কেন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের জন্য ১৫ই আগস্টকেই বাছা হয়েছিল?
দে দি হামে আজাদি বিনা খাটাগ বিনা ঢাল, সাবরমতী কা সন্ত ত্যুনে কর দিয়া কামাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কী সত্যি মহাত্মা গান্ধী ও জহরলাল নেহেরুর জন্য এসেছে নাকী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ও তার আজাদহিন্দ ফৌজের জন্য? এটা বহুদিন ধরেই একটি বিতর্কিত বিষয়। ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ১৫ই আগস্টকেই কেনো বেছে নেওয়া হল? এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মোহোনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী বা বাপু একই ব্যাক্তির ভিন্ন ভিন্ন নাম যিনি এমনই এক ব্যাক্তি ছিলেন যখনই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা আসবে ওনার নাম সবার প্রথমে থাকবে। মহাত্মা গান্ধীর গোটা জীবনেই ছিল শুধু সংগ্রাম যা দক্ষিন আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল এবং ভারতে এসে শেষ হয়েছিল। কিন্তু ওনার এমনই এক আন্দোলন ছিল যার জন্য তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার ব্রিটেনকেও তাঁর সামনে অসহায় করে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের নাম ভারত ছাড়ো আন্দোলন যার প্রভাবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত পর্যন্ত নড়ে গিয়েছিল। এই আন্দোলনে একদিকে যেমন সত্যাগ্রহী মানুষ ছিল তেমনি চরমপন্থী মানুষও ছিল যাদের একটাই লক্ষ ছিল ব্রিটিশদের তাড়িয়ে ভারতের পূর্ন স্বাধীনতা অর্জন করা। ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেড়েক ছিল। গান্ধীজী ঘোষনা করেছিলেন করো অথবা মরো। অন্তত আমাদের ইতিহাস বইয়ে এটাই বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কী ভারত ছাড়ো আন্দোলন সত্যিই সফল হয়েছিল!! এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন একটি মহান আন্দোলন ছিল। গান্ধীজীর একটি কথায় অগনিত ভারতবাসী এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গেছিল। এই প্রথম ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে ভারতে তাদের শেষের সময় শুরু হয়ে গিয়েছে। যদি নিরপেক্ষ বিচার করা হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন ততটা সফল হয়নি কারন এর পরও পাঁচ বছর ভারতে ব্রিটিশরা ছিল। এছাড়া এই আন্দোলন শুরু হতেই ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সমস্ত শীর্ষ স্থানীয় নেতৃত্বকে জেলে বন্দি করে। এই আন্দোলনের আগেও জাতীয় কংগ্রেস একটি মজবুত রাজনৈতিক দল ছিল কিন্তু এই আন্দোলনের পর কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়ে যার সরাসরি সুযোগ নেয় মুসলিম লীগ। কারন ১৯৩৬-৩৭ এ ভারতে নির্বাচনে ১১ টি প্রদেশের মধ্যে আটটিতে জিতেছিল কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ একটাতেও জিততে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে আলোচনা না করেই ব্রিটেন ভারতকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে দেয় যার জন্য জাতীয় কংগ্রেসের একের পর এক নেতা পদত্যাগ করে। এতে প্রবল খুশী হয় মহম্মদ আলি জিন্না। তাই শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়ো আন্দোলন গোটা ভারতব্যাপী না হয়ে কংগ্রেসের একটি আন্দোলন হয়েই থেকে যায়।
ছোটবেলা থেকেই আমাদের ইতিহাস বই সহ আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মহাত্মা গান্ধী একা নিজের চেষ্টায় একের পর এক আন্দোলন করে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। গান্ধীজীর কাছে অহিংসা ও সত্যাগ্রহের মতন অস্ত্র ছিল যার সামনে নাকী কুপোকাত হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু মোদী সরকার দ্বারা প্রকাশিত নেতাজীর কীছু ফাইল এবং জেনারেল জিডি বক্সীর দ্বারা লেখা বোস এন ইন্ডিয়ান সামুরাই কিন্তু অন্য কথা বলে। প্রত্যেকটি ভারতীয়র এই বই অবশ্যই পড়া উচিৎ। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্লেমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি, তিনিই ভারতের স্বাধীনতার কাগজে সই করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৫৬ সালে ভারত সফরে আসেন রিচার্ড অ্যাটলি এবং তিনি পশ্চিম বঙ্গের রাজ্যপাল পিবি চক্রবর্তীর কাছে দুদিন অতিথি হিসাবে ছিলেন। পিবি চক্রবর্তী আর সি মজুমদারের দি হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলের প্রকাশককে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি জানান পশ্চিমবঙ্গ সফর কালীন সময়ে রিচার্ড অ্যাটলিকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন গান্ধীজীর ভারত ছাড়ো আন্দোলন অনেকদিন আগেই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে এমন কোন পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি যে ইংরেজদের ভারত ছাড়তে হবে তাহলে ব্রিটেন ভারত ছাড়ল কেন? জবাবে রিচার্ড অ্যাটলি জানিয়েছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের কারনে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা এবং ব্রিটিশ ভারতীয় নেভির সেনা সদস্যদের মধ্যে বিদ্রোহী ভাব দেখা যাচ্ছিল।
পিবি চক্রবর্তী আবারও প্রশ্ন করেছিলেন ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার পেছনে গান্ধীজীর অবদান কতটা ছিল। জবাবে রিচার্ড অ্যাটলি একটি ছোট হাসি দিয়ে বলেছিলেন নূন্যতম। ক্লেমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন তা সবাই বুঝতে পেরেছেন তবুও আরও ভাল ভাবে জানতে হলে সময়ের একটু পেছনে যেতে হবে। সালটা ১৯৪৫ আমেরিকা ও ব্রিটেনের নেতৃত্বে অ্যালায়েড ফোর্স হিটলারের নেতৃত্বে থাকা অ্যাক্সেস পাওয়ারকে হারিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিতে যায়। পরাজিত দেশের সেনাদের যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে শাস্তি দেবার পক্রিয়া শুরু হয়। ভারতেও আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে আইনি মামলা শুরু হয় যার নাম দেওয়া হয় লাল কেল্লা ট্রায়াল। কিন্ত ব্রিটিশ সরকারের এই কাজ তাদের বিরুদ্ধেই বুমেরাং হয়ে যায়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার সদস্যরা এই কাজে ক্ষুব্ধ হয়।
