সময়ই বিশ্বে পরমানু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি শুরু হয় যা জনসাধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। তখন বিজ্ঞানীদের মনে হয় এমন নিউক্লিয়ার রিয়াক্টার যদি সাবমেরিনে ব্যবহার হয় এবং ইউরেনিয়ামকে ফুয়েল হিসাবে ব্যবহার করলে কয়েক মাস সাবমেরিন জলের তলায় থাকতে পারবে। 

১৯৬০-৭০ এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্ব প্রথম পরমানু সাবমেরিন তৈরির কাজ শুরু করে, পরে আমেরিকাও শুরু করে। তবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন তৈরির জন্য অনেক সমস্যাও ছিল। জমিতে কোন জায়গায় পরমানু রিয়াক্টার তৈরি করতে অনেকটা ফাঁকা জায়গা দরকার, তাছাড়া এসব সিস্টেম জনবসতি থেকে অনেকটা দূরে ইনস্টল করা হত যাতে রেডিয়েশনের ভয় না থাকে। সাবমেরিনের মতন অত ছোট জায়গায়, এত ক্রুর মাঝে নিউক্লিয়ার রিয়াক্টার তৈরি অত্যন্ত জটিল ব্যাপার ছিল। নিউক্লিয়ার সাবমেরিনে ইউরেনিয়াম-২৩৫ কে একটি নিউট্রন দ্বরা আঘাত করা হয় যাতে ইউরেনিয়াম দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় একে নিউক্লিয়ার বিভাজন বলা হয়। এই পক্রিয়ায় প্রচুর স্টিম উৎপন্ন হয়, ডিজেল পাওয়ার সাবমেরিনের মত একটি টারবাইনের মাধ্যমে এই স্টিম কে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপন্ন করা হয়। পরমানু সাবমেরিন টেকনোলজি কতটা জটিল তা একটু বলি। সাবমেরিনের নিউক্লিয়ার রিয়াক্টারে প্রকৃতি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়াম সরাসরি ব্যবহার করা যায় না কারন এতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর পরিমাম কম থাকে। যার জন্য ইউরেনিয়ামকে সমৃদ্ধ করা হয়। ভারতের ল্যান্ড বেসড নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট গুলোতে প্রকৃতিতে থেকে পাওয়া ইউরেনিয়ামই ব্যবহার করা হয়। তবে তারাপুর ও কুদানকুলাম সেন্টারে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। ভারত রাশিয়া থেকে যে আইএনএস চক্র লিজ নিয়েছিল শুধু তার জন্য আলাদা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ কেন্দ্র তৈরি করতে হয়েছে। সুতরাং নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিনের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে এগুলো প্রচুর ব্যায় সাপেক্ষ। তবে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন যেকোন দেশের স্ট্রাটেজিক অ্যাসেট। গভীর সমুদ্রে এর থেকে ঘাতক কিছু নেই।

বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে আরবসাগর ও ভারত মহাসাগরের মত বিশাল সমুদ্রসীমা এবং পাকিস্তান ও চীনের মতন শত্রু দেশ থাকায় ভারতের নিজস্ব পারমানবিক সাবমেরিন দরকার ছিল। ১৯৭১ সালে ভারত, পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান কে সহায়তা করতে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বঙ্গোপসাগরে তাদের ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ গ্রুপ পাঠিয়েছিল যাকে কাউন্টার করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিউক্লিয়ার মিসাইল লোডেড সাবমেরিন পাঠায়। সেই প্রথম ভারত পরমানু সাবমেরিনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে। ১৯৭৪ সালে অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধার পর ভারত পরমানু সাবমেরিন তৈরির কথা চিন্তা করে। ১৯৯০ সালে ভারত নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রজেক্ট শুরু করে। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফারনান্ডিজ ১৯৯৮ সালে এই প্রজেক্ট শুরু করে। ভারত ১২ বিলিয়ন ডলারের অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ভেসেল প্রজেক্ট শুরু করে যাতে পাঁচটি এসএসবিএন ক্লাস সাবমেরিন তৈরি করা হবে। ইতিমধ্যে ভারত আইএনএস আরিহান্ট নামে একটি সাবমেরিন সার্ভিসে এনেছে ২০১৬ সালে, আরও একটি সাবমেরিন আইএনএস আরিঘাট সমুদ্র ট্রায়াল শেষ করে নেভিতে যুক্ত হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় আরিহান্ট এর অর্থ শত্রুদের হত্যাকারী। বিশাখাপত্তনমের নেভি শিপ বিল্ডিং সেন্টারে এটি তৈরি হয় যাতে ৫২০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। আগেই বলেছি মোট পাঁচটি এসএসবিএন তৈরি হবে, আরিহান্ট ও আরিঘাট যাদের ডিসপ্লেসমেন্ট ৬০০০-৬৬০০ টন, এস ৪ ও এস ৪* যাদের ডিসপ্লেসমেন্ট ৭০০০-৭৭০০ টন এবং এস ৫ ক্লাস যার ডিসপ্লেসমেন্ট ১০০০০ টন প্রায়। এস ৫ হতে চলেছে রিয়েল গেম চেঞ্জার। আরিহান্টের সর্বোচ্চ গতি ৪৪ কিলোমিটার /ঘন্টা। যদি খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকে তাহলে আরিহান্ট রেঞ্জ অসীম কারন যেহুতু নিউক্লিয়ার পাওয়ার। সমু্দ্রের ৩০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যেতে সক্ষম আরিহান্ট। ২০০৯ সালে এই প্রজেক্ট লঞ্চ করা হয় এবং ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীতে এটি যুক্ত হয়। ১১১ মিটার লম্বা এই সাবমেরিনে ৮৩ মেগাওয়াট প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়াক্টার আছে। একটি আরিহান্ট ক্লাস সাবমেরিন ১২ টি কে-১৫ সাগরিকা মিসাইল, যার রেঞ্জ ৭৫০ কিলোমিটার, বা ৪ টি কে-৪ নিউক্লিয়ার মিসাইল বহন করতে সক্ষম যার রেঞ্জ ৩৫০০ কিলোমিটার। তবে আরিহান্ট ক্লাস এর তৃতীয় ও চতুর্থ সাবমেরিনের মিসাইল বহন করার ক্ষমতা প্রথম দুটির দ্বিগুণ হবে। অর্থাত ২৪ টি কে-১৫ বা ৮ টি কে-৪ মিসাইল বহন করবে। একটি আরিহান্ট ক্লাস সাবমেরিনে ৯৫ জন নাবিক থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.