অ্যামেরিকা

চীন চাইলেও কেন আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার হবেনা জানেন?

রাজনীতি হোক কিংবা যুদ্ধের ময়দান। উভয় ক্ষেত্রেই বন্ধুর থেকে শত্রুর ব্যাপারে বেশী তথ্য থাকা দরকার বিশেষ করে শত্রু যদি চীনের মতোন কোনও দেশ হয়। চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর স্বপ্ন ২০৪৯ এর মধ্যে চীনের সামরিক ক্ষমতাকে বিশ্বমানের তৈরি করা। এই মহূর্তে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী দেশ চীন। চীনের সেনাবাহিনীতে বর্তমানে ২.৩ মিলিটারি বা ২৩ লাখ সেনা রয়েছে যা বিশ্বের কোন দেশের সামরিক বাহিনীতে থাকা সেনা সংখ্যার বিচারে সর্বাধিক। অন্যদিকে ভারতের সেনাবাহিনীতে ১.৪ মিলিয়ন বা ১৪ লাখ সেনা রয়েছে। প্রায় ৭৩০ যুদ্ধজাহাজ যুক্ত চীনের নৌবাহিনীতে বিশ্বের যে কোনও দেশের নৌবাহিনীর তুলনায় সর্বাধিক যু্দ্ধজাহাজ রয়েছে। চীন নিজের সামরিক সক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি করছে। কোনও দেশ সামরিক ভাবে কতটা শক্তিশালী তা শুধু সেনা সংখ্যার উপর নির্ভর করেনা আরও অনেক স্ট্রাটেজিক বিভাগের উপর নির্ভর করে। তবে চীন সামরিক ভাবে যত শক্তিশালীই হোক না কেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার পাওয়ার হওয়ার সম্ভবনা কমই আছে, কারন চীন আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। 

যুদ্ধের আগে শত্রুর ক্ষমতা ও দুর্বলতা উভয়ই ভালো ভাবে জানা দরকার। বিশেষ করে শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ন তথ্য দরকার কারন অনেক সময় দুটি শত্রু দেশ এক অপরের মিত্র দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে যুদ্ধে সুবিধার জন্য। বিশ্বে কখনও একক ভাবে কোন সুপারপাওয়ার তৈরি হয়নি যখনই কোন দেশ কিছু বহু বছর ধরে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে তখনই প্রকৃতির নিয়মে অপর কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তার সামনে দাড়িয়েছে। 

উনবিংশ শতকে বিশ্বে দুই সুপার পাওয়ার ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। বিংশ শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং বিশ্বে নতুন দুই সুপার পাওয়ারের উদ্ভব হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বে আমেরিকা একক সুপার পাওয়ার হিসাবে ছিল বহুদিন, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের শূন্যস্থান পূরনের জন্য দ্রুত উঠে এসেছে চীন। 

বর্তমানে আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। শক্তিশালী অর্থনীতির কারনে সামরিক দিক দিয়ে আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে চীন। তবে আমেরিকাও চীনের শক্তি ও দুর্বলতার উপর নজর রেখেছে। 

সম্প্রতি আমেরিকান কংগ্রেস চীনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চীন আধুনিক প্রযুক্তি আমদানির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে যেমন সেমিকন্ডাক্টর। উনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল কয়লা, বিংশ শতাব্দীতে পেট্রোলিয়াম, ঠিক তেমনি একবিংশ শতাব্দীতে অর্থাৎ বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ন। চীন সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করে কিন্তু আধুনিক সেমিকন্ডাক্টরের ডিজাইন, প্রযুক্তির জন্য চীন আমেরিকা, ফ্রান্স সহ অন্যান্য দেশের উপর নির্ভরশীল সুতরাং চীনকে এই বিভাগে প্রতিরোধ করা সম্ভব আমেরিকার পক্ষে। 

চীনে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন পেনশন ভোক্তা রয়েছে অর্থাৎ চাইনিজ সরকারকে প্রতি মাসে পাঁচ কোটি সত্তর লাখ লোককে পেনশন দিতে হয় যা চীনের অর্থনৈতিক গতিকে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। চীন শিক্ষা, কাঁচামাল, উন্নত যন্ত্রাংশ এবং বিশেষ কিছু প্রযুক্তির জন্য আমেরিকা ও তার বন্ধু দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন আমেরিকা ও তার মিত্রদেশ গুলোর উপর বিলাসবহুল জিনিস থেকে শুরু করে কাঁচামাল অবধি অন্তত ৪০০ টি দ্রব্যের জন্য ৭০ শতাংশ নির্ভরশীল। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে প্রচুর চীনা শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করে, এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা শেষ করে চীনে ফিরে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন সামরিক প্রজেক্টে কাজ করে। আমেরিকা নতুন আইন এনেছে যেখানে এমন কিছু আধুনিক প্রযুক্তি যা সাধারন বানিজ্যিক বিভাগ এবং সামরিক বিভাগ উভয়ক্ষেত্রেই ব্যবহারযোগ্য সেসব প্রযুক্তিতে চাইনিজ সংস্থাগুলোকে দেওয়া হচ্ছেনা। আমেরিকা তার মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলোকেও এধরনের পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে, অনেক দেশতো ইতিমধ্যে এরকম নিয়ম শুরু করেও দিয়েছে। 

