আমেরিকা চাঁদেও পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাতে গেছিল
১৯৪৫ সালে শেষ হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। এক সময়ের সুপার পাওয়ার ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পতন ঘটে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কারন এই দুই দেশেরই অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপার পাওয়ার হিসাবে উত্থান শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই দুই দেশ এক জোটে থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্কে শীতলতা তৈরি হয়। এই সময় গোটা বিশ্ব দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে এবং আমেরিকান ব্লকে। ইতিহাসে এই সময়কে ঠান্ডা যুদ্ধ বলা হয় যা চলেছিল ১৯৯১ সাল অবধি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অবশেষে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সামরিক খাতে, প্রযুক্তিতে দুই দেশই একে অন্যকে টেক্কা দিয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমানের চেষ্টা শুরু করে যার কারনে এই দুই দেশই একাধিক গোপন প্রজেক্টে কাজ শুরু করে। এরকমই একটি প্রজেক্ট হল প্রজেক্ট এ ১১৯ যা আমেরিকা শুরু করেছিল। এই প্রজেক্টে আমেরিকা ঠিক করেছিল চাঁদে পরমাণু বোম্ব বিস্ফোরণ করাবে যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন টেক্কা দেওয়া যায়।
মানব ইতিহাসে বিশেষ মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ন। এই দিনই মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছিল। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর মহাকাশে স্পুটনিক ১ নামক স্যাটেলাইট পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই ঘটনায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় আমেরিকা কারন আমেরিকা নিজেও স্যাটেলাইট তৈরি করছিলো মহাকাশে পাঠানোর জন্য কিন্তু সেভিয়েত ইউনিয়ন আগেই স্যাটেলাইট পাঠিয়ে প্রতিযোগিতায় জিতে যায়। আমেরিকা ভ্যানগার্ড টিভি৩ নামে একটি ছোট স্যাটেলাইট তৈরি করে এবং ১৯৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এটি লঞ্চ করে কিন্তু এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ব্যার্থ হয়ে যায়, এরই মধ্যে ৩ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক ২ নামে আরও একটি মহাকাশযান মহাকাশে পাঠায়। স্পুটনিক ২ এ লাইকা নামে একটি কুকুর ছিল। সুতরাং মহাকাশে প্রথম প্রানী পাঠানোর কৃতিত্বও সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে চলে যায়।
এই ঘটনার পর আমেরিকার সরকারকে আমেরিকার জনগনের সামনে প্রমান করার দরকার হয়ে পড়ে যে তারাও মহাকাশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিলনা। সময়টা যেহেতু ঠান্ডা লড়াইয়ের সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ন কিছু করলে আমেরিকাকেও তার থেকে ভালো কিছু করতে হত। অবশেষে আমেরিকা ১৯৫৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারী এক্সপ্লোরার ১ নামে একটি স্যাটেলাইট পাঠায় মহাকাশে, তবে আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতে আরও বড় কিছু করবার পরিকল্পনা করছিলো। আমেরিকান বায়ুসেনা ঠিক করে চাঁদে পরমাণু বোম্ব বিস্ফোরণ ঘটাবে, যা পৃথিবী থেকে দেখা যাবে এবং এই ঘটনায় আমেরিকার মানুষ উৎসাহিত হয়ে উঠবে। তবে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা খবর পায় সোভিয়েত ইউনিয়নও চাঁদে হাইড্রোজেন বোম্ব বিস্ফোরণের চিন্তাভাবনা করছে। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই আমেরিকার বায়ুসেনা লিওনার্ড রিফেল নামে এক পদার্থবিদের সাথে যোগাযোগ করেন যিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আমেরিকার বায়ুসেনা লিওনার্ড রিফেলকে জানায় চাঁদে রকেট পাঠিয়ে পরমাণু বোম্ব বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করছে আমেরিকা এব্যাপারে তাঁর সাহায্য লাগবে। লিওনার্ড রিফেল জানান এই প্রজেক্টের একটু ভুল হলে রকেট পৃথিবীতেও ফিরে আসতে পারে। লিওনার্ড রিফেল তাঁর সাথে আরও বেশ কিছু অধ্যাপককে যুক্ত করেন এই প্রজেক্টে। অবশেষে লিওনার্ড রিফেলের নেতৃত্বে দশ সদস্যের একটি দল প্রজেক্ট এ ১১৯ এ কাজ শুরু করে। এই দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দুই জন সদস্য হচ্ছে জেরার্ড কুইপার এবং তাঁর ছাত্র কার্ল সাগান। বলা হয় আমেরিকার মানুষদের মহাকাশ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ভাবে বুঝিয়েছিলেন কার্ল সেগান এবং বিখ্যাত টিভি অনুষ্ঠান কসমসের সঞ্চালক ছিলেন এই কার্ল সেগান।
