হারতে বসা আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেতার পেছনে কি কারন ছিল?
রাজেশ রায়:- মানব ইতিহাসে দুটি সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে নৃশংসতার বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকে অনেক এগিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়াতে মূূলত জাপান নিজের প্রভাব দ্রুত বাড়াচ্ছিল। জাপান খুব শক্তিশালী দেশে পরিনত হয়েছিল এসময়। জাপানিজ নেভি সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল তিন বাহিনীর মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই জাপান ১৯৩৭ সালে চীন আক্রমন করে। শুরু হয় দ্বিতীয় সিনো জাপানিজ যুদ্ধ। এর আগে ১৮৯৪-৯৫ এ প্রথম সিনো জাপানিজ যুদ্ধেও জাপান চীন কে পরাজিত করেছিল। ১৯৪০ সালে জাপান, ইটালি ও জার্মানি জোট গঠন করে অ্যাক্সিস পাওয়ার হয়ে লড়াই করছিল। হিটলার ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে পুরো ইউরোপ দখল করে নিয়েছিল। দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের আধিপত্য ছিল কিন্তু জাপান এখানে ব্রিটেনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয়। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয় ব্রিটেনের। কারন ব্রিটেন ত্রিমুখী যুদ্ধ করছিল। ইউরোপে জার্মানির বিরুদ্ধে এবং এশিয়াতে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল ব্রিটেনকে। আবার ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা হয়। সুতরাং সব মিলিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিল ব্রিটিশরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দুবছরে আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দেয়নি, বারবার ব্রিটেনের অনুরোধ সত্বেও আমেরিকা যুদ্ধে যোগ দিচ্ছিলনা। জাপান ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমন করে। কারন জাপানের উপর অনেক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আমেরিকা। জাপানের লক্ষ ছিল আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস করা তাহলে ক্যারিয়ারে থাকা যুদ্ধবিমান গুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস হবার অর্থ আমেরিকার নেভি পুরো দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের আধিপত্য বিস্তার হওয়া। কিন্তু সেদিন পার্ল হারবারে ভাগ্য আমেরিকার সাথে ছিল। আমেরিকার অনেক যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস হয় সেদিন এবং প্রায় ২০০০ লোকের মৃত্যু হয় কিন্তু একটিও আমেরিকান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়নি। জাপান পার্ল হারবারের বিজয়ে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপরের দিনই ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট জানায় আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবে। যদি জাপান পার্ল হারবারে আক্রমন না করত তাহলে আমেরিকাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতনা ফলে আজ ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা থাকত।
পার্ল হারবারে একটিও আমেরিকান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে না পেরে জাপান আবারও আমেরিকার উপর আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করে এবং ভবিষ্যতের ব্যাটেল অফ মিডওয়ের পটভূমি রচিত হয়। এর উপর অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালেই মিডওয়ে যুদ্ধকে কেন্দ্র কটে দুটি সিনেমা মিডওয়ে এবং ডাউন্টলেস– দি ব্যাটেল অফ মিডওয়ে মুক্তি পায়। হাওয়াই দ্বীপের ১৪৮৬ মাইল দূরে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ছোট দ্বীপ হচ্ছে মিডওয়ে এর আয়তন হচ্ছে মাত্র ৬.৫ স্কোয়ার কিলোমিটার। এর আশেপাশে ফিলিপিন্স, পাপুয়া নিউগিনি, ব্রুনেই সবের উপরই তখন জাপানি নিয়ন্ত্রন ছিল। মিডওয়ে দ্বীপে আমেরিকান নেভির বেস ছিল, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থাকত। জাপনিজ নেভির কম্যান্ডার অ্যাডমিরাল ইয়ামা মোটো আমেরিকাকে আবার আক্রমনের জন্য আরও একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। ইয়ামা মোটোর পরিকল্পনা ছিল ত্রিস্তরীয়। প্রথম ফেজে জাপানিজ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার মিডওয়ে দ্বীপে আক্রমন করবে এবং সব ধ্বংস করে দেবে। দ্বিতীয় ফেজে জাপানিজ সেনা মিডওয়েতে প্রবেশ করে দেখবে কোন আমেরিকান বেঁচে আছে কীনা। যখন মিডওয়েতে আক্রমন হবে পার্ল হারবার থেকে আমেরিকা সেনা পাঠাবে তখনই শুরু হবে তৃতীয় ফেজ। রিজার্ভে থাকা জাপানিজ সেনা এবার আক্রমন করবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভাবে মিডওয়েকে ধ্বংস করে দিয়ে জাপানের অধীনে আনা হবে, তাহলেই প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সব ধ্বংস হয়ে যাবে এবং জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিকল্পনা দারুন ছিল এবং ইয়ামা মোটো জানত এই প্ল্যান ১০০ শতাংশ সফল হবে কিন্তু জাপানের এই প্ল্যান সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়ে যায় কারন আমেরিকার ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক বা গুপ্তচর বিভাগের জন্য। আমেরিকান নেভির কম্যান্ডার জোসেফ রোসেফোর্ট জাপানের সমস্ত মেসেজ ডিকোড করে ফেলে এবং জাপানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে যায় আমেরিকা। যার কারনে প্রায় হারতে বসা আমেরিকা জিতে যায়।
মিডওয়েতে আক্রমনের পরিকল্পনাকে জাপান অপারেশন এম নাম দেয়। কিন্তু আমেরিকা যাতে কোন সন্দেহ না করে সেজন্য জাপান মিডওয়েতে আক্রমনের একদিন আগে অর্থাৎ ৩ জুন জাপান অপারেশন এ শুরু করে যাতে অ্যালুউশন নামে একটি দ্বীপে আক্রমন করে জাপান। আসলে জাপানের লক্ষ ছিল আমেরিকাকে বোকা বানানো। যাতে আমেরিকা অ্যালুউশন দ্বীপে নিয়ে ব্যাস্ত থাকে এবং সেখানে সেনা পাঠায়। এই সুযোগে জাপান মিডওয়েতে আক্রমন করবে। কিন্তু আমেরিকা প্রথম থেকেই এই ব্যাপারে সব জানত। জাপান চারটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে বেরোয় মিডওয়ে আক্রমনের জন্য। এদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী ছিল দুটি ক্যারিয়ার আকাগি এবং কাগা। এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুটিতেই সবচেয়ে বেশী যুদ্ধবিমান ছিল। আরও দুটো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হচ্ছে সোরিউ ও হেরিউ। আকারে ছোট হলেও এগুলোর গতি অনেক বেশী ছিল। তবে জাপানিজ নেভির আক্রমনের মুল ভাগে ছিল আকাগি ও কাগা। পার্ল হারবারে আক্রমনের ছয় মাস পরে ১৯৪২ সালের ৪ জুন মিডওয়েতে আক্রমন করে জাপান। কিন্তু আমেরিকা আগে থেকেই এই আক্রমনের বিস্তারিত জানতো। তবে এর আগে ৩ জুন জাপান অ্যালুউশন দ্বীপে আক্রমন করে। আমেরিকার কীছি বি-১৭ ফ্লাইং ফরট্রেস বিমান মিডওয়ে থেকে এখানে যায় জাপানকে প্রতিরোধ করতে কিন্তু ব্যার্থ হয়। সেদিন রাতে আরও কীছু বি-১৭ বিমান অ্যালুউশন দ্বীপে যায় কিন্তু এবারও তারা ব্যার্থ হয় জাপানকে প্রতিরোধ করতে। ব্যাটেল অফ মিডওয়ে শুরুর প্রথম ধাপই এটা।
আসলে আমেরিকা জেনে বুঝে কম বি-১৭ পাঠিয়েছিল যাতে জাপান ভাবে আমেরিকা কীছুই জানে না। আমেরিকা তার মূল শক্তি মিডওয়ের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিল। ৪ জুন ভোর চারটের সময় জাপান মিডওয়ে আক্রমনের ফেজ-১ শুরু করে। জাপানের কাগা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে ১০৮ টি বিমান উড়ে যায় মিডওয়ের উদ্দেশ্যে। আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লীটের কম্যান্ডার ইন চীফ অ্যাডমিরাল চেস্টার ডব্লু নিমিতজ ততক্ষনে একটি পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছিল। তার পরিকল্পনা ছিল জাপানের আক্রমনের আগে তারাই আক্রমন করে জাপানের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেবে। অর্থাৎ জাপান ও আমেরিকার উভয়েরই পরিকল্পনা ছিল উভয়ের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু কেউই কারও এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সঠিক অবস্থান জানতো না। জাপানের ফেজ-১ সকাল সাতটা অবধি চলে। কিন্তু ফেজ-১ এ জাপানের যা পরিকল্পনা ছিল পুরো মিডওয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার তা সম্ভব হয়নি।
জাপান ফেজ-১ এ মিডওয়ের ৫০-৫৬ শতাংশই ধ্বংস করতে পেরেছিল। এর মধ্যেই আমেরিকান বোম্বাররা একের পর এক বোম্বিং করতে থাকে জাপানের নেভির উপর। এসব জাপানের পরিকল্পনাতেই ছিলনা। ইয়ামা মোটো স্বপ্নেও ভাবেনি এমন হবে। ৫ জুন সকাল আসতে আসতে জাপানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেইদিন সকাল ৭ঃ০৬ এ আমেরিকান নেভি একটি সিদ্ধান্ত নেয় যেকরেই হোক জাপানের চারটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করতেই হবে। কিন্তু আমেরিকা তখনও এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গুলোর সঠিক অবস্থান জানতনা। আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লীটের সদস্য ম্যাকলস্কিকে পাঠানো হয় বিমানে করে ক্যারিয়ার গুলো খুঁজে বার করতে। ম্যাকলস্কি অনেক চেষ্টা করেও প্রথমের দিকে খুঁজে পায় নি। এদিকে বিমানের ফুয়েলও শেষ হয়ে আসছিল। ফেরার আগে শেষবারের মতন ম্যাকলস্কি উত্তর পশ্চিম দিকে একবার যায় সেখানেই দেখতে পায় জাপানের সব ক্যারিয়ার গুলোকে। ম্যাকলস্কির এই মিশন ব্যাটেল অফ মিডওয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হর্নেট ও এন্টারপ্রাইজ এবং সাবমেরিন একের পর এক আক্রমন করতে থাকে জাপানের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের উপর। জাপানের কাগা, সোরিউ, আকাগি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয় আমেরিকা শুধু হেরিউ বেঁচে ছিল। আমেরিকা এরপর সর্বশক্তি দিয়ে হেরিউকে আক্রমন করে এবং এটাও ধ্বংস হয়ে যায়, সাথে সাথে জাপানের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। যদিও আমেরিকার ইয়র্কটাউন জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেছিল। ৬ জুন ইয়ামা মোটো জাপানিজ নেভিকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। এইভাবেই শেষ হয় ব্যাটেল অফ মিডওয়ে যাতে আমেরিকা জিতে যায়। জাপানের ৩০০০ সেনা মারা যায় এই যুদ্ধে যার মধ্যে ২০০ সবচেয়ে অভিজ্ঞ পাইলট ছিল। জাপানের চারটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, একটি ক্রুজার ও ৩০০ এয়ারক্রাফট ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে আমেরিকার ইয়র্কটাউন, হাম্মান জাহাজ, ১৪৫ বিমান ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৩৬০ জন সেনার মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে বিশাল বিজয় ছিল এটা আমেরিকার, এরপর জাপান আর কোনওদিন প্রশান্ত মহাসাগরের আধিপত্য বিস্তার করতে পারে নি।