চীন সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন ধাতুর জন্যও আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। চীন রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ফ্রান্সের উপরে বিমান ও জাহাজের ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীল। ২০১৫ থেকে ২০২০ এর মধ্যে চীন এই তিনটি দেশ থেকে অধিকাংশ অস্ত্র আমদানি করেছে। ফ্রান্স ও আমেরিকা ন্যাটো সদস্য দেশ সুতরাং ফ্রান্স চাইলে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা বন্ধ করে দিতে পারে চীনকে। উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চীন আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান ও তাইওয়ান থেকে আমদানি করে। 

আমেরিকান কংগ্রেসের এই প্রতিবেদন দেখে চীন জানিয়েছে তারা সেমিকন্ডাক্টর সেক্টরে গবেষনার জন্য প্রচুর ব্যায় করছে। কিন্ত চীনের বক্তব্যে একটা জিনিস পরিষ্কার যে তারা প্রচুর ব্যায় করছে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করতে কিন্তু এইমুহূর্তে তারা আমেরিকা ও তার মিত্রদেশ গুলোর উপর নির্ভরশীল। চীনের আরও একটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে তা হল জন্মহার কমে যাওয়া৷ বলা হচ্ছে জন্মহার কমে যাওয়ায় আগামী দশ বছরে চীনের প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যোগ্য লোকের সংখ্যা কমে যেতে পারে কারন চীন সুপার পাওয়ার হওয়ার চেষ্টা করছে, এছাড়া পূর্ব চীন সাগরে, দক্ষিন চীন সাগরে জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স সাথে চীনের ঝামেলা রয়েছে, ভারতের সাথেও সীমান্ত সমস্যা রয়েছে চীনের যার কারনে চীনের তরুন প্রজন্মের একটা বড় অংশে প্রতিরক্ষা বিভাগে যুক্ত হতেই হবে, তাই সেক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও গবেষনা খাতে লোক সংখ্যা কমে যেতে পারে। 

চীনের সেনাবাহিনী কতটা দক্ষ সেসবিষয়ে সন্দেহ আছে কারন ১৯৭৯ সালের পর থেকে চীনের সেনাবাহিনী পিএলএ বা পিপলস লিবারেশন আর্মি কোনও যুদ্ধ করেনি। অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের যুদ্ধ অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের সাথে, ১৯৬২ সালে চীনের সাথে, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করেছে ভারত। ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধ বাদ দিয়ে পাকিস্তানের সাথে চারটি যুদ্ধেই বিজয়ী হয়েছে ভারত। 

১৯৬২ সালে ইন্দো চীন যুদ্ধে ভারতীয় বায়ুসেনাকে ব্যবহার করা হলে যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো। সম্প্রতি ডোকলাম উপত্যকাতে, গালওয়ান উপত্যকাতেও চাইনিজ সেনাবাহিনীকে পীছু হটতে বাধ্য করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাছাড়া কাশ্মীর উপত্যকা, উত্তর পূর্ব ভারতে ভারতীয় সেনাবাহিনী সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে ভারতবর্ষের সুরক্ষায়। সুতরাং ভারতের সেনাবাহিনী সর্বদা প্রস্তত রয়েছে। চীনে যেহুতু একটি দলের সরকারই রয়েছে তাই চীনের সামরিক বিভাগে দূর্নীতিও যথেষ্ট হয়। ২০১২ সালে চীনের সিসিপি জেনারেল সেক্রেটারি সি এর বিরুদ্ধে ৪০০০ অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানে দূর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়, চীনের আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে দূর্নীতির অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। 

চীনের লক্ষ্য ২০৪৯ এর মধ্যে সেনাবাহিনীর আধুনিকরন করা। চীন প্রতিবছর তার সামরিক বাজেট বাড়িয়ে চলেছে। ২০২৩ এ চীনের সামরিক বাজেট ১.৫৫ ট্রিলিয়ন ইওয়ান বা ৭০০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আমেরিকার সামরিক বাজেট ৮০০ বিলিয়ন ডলারের বেশী। কোনও দেশ অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হলে সেই দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানও পরিবর্তিত হয়। চীনের এই বিশাল সামরিক বাজেটের একটি বড় অংশ খরচ হয় অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের পেনশনের জন্য এবং পুরোনো সামরিক অস্ত্রের রক্ষনাবেক্ষনে, এটা চীনের প্রতিরক্ষা বিভাগের কাছেও একটি বড় সমস্যা। চীন প্রতিরক্ষা খাতে প্রচুর ব্যায় করলেও সে এখনও আমেরিকার মতো স্বয়ংসম্পূর্ন নয় এবং চীনের সামরিক পরিকাঠামোতে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা রয়েছে। 

সুতরাং চীন চাইলেও আমেরিকার মতোন একক শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় এই মূহুর্তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.