প্রজেক্ট এ ১১৯ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ ছিল চাঁদে হওয়া পরমাণু বিস্ফোরণ যেন পৃথিবী থেকে দেখা যায়। প্রথমে ঠিক করা হয় হাইড্রোজেন বোম্ব বিস্ফোরন করা হবে চাঁদে কিন্তু আমেরিকার বায়ুসেনা হাইড্রোজেন বোম্বের প্রস্তাব নাকচ করে দেয় ওজন বেশী বলে। শেষ পর্যন্ত চাঁদে বিস্ফোরণের জন্য ডব্লিউ ২৫ একটি হালকা পরমাণু বোম্বকে বেছে নেওয়া হয়। ডব্লিউ ২৫ ১.৭ কিলোটন বিস্ফোরন ঘটাতে সক্ষম ছিল যেখানে ১৯৪৫ সালে জপানের হিরোশিমাতে আমেরিকা লিটিল বয় নামে যে পরমাণু বোম্ব ফেলেছিল তা ১৩ – ১৮ কিলো নিউটন বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম ছিল। ১৯৫৯ সালে আমেরিকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের মাধ্যমে চাঁদে পরমানু বোম্ব বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেছিল। পরমাণু বিস্ফোরণ যখনই কোথাও হয় তখন আকাশে মাশরুফ ক্লাউড তৈরি হয়ে যায়। আমেরিকা যখন হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন পরমাণু বোম্ব পরীক্ষা করেছিল তখন মাশরুম ক্লাউড তৈরিতে হয়েছিল। তবে চাঁদে মাশরুম ক্লাউড তৈরি হত না কারন চাঁদে আবহাওয়া নেই। যার কারনে আমেরিকা চাঁদে পরমাণু বিস্ফোরণ করলে উজ্জ্বল আলো দেখা যেত পৃথিবী থেকে। তবে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকা প্রজেক্ট এ ১১৯ বাতিল করে দেয়। কেন আমেরিকা এই প্রজেক্ট বাতিল করে দেয়? তার কোন সঠিক কারন জানা যায়নি। তবে বলা হয় আমেরিকা ভেবেছিল যদি এই প্রজেক্ট কোনওভাবে ব্যর্থ হয় তাহলে হয়ত পরমানু বোম্ব পৃথিবীতেই বিস্ফোরন হয়ে যাবে যাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া আমেরিকা এটাও ভেবেছিল যদি চাঁদে পরমানু বিস্ফোরণ ঘটানো হয় তাহলে ভবিষ্যতে চাঁদে মানুষ পাঠানো সম্ভব নাও হতে পারে। এছাড়া এই প্রজেক্টে যুক্ত বিজ্ঞানীদেরও বক্তব্য ছিল চাঁদে পরমাণু বিস্ফোরণের বদলে চাঁদে মানুষ পাঠালে সেটা আরও বড় কৃতিত্ব হবে। এরপর ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযানের মাধ্যমে আমেরিকা মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠায়। দীর্ঘদিন এই প্রজেক্ট এ ১১৯ এর কথা গোপন রেখেছিল আমেরিকা, ২০০০ সালে নাসার বিজ্ঞানী ও প্রজেক্ট এ ১১৯ এর প্রধান বিজ্ঞানী লিওনার্ড রিফেল এই প্রজেক্টের অস্তিত্বের কথা প্রথম স্বীকার করে। তবে লিওনার্ড রিফেলের বক্তব্য সত্বেও আরও কয়েক বছর আমেরিকা এই প্রজেক্টের কথা স্বীকার করেনি। ২০১০ সালে জানা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের চাঁদে হাইড্রোজেন বোম্ব বিস্ফোরণের প্রজেক্ট কোনওদিন শুরু হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রজেক্ট ই এর আওতায় এই প্রজেক্ট শুরু করবার পরিকল্পনা করেছিল এবং এই সম্পূর্ন প্রজেক্টকে চার ভাগে ভাগ করেছিল। প্রজেক্ট ই ১ এ প্রথমে চাঁদে পৌঁছানো হত, প্রজেক্ট ই ২ এবং ই ৩ এ চাঁদের দূরবর্তী প্রান্তে মহাকাশযান পাঠানো হত এবং প্রজেক্ট ই ৪ এ চাঁদে হাইড্রোজেন বোম্ব বিস্ফোরণ ঘটানো হত। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নও চিন্তা করেছিল যদি প্রজেক্ট ব্যর্থ হয় এবং রকেট সোভিয়েত ভূখন্ডে এসে পড়ে তাহলে পরমাণু বিস্ফোরণে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষতি হবে, তাছাড়া উপযুক্ত রকেটও ছিলনা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সেসময় যার কারনে এই প্রজেক্ট কখনও শুরুই করেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন।