ইসরায়েলকে হটাৎ হামাস আক্রমন করার পেছনে কি কারন রয়েছে?
৭ অক্টোবর সিমচেট তোরাহের পবিত্র দিন, ইহুদি ধর্মের মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র দিন এটি। এই দিন ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী তোরাহ সম্পূর্ন করে নতুন করে পড়া শুরু হয়। হিব্রু ভাষায় ইহুদিদের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন ধর্মগ্রন্থকে একত্রিত করে এই তোরাহ তৈরি করা হয়েছে। তোরাহ শব্দের অর্থ আইন। ইহুদি জাতির উদ্ভব, তাদের শিক্ষা, সংস্কৃত ও ইশ্বরের নির্দেশ রয়েছে এই তোরাহতে। অক্টোবার মাসটাই ইহুদিদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র। সিমচেট তোরাহের মতোন, ইয়ুম কীপুর, রোস হাসানহার মতোন ইহুদি উৎসব অক্টোবর মাসেই হয়। কিন্ত গত ৭ অক্টোবর এরকম পবিত্র দিনে হঠাৎই প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে অতর্কিত আক্রমন করে। স্থল, সমুদ্র ও আকাশ পথে প্যারাগ্লাইডিং করে হামাস জঙ্গিরা অকস্মাৎ ইসরায়েল আক্রমন করে। এর কিছুক্ষনের মধ্যে গাজাপট্টি থেকে হাজার হাজার রকেট ইসরায়েল লক্ষ্য করে উড়ে আসে। ইসরায়েলের কিছু বুঝে ওঠার আগেই শয়ে শয়ে সাধারন ইসরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয় এবং কয়েকশো ইসরায়েলি নাগরিককে বন্দি করে নিয়ে যায় হামাস। ৫০ বছর আগে ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর ইহুদিদের পবিত্র দিন ইয়ুম কীপুরের সময় হঠাৎই আরব দেশগুলো ইসরায়েল আক্রমন করেছিল যাকে ইতিহাসে ইয়ুম কীপুর যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হলেও ক্ষয়ক্ষতি বেশ ভালোই হয়েছিল ইসরায়েলের। সেই ঘটনার পর এই প্রথম ইসরায়েলে এরকম নৃশংস আক্রমন হল যার পর ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তৈরি হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বিবাদ রয়েছে কিন্তু এর আগে এরকম নারকীয় আক্রমন ইসরায়েলে কোনওদিন হয়নি। ইসরায়েল হমাসের এই আক্রমনের সাথে আমেরিকার কুখ্যাত ৯/১১ সন্ত্রাসী আক্রমনের তুলনা করা হচ্ছে। যদিও এরপর ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। ইসরায়েলের বায়ুসেনা রীতিমতো এয়ারস্ট্রাইক করছে গাজায় যাতে কয়েক হাজার হামাস জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। কিন্ত যে ইসরায়েল বারবার সমস্ত আরব দেশ গুলোকে বারবার পরাজিত করেছে, যে ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক সংস্থা বলা হয় সেই ইসরায়েল হামাসের এত বড় আক্রমনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানলোনা কীকরে সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেও শুরু করেছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আক্রমনের আগে হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মহম্মদ দাইফ একটি রেকর্ড ভিডিও প্রকাশ করে অপারেশন আল আকসা ফ্লাডের ঘোষনা করে। এই অপারেশনে প্রথমে গাজা পট্টি থেকে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ন এলকাায় পাঁচ হাজার রকেট ছোঁড়া হয় এরপর কিছুক্ষনের বিরতির পর আবারও ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়। এর জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতিনইয়াহু হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল অপারেশন আয়রন শোর্ডস শুরু করে। ইসরায়েলের উপর এই আক্রমনের পর দেশের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর সরকারকে সমালোচনা করা হচ্ছে। মোসােদর প্রাক্তন প্রধান ইফরাইম হ্যাভেলি জানিয়েছে তাদের কাছে এই আক্রমনের ব্যাপারে কোন তথ্য ছিলনা। ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক কেনো এই ব্যাপারে কীছু খবর পেলো না সেব্যপাারে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি তবে যেদিন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে ইসরায়েলের বিরোধী দল এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেফতালি বেনেট বর্তমান সরকারকে সহায়তা করছে। প্রাক্তন ইসরায়েলি সেনা সদস্যরাও যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে এবং বিদেশ থেকে ইহুদিরা ইসরায়েলে আসছে দেশের হয়ে যুদ্ধ করতে।
ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতোন বহু দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। ইসরায়েলে ভারতের প্রায় ৮০,০০০ বিদ্যার্থী, তথ্য প্রযুক্তি কর্মী, হীরে ব্যাবসায়ী রয়েছে যার কারনে ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ ভারতের কাছেও গুরুত্বপূর্ন। সম্প্রতি ভারতে হওয়া জি ২০ সম্মলনে ভারত ইউরোপের মধ্যে সুয়েজ খালকে বাইপাস করে নতুন বানিজ্যপথ তৈরির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই বানিজ্যপথে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরও যুক্ত আছে। যার কারনে মধ্য প্রাচ্যে নতুন করে হওয়া এই রাজনৈতিক সংকট ভারতের কাছে ভূরাজনৈতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ন। বর্তমানে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে এবং নেতেনইয়াহুর উপর অনেক অভিযোগ রয়েছে। এরকম দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিতে হামাস এই সময়টাকেই ইসরায়েলে আক্রমন করবার জন্য বেছে নয়ে বলে ধারনা সামরিক বিশেষজ্ঞদের। হামাসকে সবচেয়ে বেশী সহায়তা ইরান করে।
১৯৮২ সালে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী যখন লেবাননে অপারেশনে যায় তখন লেবাননে ইরান তার সেনাবাহিনী ও অস্ত্র পাঠায়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লেবাননে হিজবুল্লাহ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেছে ইরান। এসব সংগঠন গুলোকে ইরান বছরে কয়েকশো মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়। ইরান হিজবুল্লাহর মাধ্যমে গাজাতে অস্ত্র স্মগালিং করায়, এরজন্য ইরানের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। হামাসের মুখপাত্র গাজি হামাদ জানিয়েছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের সাহায্য পাওয়া তাদের জন্য গর্বের। হামাস ইসরায়েলে এমন সময় আক্রমন করলো যখন মধ্য প্রাচ্যের আরবদেশ গুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু হয়েছিল। ২০২০ সালে ইসরায়েলের সাথে বাহরিন ও সংযুক্ত আরব আমির শাহির মধ্যে আমেরিকার নেতৃত্বে আব্রাহাম চুক্তি হয় যাতে এই দুটি দেশ ইসরায়েলকে সরকারি ভাবে স্বীকৃতি দেয়। সম্প্রতি সৌদি আরবের যুবরাজ মহম্মদ বিন সালমান ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাবাভিক করার কথা জানিয়েছিল যার বিরোধীতা দেখা গিয়েছিল ইরানে। বর্তমানে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সৌদি আরব আপাতত ইসরায়েলের সাথে কোন চুক্তি করবেনা বলে জানিয়েছে। আরবদেশ গুলোর সাথে ইসরায়েলের চুক্তি নাহলে সবচেয়ে বেশী লাভবান হবে ইরান। ইসরায়েল হামাসের এই যুদ্ধের দুটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে প্রথমত সৌদি আরব, ওমানের মতোন দেশ ইসরায়েলের সাথে চুক্তি থেকে সরে আসবে যার কারনে মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও অস্থির হয়ে উঠবে। এই যুদ্ধের ফলে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা আবারও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত গাজা পট্টির মতোন ওয়েস্টব্যাঙ্কেও হামাসের উত্থান হতে পারে যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যা তৈরি হতে পারে।
হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ইসরায়েলের কাছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে রকেট হামলা করে যাতে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়, এর পরেই ২০১১ সালে ইসরায়েল তাদের নিজস্ব তৈরি আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সীমান্তে মোতায়েন করে। গত বারো বছরে হামাস ও হিজবুল্লাহের অন্তত ৯০ রকেট হামলা প্রতিরোধ করেছে আয়রন ডোম। ৭০ কিলোমিটার রেঞ্জ বিশিষ্ট আয়রন ডোম সিস্টেম একটি শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যাকে ডিজাইন করা হয়েছে আর্টিলারি, আনগাইডেড রকেট, মর্টার শেল, ড্রোন আক্রমন প্রতিরোধের জন্য। ইসরায়েলের কাছে ১০ টি আয়রন ডোম ব্যাটারি আছে, প্রতি ব্যাটারিতে চারটি করে লঞ্চার থাকে অর্থাৎ ইসরায়েল তার সীমানায় ৪০ টি আয়রন ডোম লঞ্চার মোতায়েন রেখেছে। আয়রন ডোমে ব্যবহৃত হয় তামির ইন্টারসেপ্টার মিসাইল যা ১১ কিলোগ্রাম ওয়ারহেড বহন করতে পারে। একটি আয়রন ডোম ব্যাটারি একবারে ২০ টি মিসাইল ফায়ার করতে সক্ষম। সাধারন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করা হয় ব্যালেস্টিক মিসাইল প্রতিরোধ করতে কিন্তু আয়রন ডোম আনগাইডেড মিসাইল প্রতিরোধ করে কারন হামাস ও হিজবুল্লাহ এর কাছে ব্যালিস্টিক মিসাইল নেই। রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমের তৈরি আয়রন ডোম সিস্টেমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এর খরচ, একটি তামির মিসাইলের খরচ ৪০,০০০ ডলার। টাইমস অফ ইসরায়েল জানিয়েছে এবার হমাসের রকেট হামলার সময় আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল তা সত্ত্বেও আয়রন ডোম সিস্টেম হামাসের ৯০ শতাংশ রকেট প্রতিহত করেছে কিন্তু হামাস ২০ মিনিটে ৫০০০ রকেট ছোঁড়ায় ৯০ শতাংশ রকেট ধ্বংস করার পরেও বাকী ১০ শতাংশ রকেট ইসরায়েলে আঘাত হানে।