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ ভারতীয় রয়েল নেভির ৭৮ টি জাহাজের ২০,০০০ সেনা বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং তারা নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ছবি নিয়ে মুম্বাইয়ে ব্রিটিশ সরকারের সামনে জয় হিন্দ ধ্বনি দিতে থাকে। ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সেও বিদ্রোহ শুরু হয় এবং জব্বলপুরের ভারতীয় সেনাও বিদ্রোহ ঘোষনা করে। ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স তথ্য অনুযায়ী সেসময় ভারতীয় সেনারা এতটাই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল যে তাদের নিয়ন্ত্রন করা ব্রিটিশ অফিসারদের মুস্কিল হয়ে পড়েছিল। সেসময় ভারতে মাত্র ৪০,০০০ ব্রিটিশ সেনা ছিল অন্যদিকে ব্রিটেনের হয়ে প্রায় ২৫ লাখ ভারতীয় সেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল যাদের ধাপে ধাপে ডিকমিশন করা হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাদের বীরত্ব ব্রিটেন যুদ্ধক্ষেত্রে ভাল ভাবেই লক্ষ করেছিল। তারা জানত তাদের মাত্র ৪০,০০০ সেনা বিশাল ভারতীয় সেনার সামনে টিকতে পারবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের আর্থিক ও সামরিক এতটাই ক্ষতি হয় ব্রিটেন আরও সেনা ভারতে আনার মত পরিস্থিতিতে ছিলনা। আর যদি নিয়েও আসত তাহলে এত বিপুল ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতন ক্ষমতা ছিল না।
ক্লেমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলির কথা অনুযায়ী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ও তার আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতীয় সেনার মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস রয়েল ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যদের বিদ্রোহের জন্য প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারনে আজ ভারতের ইতিহাস বইয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ও আজাদ হিন্দ ফৌজের এসব অজানা ঘটনা বিস্তারিত আকারে ব্যাখা করা হয় নি বরং মহাত্মা গান্ধীকে জাতির জনক হিসাবে প্রচার করা হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ ই আগস্টই কেনো পালন করা হয়? অন্য অনেকদিন ছিল সেই দিন কেনো ভারত স্বাধীন হয়নি। এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। সেসময় ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৯৩০ সাল থেকে কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারী দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করে আসছিল কারন ১৯২৯ সালের ২৬ জানুয়ারী লাহোর অধিবেশনে পূর্ন স্বরাজের ঘোষনা হয়। সেসময় কংগ্রেসের প্রধান ছিল জহরলাল নেহেরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে লেবার দল ক্ষমতায় আসে এবং ঠিক হয় ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট রিচার্ড অ্যাটলি ঠিক করে ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পুরো ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে ভারতকে। এর জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের শেষ ভাইসরয় হিসাবে ভারতে পাঠানো হয় ১৯৪৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ১৬ মাস সময় দেওয়া হয়। মাউন্টব্যাটেন ব্রিটেনের রাজার ভাই ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে জাপানের বিরুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সের নেভিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি যাতে অনেক যুদ্ধ জিতেছিলেন। কিন্তু ভারতে পৌঁছে মাউন্টব্যাটেন বুঝে গিয়েছিলেন এখানে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত থাকা যাবে না। চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী এপ্রসঙ্গে বলেছিলেন যদি ১৯৪৮ সাল অবধি মাউন্টব্যাটেন থাকতেন তাহলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কোন ক্ষমতাই থাকতনা। এর জন্য মাউন্টব্যাটেন জুন মাসেই জানিয়ে দেয় রিচার্ড অ্যাটলিকে ভারত ভাগ করে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা।
৪ জুলাই ব্রিটেনের সাংসদে ভারতের স্বাধীনতা বিলের প্রস্তাব রাখা হয় এবং ১৮ জুলাই বিল পাশ করে যায় যাতে ব্রিটেনের রাজা সই করে। এই বিলেই ঠিক হয় ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দেওয়া হবে। কিন্তু এই তারিখ ঠিক কী করে হয়!! লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিল ১৫ আগস্ট ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। এর কারন হিসাবে বলা হয় ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্টেই জাপান আত্মসমর্পন করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ডমিনিক লেপিয়ারি ও ল্যারি কলিন্স মাউন্টব্যাটেনের উপর ফ্রিডম এট মিডনাইট নামে একটি বইয়ে এই কথা বলেছে। এছাড়া মাউন্টব্যাটেন সাক্ষাৎকারেও এই তথ্য স্বীকার করেছে। তবে ১৫ ই আগস্ট জাপানের রাজা হিরোইতো রেডিওতে দেশের জনগনকে জানিয়েছিল জাপান আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেবে না। কিন্তু সরকারি ভাবে এই পুরো ঘটনা ২ সেপ্টেম্বর হয়। কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ২৬ শে জানুয়ারিকে স্মরনীয় রাখতে ১৯৪৯ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান তৈরি হয় যদিও দুই মাস আগেই সংবিধান তৈরি হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ২৬ জানুয়ারি সরকারি ভাবে গ্রহন করা হয়।